আতঙ্ক নয়, চাই সতর্কতা

, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-22 19:55:32

ডেঙ্গু জ্বর তার রেকর্ড ছাড়িয়েছে আগেই, এখন গড়ছে নতুন রেকর্ড। মৃত্যু, আক্রান্তের সংখ্যা তো আছেই; এবার সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে আতঙ্ক। শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গু রোগী ধরা পড়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। এখন পর্যন্ত দেশের ২৩ জেলায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। তবে ঢাকার বাইরের অধিকাংশ রোগীই ঢাকা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গ্রামে গেছে। ফলে ডেঙ্গু এখনও সারা দেশে না ছড়ালেও ঝুঁকিটা কিন্তু থেকে যাচ্ছে। যারা ঢাকা থেকে ডেঙ্গুর জীবাণু নিয়ে গ্রামে যাচ্ছে, তারা কিন্তু একই সাথে ঝুঁকিটাও বহন করছে। কারণ কোনো ডেঙ্গু রোগীকে সাধারণ মশা কামড় দিয়ে, সেই মশা অন্য কাউকে কামড় দিলেও ডেঙ্গু ছড়াতে পারে। তার মানে এডিস ছাড়াও ডেঙ্গু ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে।

সামনেই পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদের সময় ঢাকাকে খালি করে নাড়ীর টানে সবাই গ্রামে ফিরে যান। তাই ঈদুল আজহার আনন্দ সারা দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে ঝুঁকি আরো বাড়াতে পারে। সবার প্রতি অনুরোধ, ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে কেউ গ্রামে যাবেন না। ঢাকায় থেকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে তবেই ঢাকার বাইরে যাবেন।

গত ১৯ বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে, মানে এপ্রিল-অক্টোবর ডেঙ্গুরও মৌসুম। তবে এবারের মত আতঙ্ক আর কোনোবার ছড়ায়নি। প্রধান কারণ হলো, মৃতের সংখ্যা। বেসরকারি হিসেবে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা প্রায় ৫০। মৃতের সংখ্যার চেয়ে ধরনটা বেশি বিপদজনক ও শঙ্কার। হবিগঞ্জের সিভিল সার্জনসহ অন্তত ৪ জন ডাক্তার মারা গেছেন। মারা গেছেন এক ডাক্তারের শিশু সন্তানও। তার মানে এবারের ডেঙ্গু আঘাত হানে নীরবে। টের পাওয়ার আগেই শেষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর মৃত্যু আতঙ্ক ছড়িয়েছে এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট পেশের কথা যাদের মনে আছে, তারা জানেন; ডেঙ্গু কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। ডেঙ্গুর ছোবল থেকে রক্ষা পাননি বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সেপ্পোও। তাই এবার ডেঙ্গুর আতঙ্ক সর্বব্যাপী, সর্বগ্রাসী।

তবে আতঙ্ক দিয়ে ডেঙ্গু মোকাবেলা করা যাবে না, সতর্ক থাকতে হবে। প্রথম সতর্কতা হলো, মশা যেন আপনার নাগাল না পায়। কয়েল ব্যবহার করে মশা দূরে রাখার চেষ্টা করবেন। রাতে অবশ্যই মশারি ব্যবহার করবেন। তবে এডিস মশা থেকে দূরে থাকার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো, এডিস মশা জন্মাতে না দেয়া। আপনার সবাই জানেন, এডিস অভিজাত মশা। এডিস বংশবৃদ্ধি করে জমে থাকা পরিস্কার পানিতে। তাই আপনার বাসায়, বারান্দায়, ছাদে, কার্নিশে, আশেপাশের ড্রেনে- কোথাও যাতে পরিস্কার পানি জমতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। ডাবের খোসা, গাড়ির পরিত্যক্ত টায়ার-টিউব, ক্যান, কোনোকিছুর ভাঙা অংশ, ফুলের টব হতে পারে এডিস মশার নিরাপদ আবাস।

সারাক্ষণ চোখ কান খোলা রাখুন। ডেঙ্গুর ভয়ে বাসাকে টবশূন্য করে ফেলবেন না। টবে যাতে পানি জমতে না পারে, এটুকু নিশ্চিত করলেই হবে। আপনার আশেপাশে কোথাও নির্মাণ কাজ চলছে কিনা খেয়াল রাখুন। হলে সেখানে আপনার চোখের আড়ালে এডিস মশা বংশ বাড়াচ্ছে কিনা খোঁজ নিন। আপনি, আপনার প্রতিবেশী, তার প্রতিবশেী- এভাবে যদি পুরো পাড়া এডিসমুক্ত করতে পারেন, তাহলেও আপনারা অনেকটা নিরাপদ। কারণে এডিস মশা দেড়শ মিটারের বেশি উড়তে পারে না। তাই উত্তরের মশা উড়ে এসে দক্ষিণে আপনাকে কামড়াবে বা দক্ষিণের মশা উড়ে গিয়ে উত্তরের কাউকে কামড়ানোর সুযোগ নেই। তবে বাসা বা এলাকাকে এডিসমুক্ত করা একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ, কিন্তু পুরো নিরাপত্তার গ্যরান্টি নয়।

আপনি তো আর নন্দলাল নয় যে সারাদিন নিজেকে ঘরে বন্দী করে রাখবেন। আপনাকে অফিসে যেতে হবে, স্কুল-কলেজে যেতে হবে। রাস্তায় চলাচল করতে হবে। পুরো শহর তো আর আপনি এডিসমুক্ত করতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে যত গরমই হোক, আপনি ফুল স্লিভ শার্ট, মোজাসহ জুতা পড়ে বেরুবেন। মশা থাকতে পারে, এসন জায়গা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলবেন। তবে সবচেয়ে বড় আতঙ্ক সন্তানদের নিয়ে। আপনার সন্তানকে যে স্কুলে বা কলেজে বা ইউনিভার্সিটিতে পাঠাচ্ছেন; সেটি এডিসমুক্ত তো। এটা কিন্তু আপনার হাতে নেই। আপনি বড় জোর স্কুল কর্তৃপক্ষকে বলতে পারেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু এবং আরো অনেকের আক্রান্ত হওয়ার খবরে আতঙ্ক আরো বেশি ছড়িয়েছে। তাই অনেকেই দাবি করছেন, প্রয়োজনে কিছুদিনের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হোক। তবুও যেন আমাদের সন্তানেরা নিরাপদ থাকে।

এত সাবধানতার পরও আপনি জ্বরে আক্রান্ত হতে পারেন। জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গেলেও আপনি আতঙ্কিত হবেন না। সব জ্বর ডেঙ্গু নাও হতে পারে। জ্বর আসলে সাথে সাথেই নিকটস্থ নির্ভরযোগ্য কোনো ডায়াগনস্টকি সেন্টারে গিয়ে এনএস১, আইজিএম এবং সিবিসি টেস্ট করিয়ে নেবেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এই তিনটি টেস্টের জন্য সর্বোচ্চর ১৪০০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। আর কোনো সরকারি হাসপাতালে গেলে কোনো টাকা লাগবে না। টেস্টে যদি ডেঙ্গু ধরা না পড়ে, তাহলে তো বেঁচেই গেলেন। তবে ডেঙ্গু হওয়া মানেই যে মরে গেলেন, তা কিন্তু নয়। ডেঙ্গু হলেও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করুন। টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে যোগাযোগ করুন ডাক্তার বা হাসপাতালের সাথে। মনে রাখবেন ডেঙ্গু হওয়া মানেই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া নয়। তবে দেরি না করে ডাক্তার বা হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে।

ডাক্তার প্রয়োজন মনে করলে আপনাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে বলবেন। নইলে পরামর্শ দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেবেন। ডেঙ্গুর প্রাথমিক চিকিৎসাটা আপনারা সবাই নিশ্চয়ই জেনে গেছেন এতদিনে। প্যারাসিটামল ছাড়া আর কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে না। সাথে প্রচুর পরিমাণ তরল খাবার খেতে হবে। তরল খাবার মানে পানি, ওরস্যালাইন, রসালো ফল, ফলের জুস, স্যুপ ইত্যাদি। আতঙ্কিত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করবেন না। কারণ হাসপাতাল মানেই কিন্তু জীবানুর কারখান। বাসায় থাকতে পারলেই ভালো। তবে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মত হলে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যাবে না। স্যালাইন দেয়া বা প্লাটিলেট দেয়ার প্রয়োজন হলে হাসপাতালে ভর্তি হতেই হবে। তবে স্যালাইন দেয়া বা প্লাটিলেট দেয়ার জন্য ডাক্তারদের ওপর চাপাচাপি করবেন না। তাদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে দিন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার আগে যেমন তেমন হওয়ার পর অবশ্যই মশারির ভেতরে থাকবেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর আপনি সবার জন্যই ঝুঁকির কারণ হয়ে যাবেন। কারণ আপনাকে কামড়ানো মশাটি ডেঙ্গুর জীবানু নিয়ে আরেকজনকে কামড় দিতে পারে।

আরেকটা সতর্কতা হলো, আপনার রক্তের গ্রুপ জেনে প্রয়োজনীয় ডোনারদের সাথে যোগাযোগ করে রাখুন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে হুট করে রক্ত লাগতে পারে। বিশেষ করে নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত যেহেতু একটু দুর্লভ, তাই আগে থেকেই প্রস্তুতি থাকা ভালো।

হাসপাতালে যদি ভর্তি হতেই হয়, তাহলে কোন হাসপাতালে ভর্তি হবেন? সামর্থ্য যাই হোক, সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করবেন। ঢাকা মেডিকলে, সোহরাওয়ার্দী, মুগদা, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাকালে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করুন। আরাম কম হবে, তবে চিকিৎসা ভালো হবে। কারণ সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা ২৪ ঘণ্টা আপনাকে দেখে রাখবে, নার্সরা ২৪ ঘণ্টাই আপনাকে সেবা দেবে। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য সবগুলো সরকারি হাসপাতালেই আলাদা কর্নার করা হয়েছে। সেখানে সঠিক নিয়ম মেনে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়।

হিসাব করে দেখা গেছে, বেসরকারি হাসপাতালের চেয়ে সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা কম। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে মুগদা জেনারেল হাসপাতালের ১০ জন ডাক্তার এবং ২০ জন নার্স ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। সরকারি হাসপাকালে ঠাঁই পাওয়া কঠিন। অগত্যা না পেলে চিকিৎসা ভালো হয়, এমন কোনো বেসরকারি হাসপাতালে যান। আরামের জন্য ফাইভ স্টার মানের তথাকথিত হাসপাতালে গিয়ে জীবন ও কষ্টার্জিত অর্থকে ঝুঁকির মুখে ফেলবেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র স্বাধীন মৃত্যুর আগে ২২ ঘণ্টা স্কয়ার হাসপাতালে ছিল। তার স্বজনদের এক লাখ ৮৭ হাজার টাকার বিল ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল।

মোদ্দা কথা হলো, এডিস মশা যেন আপনার নাগাল না পায়, সেজন্য সতর্ক থাকবেন। আর ডেঙ্গু হয়ে গেলেও আতঙ্কিত না হয়ে ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করুন। চিকিৎসা নিন, নিরাপদ থাকুন। মেয়ররা মশা মারবেন, সে আশায় বসে থাকবেন না। মশা মারার উদ্যোগ নেয়ার দরকার ছিল মার্চ মাসে, সেটা তারা করছে জুলাইয়ে। তাও হাইকোর্টের আদেশের পর। সিটি করপোরেশনের ওষুধে মশা মরে না। এখন তারা নতুন ওষুধ আনার কথা বলছেন। তারা ওষুধ আনতে আনতে ডেঙ্গুর মৌসুম ফুরিয়ে যাবে। তাই তাদের আশায় বসে না থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য নিজেদেরকেই উদ্যোগ নিতে হবে।

প্রভাষ আমিন

probhash2000@gmail.com

এ সম্পর্কিত আরও খবর