ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও তাঁর ব্রেক্সিট মিশন

, যুক্তিতর্ক

মাছুম বিল্লাহ | 2023-08-31 03:53:28

আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যে ব্রেক্সিট সম্পন্ন করার লক্ষ্য নিয়ে ২৪জুলাই ২০১৯ ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন বরিস জনসন । চুক্তিসহ হোক আর চুক্তি ছাড়াই হোক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ব্রেক্সিট সম্পন্ন করার ব্যাপারে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ২৪জুলাই বাকিংহাম প্যালেসে তাকে নিয়োগ দেন রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। তার পরেই ডাউনিং স্ট্রীটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দেন যে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বিচেছদপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করবেন তিনি ।

আমরা জানি এই বিচেছদপ্রক্রিয়ার চক্রের মধ্যেই পদত্যাগে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী তেরেস মে।ব্রিটিশ রাজনৈতিক অঙ্গন বর্তমানে ব্রেক্সিট নিয়ে বেশ উত্তপ্ত।ব্রেক্সিটের উত্তাপসহ নতুন প্রধানমন্ত্রীকে ইরান ইস্যু, আয়ারল্যান্ড ইস্যু, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের জটিল বিষয়গুলোও মোকাবিলা করতে হবে।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সের আসনসংখ্যা ৬৫০টি।এর মধ্যে কনজারভেটিভ দলের নেতৃত্বাধীন জোটের দখলে আছে ৩২০টি আর বিরোধী লেবার পাটির দখলে আছে ৩১৮টি।মাত্র দুই আসনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠতা টোরিদের।জনসনের ব্রেক্সিট তত্ত্বের সঙ্গে লেবার তো বটেই , বহু টোরি সদস্য একমত নন। বিশেষ করে বেশিরভাগ এমপিই চুক্তি ছাড়া ব্রেক্সিট প্রক্রিয়ায় যেতে রাজি নন।ফলে শিগরিই হাউস অব কমন্স ব্রেক্সিট নিয়ে আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠবে।

বহু আইন প্রণেতা ইতিমধ্যে হুমকি দিয়েছেন যে চুক্তিছাড়া ব্রেক্সিট হলে তারা জনসনের সঙ্গে থাকবেন না। অর্থাৎ পরিস্থিতি ঘোলাটের দিকে যাচেছ আর জনসনকে লেবার পার্টির পাশাপাশি নিজ পার্টির আš:Íবিবাদও মেটাতে হবে। জনসনের সামনে আর একটি চ্যালেঞ্জ। সেটি হচেছ ইরানে সঙ্গে বিরোধ। ডাইনিং স্ট্রীটে ঢোকার পর তাঁর প্রথম কাজ হচেছ মন্ত্রী পরিষদ গঠন।

জনসন ইতিমধ্যে কানজারভেটিভ পার্টির কট্টর ব্রেক্সিটপন্থী সংষদ সদস্যদের বাছাই করে মন্ত্রী বানিয়েছেন। তাঁর ৩১ সদস্যের মন্ত্রীসভায় স্থান পেয়েছেন আটজন নারী।তেরেসা মে’র ২৯সদস্যের মন্ত্রীসভায় নারী ছিলেন ৩০ শতাংশ আর জনসনের মন্ত্রীসভায় নারী হচেছন ২৬শতাংশ। তার মন্ত্রীসভায় সরকারের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ন পদ চ্যান্সেলর অব এক্সচেকার বা অর্থমন্ত্রী হয়েছেন সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত  সাজিদ জাভিদ।ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে চরম অবস্থান নেয়া সাবেক মন্ত্রী ডমিনিক রাব ও প্রীতিতপাটেলকে মন্ত্রীসভায় ঠাঁই দিয়েছেন জনসন। রাব পররাস্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রীতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন।মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকেই ২৫ মে জনসন আগামী দিনের নতুন রূপরেখা তৈরি করার কাজ শুরু করেছেন।

