শিক্ষায় শিশুশিক্ষা ও মনোবিজ্ঞান

, যুক্তিতর্ক

মুত্তাকিন হাসান | 2023-09-01 07:50:02

সাধারণ অর্থে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনই শিক্ষা। ব্যাপক অর্থে ব্যক্তির গুণাবলীর পূর্ণ বিকাশের লক্ষ্যে পদ্ধতিগতভাবে জ্ঞান লাভের প্রক্রিয়াকে শিক্ষা বলে। বাংলায় শিক্ষা শব্দটি এসেছে ‘শাস’ ধাতু থেকে যার অর্থ শাসন করা বা উপদেশ দেওয়া। শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ education; যা এসেছে ল্যাটিন শব্দ educare বা educatum যার অর্থ হলো to lead out অর্থাৎ ভেতরের সম্ভাবনাকে বাহিরে বের করে আনা বা বিকশিত করা।

শিক্ষা মানুষের মনকে আলোকিত করে, উম্মোচিত করে নতুন নতুন জানালা। আর তাই শিক্ষার কোনো শেষ নেই। শিক্ষা শুরুর পথটা শিশুশিক্ষা দিয়েই, আর তাই বলা হয় আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এই ভবিষৎকে শুরু থেকেই সঠিকভাবে লালন-পালন না করলে কোনো কিছুই প্রত্যাশা করা যায় না।

শিশুশিক্ষার হাতেখড়ি পারিবারিকভাবে পিতামাতার মাধ্যমে হলেও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাপ্তবয়স্কদের যে পদ্ধতিতে শিক্ষা দেওয়া হয়, তা শিশুদের বেলায় বাঞ্ছনীয় নয়। শিশুদের জন্য দরকার শিশুবান্ধব মানসম্মত শিক্ষা।

মানসম্মত শিশুশিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন শিশুর মনোজগত বোঝা। একটি বেসরকারি জরিপে দেখা গেছে, আমাদের দেশের শতকরা ৭০ ভাগের বেশি বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের শিশুমনোবিজ্ঞান সম্পর্কে কোনো ধারণা বা জ্ঞান নেই। শিশুর মন না বুঝে ভয়ভীতি দিয়ে শিক্ষাদান করা শুধু তোতা পাখি বানানো ছাড়া আর কিছু নয়। শিশুশিক্ষা বা প্রাথমিক শিক্ষার শিক্ষকদের অবশ্যই শিক্ষকদের মনোজগত সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমাদের বর্তমান বেশিরভাগ শিক্ষকরা শিক্ষার্থীর প্রতি আন্তরিক না হয়ে, নিজেরা শিক্ষা বাণিজ্যে মত্ত থাকেন। ক্ষণে ক্ষণে শিক্ষার্থীর বাবা-মার সাথে শিক্ষকদের পরম আলাপচারিতা মানেই মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা নয়। শিশুশিক্ষায় শিশুদের মনের বিকাশে মনোবিজ্ঞানের ক্ষীণ প্রভাবের কারণেই শিশুরা জীবনের শুরুতেই শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।

বিদ্যমান শিক্ষার পরিবেশ তাদের মেধা বিকাশের অন্তরায়। শিক্ষক আর অভিভাবকের কড়া নিয়মশাসনে ভালো পড়তে বা লিখতে পারছে ঠিকই তবে চিন্তাশীল বা উদ্ভাবনী হয়ে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছে। আসলে তাদের এ শিক্ষা মানব বিকাশে সহায়ক নয়। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো- পরিপূর্ণ মানবিক গুণে মানুষ হয়ে উঠা। পিতামাতা তার সন্তানকে দিয়ে ভালো রেজাল্ট করাচ্ছে ঠিকই কিন্তু সত্যিকারের শিক্ষিত হয়ে উঠছে না। শিশুর সৃজনশীলতা বিকাশের যথোপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় তারা বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এতে করে টালমাটাল হচ্ছে পুরো সমাজ।

বিখ্যাত কবি মিল্টন বলেছেন- Education is the harmonious development of body, mind and soul…শিক্ষকরা যেহেতু প্রকৃত অভিভাবক এবং শিশুদের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান প্রদান করে থাকেন, তাই শিক্ষকদের হতে হবে প্রকৃত মানুষ। শিক্ষদের নিজেদের মধ্যেই যদি মানবিক গুণাবলীর ঘাটতি থাকে, তাহলে শিক্ষার্থীর মনে কখনোই মানবিক গুণাবলী জাগ্রত হবে না।

শিক্ষাদানের জন্য বিদ্যালয়ের বাহ্যিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও যত উপকরণই ব্যবহার করা হোক না কেন শিক্ষকরা নিজেরাই সবচেয়ে বড় উপকরণ। শিক্ষাকে পেশার পাশাপাশি সেবা হিসেবে গ্রহণ করতে পারলেই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে গড়ে উঠবে নিবিড়, সৌহার্দ ও স্নেহপূর্ণ সম্পর্ক। কোমলমতি শিশুদের বকাঝকা না করে সকল শিক্ষকদের উচিত সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি করা। হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা যেন প্রত্যেক শিক্ষার্থীই প্রথম স্থান অর্জন করবে। শিশুদের পাশাপাশি যেন পিতামাতারাও এমন প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। অথচ প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে জ্ঞান বিকাশের প্রথম স্তর মাত্র। তাদের জন্য আরও বহু পথ বাকি।

শিক্ষক আর পিতামাতার চাপে শিশুরা যেন দিশেহারা। ভোরবেলায় চোখ কচলাতে কচলাতে ঘুম থেকে উঠা, বিদ্যালয় থেকে ফিরে যতটুকু সময় তাতে তাদের ব্যস্ত থাকতে হয় শ্রেণীতে দেওয়া পড়ালেখা নিয়ে। শিশুরা তাদের চিন্তা চেতনা প্রকাশ করার কোন সুযোগই পাচ্ছে না। গ্রামের শিশুদের চেয়ে শহরের শিশুদের বেলায় এ অবস্থা বেশি পরিলক্ষিত হয়। কারণ শহরের বিদ্যালয়ে নেই খেলার উন্মুক্ত মাঠ। অথচ খোলামেলা মাঠ শিশুদের মনোবিকাশের অন্যতম উপাদান। শিশুরা দুরন্ত হরিণের মতো খেলাধুলা করবে এটাই স্বাভাবিক।

বিখ্যাত সাহিত্যিক আবুল ফজল বলেছেন ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতির প্রাণশক্তি তৈরির কারখানা আর রাষ্ট্র ও সমাজ সব চাহিদার সরবরাহ কেন্দ্র। এখানে ত্রুটি ঘটলে দুর্বল আর পঙ্গু না করে ছাড়বে না।’ যে স্থানেই হোক না কেন আমাদের উচিত শিক্ষার সঠিক সংজ্ঞার প্রতি খেয়াল রাখা। নচেৎ পুরো সমাজকে ভোগান্তিতে পড়তে হবে এবং যার প্রভাব সুদূরপ্রসারি। শিশুশিক্ষার বর্তমান ধারা সংশোধন করে মনোবিজ্ঞান ভিত্তিক পড়ালেখা অত্যন্ত জরুরি।

প্রত্যেক শিক্ষকের জন্য শিশু-মনোবিজ্ঞান বাধ্যতামূলক করতে হবে। শিক্ষকদের পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যেহেতু ভালো পড়ালেখার আশায় পিতামাতারা তাদের শিশু সন্তানদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাতে ইচ্ছুক বেশি, তাই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। শিক্ষাগত যোগ্যতার দিক থেকে শিক্ষকদের বড় একটি অংশ উচ্চ-মাধ্যমিকের বেশি পড়ালেখা করেননি এবং তাদের বেশিরভাগের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। যাদের প্রশিক্ষণ আছে তা আবার স্বল্পকালীন। সঠিক প্রশিক্ষণের অভাবে শিক্ষকদের মনেও নেই কোনো আনন্দ, তারা যেন কোনোমতে নিজেদেরকে ঠেলা দিয়ে চালাচ্ছে। শিক্ষকরা নিজেরাই নিজেদের মনোবিকাশে ব্যর্থ। শিশু শিক্ষার্থীর মনোবিকাশ এখানে বাতুলতা ছাড়া আর কিছু নয়।

মুত্তাকিন হাসান: কবি, প্রাবন্ধিক ও মানব সম্পদ পেশাজীবী

এ সম্পর্কিত আরও খবর