আমলাতন্ত্রে বদল আনতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু

, যুক্তিতর্ক

শেখ আদনান ফাহাদ | 2023-08-31 16:53:31

বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র এমনই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, সব ধরনের সৃজনশীল কর্ম ও পেশা বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের ছেলে-মেয়েরা প্রায় সবাই বিসিএস নিয়ে ক্রেজি হয়ে উঠেছে। সবাই স্বপ্ন দেখে সচিব হবে একদিন! সন্তানকে একজন বড় কবি, শিল্পী বা সাংবাদিক হিসেবে দেখতে চান এমন বাবা-মা সমাজে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।

আমলাতন্ত্র প্রতিনিয়ত হৃষ্টপুষ্ট হচ্ছে। আমলাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে নিয়মিতভাবে। ক্ষমতা, ক্ষমতার অপব্যবহার সবই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশ শাসক আর তাদের আজ্ঞাবহ কর্মকর্তারা সমাজের সাধারণ মানুষের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন; নিজেদের দূর আকাশের তারা বলে প্রমাণ করতেন সর্বদা। ব্রিটিশ গিয়ে আসল পাকিস্তান আমল। সেখানেও আমলাতন্ত্রের একই রূপ।

বাংলাদেশ স্বাধীন হল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ ঘোষণা করে জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের কাজে সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে আহবান জানালেন। কিন্তু বাংলাদেশ-বিরোধী অপশক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সব স্বপ্নকে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু হত্যাপরবর্তী বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী লাভবান হয়েছে আমলাতন্ত্র। এখন আমরা আমলাদের যে প্রাধান্য দেখতে পাই, বঙ্গবন্ধু থাকলে নিশ্চিতভাবেই সেটি ঘটত না, তিনি ঘটতে দিতেন না।

বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, কতটা মানবিকবোধহীন হয়েছে সেটি দেশবাসী কদিন আগেই প্রত্যক্ষ করলেন। একটি মুমূর্ষু ছেলেকে নিয়ে তাঁর মা, বোন অপেক্ষা করছে নদী পার হয়ে ঢাকার হাসপাতালে আসবে। একজন অতিরিক্ত সচিবও ঢাকায় আসবেন একই পথ দিয়ে। জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ফেরি আটকে রাখা হল তিনঘণ্টা! ছেলেটি বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স আটকে রইল। ছেলেটি মারা গেল তাঁর মা-বোনের সামনেই! সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পা ধরে কান্নাকাটি করেছে ছেলে হারানো মা, ভাই-হারানো বোন। ৯৯৯ এ ফোন দিয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত সচিব না আসা পর্যন্ত ফেরি ছাড়া হল না। 

অনেকে বলছেন, এটি আসলে হত্যাকাণ্ডের সামিল। অনেক লেখালেখির পর একটা তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। সে তদন্ত কমিটির প্রধান নাকি আবার সেই জেলা প্রশাসক! উপসচিব হয়ে অতিরিক্ত সচিবের বিষয়ে তদন্ত করলে তার ফল কী হতে পারে সেটি অনুমেয়। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এই ঘটনা জেনে কী পরিমাণ কষ্ট পেতেন সেটি ভাবা যায় না।

সংবিধানে নাকি বলা আছে, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস আর প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা মানুষের সেবক! দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠলে মহামান্য হাইকোর্ট বলেছেন, প্রেসিডেন্ট আর প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কেউ বাংলাদেশে ভিআইপি নন। হাইকোর্টের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে দেশের মানুষ।

১৯৭২ সালের  ১০ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে দেয়া ভাষণে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক রূপরেখা তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালি জাতিয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র-এ চার মূলনীতিকে সন্নিবেশিত করে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন করেন। একটি বৈষম্যহীন, সমতা-ভিত্তিক মানবতাবাদী, সুশৃঙ্খল রাষ্ট্র কায়েমের আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। একটা কৃষিনির্ভর আধা-সামন্ত সামাজিক অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের সংগ্রামকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ বলে অভিহিত করতেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাজনৈতিক মুক্তি অর্জনের সংগ্রামে সফল হয়ে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে গিয়ে জাতির জনক গোড়াপত্তন করেছিলেন ‘বাকশাল’ এর।

স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারীদের নিয়ন্ত্রণে এনে সরকারি-বেসরকারি উৎপাদন ব্যবস্থায় সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু  ‘বাংলাদেশ কৃষক, শ্রমিক, আওয়ামীলীগ (বাকশাল)।

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি তৎকালীন স্পিকার আব্দুল মালেক উকিলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদের সপ্তম অধিবেশনের দ্বিতীয় বৈঠকে ভাষণে তিনি বলেন, ‘আপনার মনে আছে যে, সংবিধান যখন পাস করা হয়, আমি বলেছিলাম যে, এই দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য শোষণহীন সমাজ-ব্যবস্থার জন্য যদি দরকার হয়, এই সংবিধানের পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করা হবে।

জাসদ-নিয়ন্ত্রিত গণবাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন-হত্যা, আওয়ামী লীগের এক শ্রেণির নেতা–কর্মী ও আমলাদের দুর্নীতি, সরকারি নানা তহবিলের তসরুফ, পাকিস্তানপন্থী সাংবাদিক ও অন্যান্য বুদ্ধিজীবী সমাজের যোগসাজশে সাংবাদিকতার নামে সরকার-বিরোধী সিস্টেম্যাটিক অপপ্রচার ইত্যাদি নানা অরাজকতার অবসান ঘটিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র ও সমাজের সর্বস্তরে শৃঙ্খলা এনে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের নিমিত্তে বঙ্গবন্ধু বাকশাল ব্যবস্থার সূচনা করেন। সংসদের ভাষণে তিনি বাকশাল সম্পর্কে আরও বলেছিলেন, ‘ অ্যামেন্ডেড কনস্টিটিউশনে যে নতুন সিস্টেমে আমরা যাচ্ছি,  তাও গণতন্ত্র। শোষিতের গণতন্ত্র। এখানে জনগণের ভোটাধিকার থাকবে। এখানে আমরা শোষিতের গণতন্ত্র রাখতে চাই’।

সংবিধান আমূল পরিবর্তন করে একটা সুষ্ঠু শাসন-ব্যবস্থা এদেশে কায়েম করতে চেয়েছিলেন জাতির পিতা। তিনি এমন একটা সমাজ ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন যেখানে মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারে, যেখানে মানুষ অত্যাচার, অবিচার হতে বাঁচতে পারে।

বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির  প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৫ সালের ১৯ জুন বঙ্গভবনে। সেখানে বাকশালের নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ্য করা রাখা ভাষণে বঙ্গবন্ধু দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘ আমাদের দেশে বহু দিনের একটা মেন্টালিটি দেখেছি। কিছু একটা নতুন জিনিস দেখলে আমাদের একটা বাধা আসে। বিপ্লব কাকে বলা হয়। পুরনো রীতি, যেটা দেশের মঙ্গল করেনা, সেই রীতি বদলানোর মত সৎ সাহস থাকা প্রয়োজন।পুরনো আইন, যে আইন দেশের মঙ্গল করেনা, সেই আইনের পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করবার অধিকার বাংলাদেশের জনগণের রয়েছে। যে সিস্টেম আজ আমরা দেখি, সেই সিস্টেম ব্রিটিশ কলোনিয়াম সিস্টেম। ব্রিটিশ সিস্টেম করে গিয়েছিল বা যেটা আমাদের দেশে চলছিল অর্থাৎ উপনিবেশবাদীরা দেশকে শোষণ করবার জন্য যে সিস্টেম দেশের এডমিনিস্ট্রেশন মধ্যে চালু করে গিয়েছিল- সেই এডমিনিস্ট্রেশন, সেই সিস্টেম, সেই আইন, সেই সব কিছু পরিবর্তন করবার নামই বিপ্লব’।...ষাটটি সাবডিভিশন হবে ৬০টি জেলা হবে। প্রত্যেক জেলার জন্য একজন গভর্নর থাকবে। সেখানে ডিস্ট্রিক্ট  ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন। তাঁর অধীনে এসপি থাকবেন। দলের প্রতিনিধিগণ থাকবেন, সংসদ সদস্যগণ থাকবেন, জনগণের প্রতিনিধিরা থাকবেন। কাউন্সিলে সরকারী কর্মচারীরাও থাকবেন। প্রত্যেক জেলায় অর্থাৎ বর্তমান মহকুমাসমূহে একটি  প্রশাসনিক কাউন্সিল থাকবে এবং তার একজন গভর্নর থাকবেন। তিনি স্থানীয়ভাবে শাসনব্যবস্থা চালাবেন।

শাসনব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। জেলা গভর্নরের কাছে যাবে আমার ওয়ার্কস প্রোগ্রামের টাকা। তার কাছে যাবে আমার খাদ্য সামগ্রী। তার কাছে যাবে আমার টেস্ট রিলিফ, লোন, বিল ও সেচ প্রকল্পের টাকা। কেন্দ্রীয় প্রশাসনের ডাইরেক্ট কন্ট্রোলে এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল ডিস্ট্রিক্ট এডমিনিস্ট্রেশন পরিচলানা করবে’’।

এক বছরের মধ্যে থানা এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল করতে হবে বলে সবাইকে নির্দেশ দিয়ে জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘সেখানে বাকশালের রিপ্রেজেন্টেটিভ, কৃষকের রিপ্রেজেন্টেটিভ থাকবে, শ্রমিক থাকবে, যুবকের থাকবে, মহিলাদের থাকবে। একজন গভর্নর থাকবেন, যিনি হবেন হেড অব এডমিনিস্ট্রেশন। সেখানে মেম্বার অব পার্লামেন্ট গভর্নর হতে পারেন। সেখানে পার্লামেন্টের মেম্বার নন, এমন পলিটিক্যাল ওয়ার্কার হতে পারেন। সেখানে সরকারী কর্মচারী-যাকে বিশ্বাস করি, তিনিও হতে পারেন’।

বাকশাল এর আইডিয়াকে বঙ্গবন্ধু আমাদের নিজেদের সমাজতন্ত্র বলে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,  ‘যে শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক  অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা আমরা বলেছি, সে অর্থনীতি আমাদের, সে ব্যবস্থা আমাদের’। জাতির পিতা প্রায়শ বলতেন, ‘আমলা নয়, মানুষ সৃষ্টি করতে হবে’। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিনি ‘আমলাতান্ত্রিক মনোভাব’ বদলানোর আহবান জানাতেন। জাতির পিতার দল আওয়ামী লীগ গত ১০ বছর ধরে টানা ক্ষমতায়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মোতাবেক কি আমলাতন্ত্রে বদল আনা হয়েছে এই সময়ে?

শেখ আদনান ফাহাদ: সহকারি অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণোগাযোগ বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এ সম্পর্কিত আরও খবর