জনসনের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই হওয়া অন্যদের মধ্যে ’ চুক্তি ছাড়াই ’ ব্রেক্সিট সম্পাদনের দায়িত্বে রয়েছেন মাইকেল গভ। এ ছাড়া বেন ওয়ালেস প্রতিরক্ষা, গ্যাভিন ইউলিয়ামসন শিক্ষা , নিকি মরগান সংস্কৃতি  ও আন্দ্রিয়া লিডসাম বাণিজ্য আর লিজ ট্রুস আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। এদিকে তেরেসা মের মন্ত্রীসভার স্টিফেন বার্কলে , ম্যাট হ্যানকক ও আম্বার রুডকে আগের পদেই বহাল রেখেছেন জনসন। তবে নতুন মন্ত্রীসভায় ঠাঁই হয়নি তেরেসা মে সরকারের ১৭মন্ত্রীর। দুবার ইইউর বেঁধে দেয়া সময় অনুসারে ব্রেক্সিট কার্যকরে ব্যর্থ হন তার পূর্বসূরি তেরেসা মে।কারণ মে চেয়েছিলেন অর্থনীতি, বাণিজ্যসহ নানা বিতর্কিত ইস্যুতে ইইউর সঙ্গে ব্রিটেনের চুক্তি হোক। সেটি করতে না পারায় ব্রেক্সিটও কার্যকর করতে পারেননি তিনি। কিন্তু জনসন ব্যর্থ হতে চান না। তাই তিনি বলেছেন, ’ কোন যদি নয়, কোন কিন্তু নয়’ ৩১অক্টোবর বা তার পূর্বেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।ব্রেক্সিটের ব্যাপারে জনসন কঠোর হলেও চুক্তি ছাড়া বেরিয়ে যেতে আগ্রহী নন অনেকেই। আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী লিও ভারাডকার মনে করেন ইইউর সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া ব্রেক্সিট কার্যকর করা হলে বাণিজ্যিকভাবে সবেচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে আযারল্যান্ড।তাই তিন বলছেন বিষয়টিতে জনসনের আপোষ করা দরকার।

হাউস অব কমন্সের ভাষণে যুক্তরাজ্যের জন্য একটি সোনালি যুগের সূচনার অঙ্গীকার করে জনসন বলেন বেক্সিট কার্যকর করার সময় উত্তর আয়ারল্যান্ড ইস্যূরও সমাধান করা হবে বেলফাস্ট চুক্তির মাধ্যমে। চুক্তির মাধ্যমে ব্রেক্সিট হলে আয়ারল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের মধ্যে সীমান্ত বেড়া দেয়া হবে। চুক্তির মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত সম্ভব না হলেও চু্িক্তবিহীন ব্রেক্সিটই হবে। যদিও সেখানে বিরাট চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে জনসনের জন্য।

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ১০নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে প্রথা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর সাথে থাকেন তার স্ত্রী কিংবা স্বামী। কিন্তু নতুন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের স্ত্রী নেই। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তার সাথে থাকবেন ক্যারি সাইমন্ডস নামের এক নারী –যিনি জনসনের বান্ধবী। তার বয়স ৩১। মাত্র ২৯ বছর বয়সেই এই তরুণী তার দক্ষতা প্রমাণের মাধ্যমে কনজারভেটিভ পার্টির পিআর প্রধান হিসেবে বিবেচিত হন। তিনি ২০০৯সালে কনজারভেটিভ হেডকোয়ার্টার্সে  প্রেসের প্রধান হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। ক্যারি ইউনিভার্সিট অব ওয়ারউইক থেকে থিয়েটার ও হিষ্ট্রি অব আর্টস নিয়ে প্রথম শ্রেণি নিয়ে  স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। জনসনের ব্যক্তি জীবন নিয়ে আরও কিছু প্রশ্নবোধক অধ্যায় রয়েছে সেগুলোকে ছাপিয়ে এখন সবার দৃষ্টি হচেছ কতটা সফলতার সাথে তিনি ব্রেক্সিট কার্যকর করতে পারবেন সেটি করতে পারেননি তাঁর পূর্বসূরি।

সব বিতর্ক আর বাঁধা পেরিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্রেক্সিট নিশ্চিত করতে পারলেই যে জনসন পার পেয়ে যাবেন তেমনটি কিন্তু নয়। তার সামনে আছে ইরান, চীনসহ আরো অনেক ইস্যু, যেগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে তাকে এক সঙ্গে ভাবতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক। মার্কিণ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন তাঁর দৃষ্টিতে জনসন হচেছ ’ ব্রিটিশ ট্রাম্প’।তিনি আশা করেন তাঁর পছন্দনীয় ব্রেক্সিটপন্থী নাইজেল ফারাজের সঙ্গে যিনি ব্রেক্সিট পার্টির প্রধান মিলেমিশে কাজ করবেন। প্রভাবশালী দৈনিক গার্ডিয়ান লিখেছে ’ ২০১৬ সালের ব্রেক্সিটপন্থী জনসন এখন সেই বিশৃংখলার জট খুলবেন যা একসময় সযতনে তিনিই নিজ হাতে তৈরি করেছেন।’ শুধু ইউরোপ  আর আমেরিকা নয়, গোটা দুনিয়ার আগ্রহী চোখ তাকিয়ে আছে ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের দিকে---কিভাবে তিনি মোকাবিলা করতে যাচেছন এসব ইস্যুগুলো এবং বিশেষ করে ব্রেক্সিটকে কিভাবে কার্যকর করতে যাচেছন তিনি। তিনি যে সোনালি অধ্যায় সূচনার কথা বলেছেন সেটি কি আসলেই সোনালি হবে না ধুসর হবে।সেটি দেখার জন্য  বিশ্ববাসীকে আরও কয়েকটি দিন অপেক্ষা করতে হবে।

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা গবেষক ও বিশেষজ্ঞ, বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর