উচ্চমাধ্যমিকের ফল ও কিছু কথা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মাছুম বিল্লাহ | 2023-08-24 07:14:47

১৭ জুলাই প্রকাশিত হলো ২০১৯ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল। গতবারের চেয়ে এবার পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা বেশি এবং মেয়ে শিক্ষার্থীদের পাসের হার ছেলেদের চেয়ে বেশি। এই তিনটি বৈশিষ্ট্যই এবারের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলে লক্ষণীয়।

এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পরীক্ষার্থী ছিল ১৩ লাখ ৫৮ হাজার ৫০৫ জন। এর মধ্যে আটটি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডের অধীনে এইচএসসিতে পরীক্ষার্থী ছিল ১১ লাখ ৩৮ হাজার ৫৫০ জন ও মাদরাসা থেকে আলিমের শিক্ষার্থী ছিল ৮৮ হাজার ৪৫১ জন ও কারিগরিতে ছিল ১ লাখ ২৪ হাজার ২৬৪ জন পরীক্ষার্থী। এর মধ্যে ৬ লাখ ৬৪ হাজার ৪৯৬ জন ছাত্র ও ৬ লাখ ৮৭ হাজার ৯ জন ছাত্রী। মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৯ হাজার ৮১ শিক্ষা।

এবারের এইচএসসির ফল প্রকাশিত হলো ৫৫ দিনের মধ্যে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফল প্রকাশিত হয়েছে বলে এটিকে পজিটিভ বলা যায়। এখন পাবলিক পরীক্ষার ফল দু’মাসে দেওয়া হয়, যা আগে তিনমাসে দেওয়া হতো। এবার দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফল প্রকাশের কারণে প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান এবং তিনি এতে খুশিও হয়েছেন। তবে, পরীক্ষার ফল তাড়াহুড়ো করে দেওয়া মানে প্রচুর ভুল-ত্রুটি থেকে যেতে পারে।

আর একটি বিষয় তো আমরা খেয়ালই করছি না। সেটি হচ্ছে, একজন শিক্ষার্থীর সারাজীবনের বিচার করছেন একজন শিক্ষক। তিনি অভিজ্ঞ হোক, অনভিজ্ঞ হোক, নতুন হোক, পুরান হোক, খাতা মূল্যায়ন করতে জানুক আর না জানুক, একজন শিক্ষকের কয়েক মিনিটের বিচার এবং রায় হচ্ছে একজন শিক্ষার্থীর ১২ বছরের সাধনার ফল এবং ভবিষ্যতের পথচলার নির্দেশক। এটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

একটি উত্তরপত্র বিশেষ করে এই ধরনের পাবলিক পরীক্ষার খাতা কমপক্ষে দু’জন পরীক্ষকের পরীক্ষণ করা উচিৎ, তা না হলে সেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হয় না। এরপর হাজার হাজার ভুল ত্রুটি ধরা পড়বে, সেখানে বোর্ড কিছু অর্থ উপার্জন করবে কিন্তু কাজের কাজ খুব একটা কিছু হবে না কারণ খাতা তো পুনর্মূল্যায়ন হয় না। শুধু ওপরের নম্বর দ্বিতীয়বার গণনা করা হয়। আমরা একটি পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে এর ধরনের খেলা খেলতে পারি না।

এবার ৪১টি প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ পাস করেনি। এদের মধ্যে ৩৩টি কলেজ ও আটটি মাদরাসা রয়েছে। কিছু কিছু কলেজ দেখলাম মাত্র একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েছিল, ওই একজনই অকৃতকার্য হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান নিয়ে শিক্ষা প্রশাসন তথা সরকারের সিদ্ধান্ত কী? কেনইবা একজন শিক্ষার্থীও পাস করতে পারে না আবার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে মাত্র একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষা দেয়, এটিই বা কেমন প্রতিষ্ঠান?

কুমিল্লা বোর্ডে এবার এইচএসসিতে পাসের হার সবচেয়ে বেশি ৭৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ অথচ এই শিক্ষার্থীরা ২০১৭ সালে যখন এসএসসি পাস করে তখন তাদের পাসের হার ছিল সর্বনিম্ন ৪৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। হঠাৎ করে এই পরিবর্তন কীভাবে হলো? শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, তারা হয়তো বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন, তাই এরকম হয়েছে।

আমরা জানি শিক্ষাবোর্ড একমাত্র পরীক্ষা গ্রহণ করা ছাড়া কীভাবে শিক্ষকরা পড়াবেন, কীভাবে শিক্ষার মান উন্নয়ন ঘটানো যায় ইত্যাদি নিয়ে তাদের তৎপরতা খুব একটা কখনও দেখা যায় না। একটি বোর্ডের অধীনে কয়েকটি জেলায় কয়েক হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকে। সেগুলোর শিক্ষাদান, শিক্ষক উন্নয়ন ও শিক্ষার্থী উন্নয়ন নিয়ে বোর্ডের কোনো তৎপরতা বা কাজ আমরা দেখি না। কিন্তু পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর বোর্ডগুলোর মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়। কোন বোর্ডে কত বেশি শিক্ষার্থী পাস করেছে; বোর্ড যেন এক ধরনের কৃতিত্ব দেখাতে চায়।

আসলে আমাদের দেশে শিক্ষাবোর্ডগুলো একমাত্র শিক্ষার্থী রেজিস্ট্রেশন আর খাতা মূল্যায়ন ছাড়া তেমন কোনো কাজ করে না। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা একটি জেলার কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরীক্ষায় ভালো করলে তা ওই প্রতিষ্ঠান পরিচালনাকারীদের এবং একই জেলার কিছু প্রতিষ্ঠান ভালো করলে শিক্ষা প্রশাসন কিছুটা কৃতিত্ব নিতে পারে। বোর্ড কেন? বোর্ড কি শিক্ষকদের কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়? বোর্ড কি শিক্ষকদের ক্লাস পর্যবেক্ষণ করে? বোর্ড কি শিক্ষার্থীদের মানসম্মত পড়ালেখা করার জন্য কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে? এর কোনোটিই করে না। তাহলে তারা কৃতিত্ব দেখাতে চায় কেন, বিষয়টি আমার কাছে বোধগম্য নয়।

পত্রিকায় দেখলাম যশোর বোর্ডে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে আছে। বোর্ডের ১৮টি কলেজের পাসের হার শতভাগ। এ বোর্ডে সামগ্রিক পাসের হার ৭৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ, আর মেয়েদের পাসের হার ৭৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ছেলেদের পাসের হার ৭২ দশমিক ৭৪ শতাংশ। দিনাজপুর বোর্ডেও ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে আছে। এ দু’টো বোর্ডে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা কি বেশি পড়াশোনা করেছে? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে যেটি গবেষণার মাধ্যমে জানা প্রয়োজন।

ফলাফলের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ২০১৫ সাল থেকে পাঁচ বছর যাবত ছাত্রীরা ধারাবাহিকভাবে ছাত্রদের চেয়ে বেশি পাস করে আসছে। এ বছর ছাত্রীদের পাসের হার ৭৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ আর ছাত্রদের ৭১ দশমিক ৬৭ শতাংশ অর্থাৎ ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীদের পাসের হার ৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেশি। এটি যদিও আনন্দের সংবাদ কিন্তু এর সঠিক কারণ জানা প্রয়োজন।

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক। বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিকে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর