কেন এই ছন্দপতন

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

তুষার আবদুল্লাহ | 2023-08-30 22:13:32

সমাজ স্বাভাবিক জায়গায় নেই। অস্বাভাবিক আচরণ করছে। এই আচরণ নতুন নয়। তবে এবার অস্বাভাবিকতার চূড়ান্ত মাত্রায় বুঝি পৌঁছে গেল। সমাজ যাদের নিয়ে তৈরি, সেই মানুষেরা এখন তার গুণশূন্য। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে এখন আর মানবিক উপকরণ চোখে পড়ছে না। মানুষ এমন আচরণ করছে, যা পশুর মধ্যেও অনুপস্থিত। তাহলে মানুষ এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াল?

আপনি বাড়ি থেকে বের হলেন। পথের কোথাও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। সামনে দিয়ে চলাচল করা কারো দিকে তাকাচ্ছেন। এমনিতেই তাকাচ্ছেন। কোনো শিশুকে দেখে তাকাতে পারেন। আপনার এই তাকানো দেখে এক দল হত্যাকারী আপনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। যারা ঝাঁপিয়ে পড়ল, তাদের অনেকেই হয়তো এতোক্ষণ আপনার আশপাশেই ছিল। একজন বা দুইজন আপনার ওপর ঝাঁপ দিল তো ব্যস অন্য পথচারীদের একটি অংশ আপনাকে না বাঁচিয়ে ‘গণ’তে যোগ দিল। আপনি হয়ে গেলেন ছেলেধরা। কিংবা কোনো মেয়েকে উত্ত্যক্তকারী। আপনাকে কেউ বাঁচাতে আসবে না। দূরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে থাকবে।

পথের কথা বাদ দিন। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের ঘর থেকে একজন মাকে নামিয়ে এনে হত্যা করে ফেলল। প্রতিবন্ধী একজনকেও মেরে ফেলা হলো ছেলেধরা সন্দেহে। সেই হত্যাকাণ্ড সমাজ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে উপভোগ করল। ঢাকাই চলচ্চিত্রের মন্দা বাজারে এই দৃশ্য বেশ উপভোগ্য এখন সমাজের কাছে।

সমাজটাকে দেখলে আপনার মনে হবে হতাশায় ডুবে আছে। ব্যক্তিগতভাবে হয়তো আপনি এবং আমিও তাই। কেন এই হতাশা? দুর্নীতির সরলীকরণ এর একটি কারণ অবশ্যই। প্রত্যেকেই যার যার অবস্থান থেকে মৃদু বা ভয়াবহ দুর্নীতির সঙ্গে পেঁচিয়ে আছি। নিজে দুর্নীতি করছি অথবা সয়ে যাচ্ছি। দুর্নীতি সামাল দেওয়া, ভোগ করাও সহজ নয়। নানা দিক সামাল দিয়ে চলতে হয়। যখন নকশা মতো হচ্ছে না, তখন হাজার কোটি টাকার মালিকের মধ্যেও হতাশা দেখা দেয়। আবার আপনি নিজে দুর্নীতি করছেন না, কিন্তু দুর্নীতির শিকার। নীরবে সয়ে যেতে যেতে আপনি হতাশার ব্যাধিতে আক্রান্ত। শিক্ষার্থীরা শিক্ষা বাণিজ্যের ‘কড়ি’। কড়ি দিয়ে তারা সনদ কিনছে ঠিকই কিন্তু যুৎসই চাকরি পাচ্ছে না। সাধারণ কৃষক, উৎপাদক তার ফসল ও পণ্যের দাম থেকে বঞ্চিত। তারপরও সমাজের আকাশে টাকা উড়ছে। ওই টাকা ধরতে না পেরে কেউ হতাশ। আবার কেউ ধরতে পেরে সেই টাকা ভোগ করতে করতেও এক ধরনের হতাশা এসে তাদের ঘিরে ধরেছে।

বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা আছে। অপরাধের তদন্ত স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় দ্রুত আদালতে পৌঁছে না। হিমঘরে জমতে থাকে। অপরাধের কারণ ও অপরাধীদের সঙ্গে রাজনীতির এখন প্রবল আত্মীয়তা। ফলে অপরাধের স্বাভাবিক বিচার প্রক্রিয়া সচল না দেখে সাধারণের মধ্যে এক ধরনের হতাশার নিম্নচাপ তৈরি হয়। আমরা বুঝি এখন সেই নিম্নচাপের ঘূর্ণি দেখতে পাচ্ছি। এই ঘূর্ণিই নিজেকে প্রকাশের জন্য গুজবের ধুলি খুঁজে বের করছে। ফলাফল গণপিটুনি, হত্যা ও ধর্ষণ। এই ঘূর্ণি থেকে সমাজ, রাষ্ট্র পরিত্রাণ পাবে কোন উপায়ে? একবারেই যে ঘূর্ণি মোকাবেলার সাধ্য নেই আমাদের, তা নয়। আছে। যে স্বাভাবিক রাজনৈতিক অনুশীলন দেখে আমরা অভ্যস্ত, তা যদি আবার ফিরে আসে, তবেই দেখা যাবে হতাশার নিম্নচাপ কাটতে শুরু করেছে। মানুষ, সমাজ স্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করেছে। অপরাধের বিচার প্রক্রিয়াও তখন স্বাভাবিক ছন্দে চলতে শুরু করবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর