ভাগ্যবান এরশাদ ও বাংলাদেশের রাজনীতি

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.) | 2023-09-01 03:47:12

মৃত্যুর পর সামরিক শাসকরা সাধারণত বিস্মৃতির অতল গহবরে হারিয়ে যায়। কিন্তু রাজনীতিতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রেখে যাওয়া ক্ষতচিহ্ন সহজে শুকাবে না বিধায় তার সম্পর্কে আরও কিছু দিন অনেক আলোচনা-সমালোচনা হবে। এরশাদ সম্পর্কে এক বাক্যে বলতে গেলে বলতে হবে তিনি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান ব্যক্তি ছিলেন কবরে শায়িত হওয়ার আগ পর্যন্ত। একই সঙ্গে বলতে হবে তার ভোগবিলাসপূর্ণ ক্ষমতার লিপ্সা রাজনীতি ও রাষ্ট্রকে যে পরিমাণ ক্ষতি করেছে তা কোনো দিন পূরণ হবার নয়।

দেখুন ভাগ্য কাকে বলে। একাত্তরে এপ্রিল মাসে মুক্তিযুদ্ধ তুঙ্গে, বাংলাদেশে অবস্থিত সব বেঙ্গল রেজিমেন্ট পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। অভিযোগ আছে, সেই সময়ে এরশাদ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ছুটে এসেছেন এবং ছুটি কাটিয়ে নিশ্চিন্তে ফিরে গিয়ে পাকিস্তানের অনুগত অফিসার হিসেবে চাকরি করলেন ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। পক্ষান্তরে ওই সময়ে নিজের ও পরিবারের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জেনারেল মঞ্জুর (তখন মেজর) পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেন। বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করলেন, বীর উত্তম খেতাব পেলেন। সেই মুক্তিযোদ্ধা মঞ্জুরকে ষড়যন্ত্রের মধ্যে ফেলে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। তার কবর কোথায় আছে বাংলাদেশের মানুষ জানে না। অথচ এরশাদ সেনাপ্রধান হলেন, রাষ্ট্রপতি হলেন এবং মৃত্যুর পর মহাসমারোহে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত হলেন। কিন্তু মঞ্জুর হত্যা মামলার আসামি হিসেবে এরশাদ চিরবিদায় নিয়েছেন।

১৯৭৩ সালে পাকিস্তান থেকে ফেরত আসার পর এরশাদের চাকরি থাকবে কিনা এমন কথা উঠেছিল বলে শোনা যায়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পর পতপত করে কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি কর্নেল থেকে ব্রিগেডিয়ার ও জেনারেল হয়ে গেলেন। উপ-সেনা প্রধান থেকে জিয়াউর রহমান তাকে সেনাপ্রধান বানালেন। অনেকে বলে থাকেন, এরশাদকে সেনাপ্রধান না বানালে জিয়াউর রহমানকে এমন করুণ পরিণতির শিকার হতে হতো না। ভাগ্যদেবীর প্রসন্নতায় এরশাদ ৯ বছর প্রতাপের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভোগ করলেন। সেই ভোগের মাত্রার সীমাহীনতায় এরশাদকে নিয়ে শিল্পী কামরুল হাসান যে চিত্র এঁকে ছিলেন এবং তাতে যে ক্যাপশন দিয়েছিলেন তা এখন বাংলাদেশের ইতিহাস।

গণআন্দোলনে উৎখাত হওয়ার পর বিশ্বের কোন সামরিক শাসকের নাম নিশানা কোথাও থাকেনি। আন্দোলনের তোড়ে ১৯৯০ সালে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার পরে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ২৯ বছর এরশাদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে থেকেছেন। ভাগ্যদেবীর হাত ধরে রাজনীতিতে এরশাদ জিয়াউর রহমানকে অনুসরণ করেছেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত দুই সামরিক শাসককেই অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে রায় দিয়েছেন। জিয়াউর রহমান রায় আসার আগেই মরে বেঁচে গেছেন, আর এরশাদ ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছেন। আর তা না হলে দু’জনের অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে বিচার হতে পারতো।

অনেকে বলার চেষ্টা করেন, এরশাদ তো দেশের উন্নয়নে অনেক কাজ করেছেন। এটা ঠিক এরশাদ কিছু রাস্তাঘাট দালানকোঠা তৈরি করেছেন। সব দেশের সামরিক শাসকেরা এমন কিছু কাজ করে থাকেন। প্রায় ২০০ বছরের উপনিবেশিক শাসনের সময় ব্রিটিশরা স্কুল-কলেজ, রাস্তাঘাট, রেল লাইন তৈরি করেছেন যার অনেক কিছুকে যুগান্তকারী বলা যায়। পাকিস্তানও যে এরকম কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করেনি তা নয়। তাহলে আমরা ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিদের তাড়ালাম কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে শতশত পৃষ্ঠা লিখতে হবে। ব্রিটিশরা ভারত উপমহাদেশের কী ক্ষতি করেছে তা কেউ তথ্য-উপাত্তসহ জানতে চাইলে ভারতের রাজনীতিক ও লেখক শশী থারুরের লেখা ’অ্যান এরা অফ ডার্কনেস’ বইটি পড়ে দেখতে পারেন।

আজকের যে পাকিস্তান তার দিকে তাকালে বোঝা যায় ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সামরিক শাসকগণ মোল্লাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশের কত বড় সর্বনাশ করেছেন। লাহোর, ইসলামাবাদ গেলে উন্নয়নের ঝলকে আপনার চোখে ধাঁধা লেগে যাবে। এই পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীগণ এখন শাসকদের কাছে আবেদন করছেন সুইডেন নয় আমাদের দেশকে বাংলাদেশের মতো করে দেন। সার্বভৌমত্ব বলতে পাকিস্তানের কিছুই নেই। আমেরিকা জঙ্গি দমনের নামে পাকিস্তানের ভেতরে যখন তখন ড্রোন আক্রমণ চালায়। একবারও পাকিস্তানের কাউকে জিজ্ঞাসা করে না। অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে একবার ওয়াশিংটন তো আরেকবার প্যারিসে দৌড়াচ্ছেন।

সামরিক শাসকদের উন্নয়নের চেহারা আর যক্ষা রোগের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। উপরে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাট। থাক সেসব কথা। জাতীয় পার্টির কথায় ফিরে আসি। এরশাদের অবর্তমানে জাতীয় পার্টির কী হবে এটা নিয়েই এখন আলোচনা চলছে। ভবিষ্যতে এই আলোচনা আরো জমে উঠবে। জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের মধ্যে ক্ষমতার বন্টন ও ভারসাম্য রক্ষা করতে যে এরশাদ নিজেই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হিমশিম খেয়েছেন। দ্বন্দ্ব সামলাতে গিয়ে বছর দুই আগে এরশাদ একবার প্রকাশ্যে বলেছিলেন, আই এম দা জাতীয় পার্টি। এই কথার বাস্তব রূপ দেখা গেছে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। তবে জাতীয় পার্টি যেহেতু ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় আছে, তাই এই মুহূর্তে দল হয়তো ভেঙে যাবে না। তবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বিশেষ করে আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্যারাডাইম শিফট এবং নতুন নতুন মেরুকরণের ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। যার ফলশ্রুতিতে জাতীয় পার্টি ও বিএনপি কেউ তার বর্তমান অবয়ব রক্ষা করতে পারবে বলে মনে হয় না।

বিএনপি'র যেরকম লেজেগোবরে অবস্থা তাতে এটা প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায়, আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে বর্তমান ধারার রাজনীতি ও নেতৃত্ব বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারবে না। তবে এর অনেকটাই নির্ভর করছে শাসক দল আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনায় বৃহত্তর জনগণের সন্তুষ্টি ও সমর্থন কতখানি অর্জন করতে পারছে তার ওপর। এখন একথা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও ব্যর্থতার ওপর ভর করেই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী দল বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি, ক্ষমতা দখল ও তার বিস্তার ঘটিয়েছে। নিজেদের নীতি আদর্শ বা অর্জনের ওপর ভিত্তি করে নয়।

গত প্রায় ১০/১১ বছর বঙ্গবন্ধুর নীতি, আদর্শ, দর্শন, চিন্তা-চেতনা ও পথ নির্দেশনার ওপর অটল রেখে বাংলাদেশকে আজ যে মর্যাদার আসনে শেখ হাসিনা অধিষ্ঠিত করেছেন তাতে বাংলাদেশের বৃহত্তর মানুষ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মগজে এই মর্মে বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে যে ইতোমধ্যে উন্মোচিত অপার সম্ভাবনার বাস্তবায়ন চাইলে মুক্তিযুদ্ধের দর্শন ও আদর্শের উপর থাকতে হবে। সুতরাং অন্যান্য রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যারা জড়িত এবং যারা আওয়ামী লীগ দল করতে পারবেন না তারা অবশ্যই রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য আওয়ামী লীগের বাইরে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের রাজনৈতিক প্লাটফর্ম তৈরি করবেন। তখন সেটাই হবে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের অনুঘটক। এই উদ্যোগ কিছুটা সফল হলেই জাতীয় পার্টির বিক্ষুব্ধ অংশ হয় আওয়ামী লীগ আর নয়তো নতুন আবির্ভূত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সঙ্গে যোগ দেবেন। তাতে ব্রাকেটের ভেতর এরশাদের নাম সম্বলিত দলের অবস্থা কী হয় তা দেখার জন্য সে পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে সব কথার শেষ কথা হলো, সামরিক শাসকের দল তার বর্তমানে বিশ্বের কোথাও স্থায়ীভাবে টিকে থাকেনি।

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.): কলামিস্ট এবং ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর