কাবিলের কোরবানি কবুল হয়নি কেন?

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-09-01 23:09:37

মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীনের নিকট থেকে স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে মুসলিম মিল্লাতের আদি পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ:) নিজ শিশুপুত্রকে কোরবানি করার প্রচেষ্টার মাধমে ত্যাগের যে মহান শিক্ষা পৃথিবীতে রেখে গেছেন সেটিই আজ মুসলিমদের বড় ধর্মীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। হযরত ইব্রাহীম (আ:) মহান আল্লাহ্ তায়ালার সস্তুষ্টি লাভের আশায় এক কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে অত্যন্ত সফলভাবে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, যা পবিত্র কোরআন শরীফে বিধৃত হয়েছে (সুরা আল-মায়েদা ২৭-৩১)। মাত্র এগার বছর বয়সী নিজ শিশুপুত্র হযরত ঈসমাইল (আ:)-কে আলালাহ্র রাহে উৎসর্গ করার জন্য তিনি যখন বার বার ছুরি চালিয়েও ব্যর্থ হন তখন মহান আল্লাহ্র নির্দেশে হযরত জিবরিল (আ:) বেহেস্ত থেকে সেখানে একটি দুম্বা এনে প্রতিস্থাপন করলে সেটি কোরবানি হয়ে যায়।

কিন্তু কোরবানি অর্থ শুধু পশু কোরবানি করা নয়। এর ইতিহাস, রহস্য ও মাহাত্ম্য আরো সুপ্রাচীন। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীন পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন মুসলিম মিল্লাতের সবচে’ আদি পিতা-মাতা হযরত আদম (আ:) ও হযরত হাওয়াকে সৃষ্টি করে বেহেস্তÍ থেকে পৃথিবীতে প্রেরণের মাধ্যমে। হযরত আদম-হাওয়ার সময় জমজ সন্তান পৃথিবীতে জন্ম নিত। প্রতিবারের গর্ভে একজন ছেলে ও একজন মেয়ে জন্মলাভ করত। সর্বপ্রথম হযরত কাবিল ও হযরত ইকলিমা (মা.এ.মাজিদ ২০১৮) এ পৃথিবীতে জন্ম নেন। পরবর্তীতে হযরত হাওয়ার গর্ভে জন্ম নেন হযরত হাবিল ও হযরত লুসা। ছেলে দু’জনের নাম পবিত্র কোরআনে উল্লেখ থাকলেও মেয়ে দু’জনের নাম অন্যান্য গবেষণামূলক বিভিন্ন বর্ণনায় খুঁজে পাওয়া যায়। সন্তানদের বিয়ের ব্যাপারে নিয়ম ছিল প্রথমবারের গর্ভে জন্ম নেয়া সন্তানের সাথে পরবর্তী গর্ভে জন্ম নেয়া সন্তানের বিয়ে হবে। অর্থাৎ জমজ ভাইবোনদের নিজেদের মধ্যে বিয়ে হবে না। এখানেও একটি বৈজ্ঞানিক রহস্য লুক্কায়িত ছিল। কিন্তু কাবিল সেটা মানতে চাননি। ইকলিমা ছিলেন বেশী সুন্দরী তাই কাবিল তাকেই বিয়ে করতে আগ্রহী ছিলেন। এই বিষয়টি নিয়ে হাবিল-কাবিল দু’ভাইয়ের মধ্যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হলে হযরত আদম (আ:) দু’ভাইকে একটি শর্ত দিয়ে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে নির্দেশ দেন। তা হলো তাদেরকে নিজ নিজ উপার্জিত সম্পদ মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীনের নিকট উৎসর্গ বা কোরবানি করে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভ করা।

হযরত আদম (আ:) তার সন্তান কাবিল-হাবিল দু’ভাইকে নির্দেশ দিলেন তোমরা তোমাদের সবচে’ মূল্যবান ও প্রিয় জিনিষগুলো মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীনের নিকট কোরবানি করো। কাবিল-হাবিল দু’ভাইয়ের মধ্যে প্রতিযেগিতা চললো। হাবিল তাঁর বাবা-মায়ের প্রতি বিনয়ী ও অনুরক্ত ছিলেন। তিনি পশুপালন করতেন। অন্যদিকে কাবিল ছিলেন কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল ও অবাধ্য। তিনি কাঠ, ফলমূল সংগ্রহ করতেন। হাবিল তাঁর পশুদের মধ্যে সবচে’ হৃষ্টপুষ্ট পশুটি মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীনের প্রতি কোরবানি করলেও কাবিল তার সংগৃহীত নিকৃষ্ট মানের সামগ্রী উৎসর্গের জন্য পাহাড়ের চূড়ায় রেখে আসেন।

হযরত হাবিলের উৎসর্গের মধ্যে একটা শ্রদ্ধাবোধ ছিল, আনুগত্য ছিল। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীনের নৈকট্য লাভের বাসনা ছিল। সর্বোপরী বাবা-মা তথা হযরত আদম ও হযরত হাওয়া (আ:)-এর বাধ্যগত হয়ে নির্দেশ পালনের দায়িত্ববোধ ছিল। তাই তাঁর কোরবানি মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীনের দরবারে কবুল হয়ে যায় (ডেইলী ওয়াক ১৮. ০৪. ২০১৮)।

অন্যদিকে কাবিলের মধ্যে ঔদ্ধত্য, উচ্ছৃংখলতা ও বাবা-মায়ের এবং নিজ দায়িত্বপালনে হেঁয়ালিপনা অবাধ্যতা তার কোরবানিকে নষ্ট করে দেয়। তাই তাঁর কোরবানি মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীনের দরবারে কবুল হয়নি। অধিকন্তু, পরবর্তীতে সে শয়তানের নির্দেশ অনুসরণ করে এক সময় ছোটভাই হাবিলকে হত্যা করে। এই ধর্মীয়-ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষিত পবিত্র কোরআন শরীফে উল্লেখ থাকায় একজন নিবেদিত মুসলিমের নিকট তা কম-বেশী জানা রয়েছে বলে আমি মনে করি। তবে এর কিছু শিক্ষণীয় বিষয় আমাদেরকে মনে রাখতে হবে। তাহলে আমাদের মহান ত্যাগ ও নিজ নিজ কষ্টার্জিত কোরবানি সফল হতে পারে।

আসন্ন ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে আমাদের মধ্যে যে ধর্মীয় বিশ^াস ও চেতনা কাজ করে সেটিকে নিষ্কলুষ ও পবিত্রভাবে সাফল্যমন্ডিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব হওয়া উচিত। কারণ কোরবানির উদ্দেশ্য শুধু পশু জবাই করে গোসত ভক্ষণ করে রসনা তৃপ্তি করা নয়।

আমাদের উৎসর্গের নিয়ত করতে হবে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীনের সন্তুষ্টি লাভের জন্য। এজন্য সর্বপ্রথম  উৎসর্গের নিয়তের বিশুদ্ধতা থাকতে হবে।

নিজের কাছে যেটা সবচে’ মূল্যবান, সবচে’ ভাল, উৎকৃষ্ট ও পছন্দের মনে হবে সেই পছন্দসই জিনিষটিকে মহান আল্ল্হার নামে কোরবানি দিতে হবে।

আজকাল প্রতারণার মাধ্যমে স্টেরয়েডযুক্ত ইনজেকশন ও বিষাক্ত ও ভেজাল খাবার খাইয়ে পশুর দেহ ফুলিয়ে চকচকে করে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। কোন কোন পশু ওষুধের প্রভাবে বোধশক্তিহীন, নিজের দেহের ভারে হাঁটতেই অক্ষম। পশুর দামের মধ্যেও দেশের সিংহভাগ মানুষের আয় ও ক্রয়-ক্ষমতার সাথে সামঞ্জস্য নেই। যারা লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে অহমিকা দেখিয়ে পশু কিনে ছবি তুলে প্রচার করছেন তাদেরকেও অর্থের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে সজাগ থেকে কাজটি করতে হবে বৈ কি?

সব মুমিন মুসলমানকে ভাবতে হবে মহান আল্লাহ্ তায়ালার নিকট কোরবানিকৃত পশুর রক্ত, মাংস, পশম কিছুই পৌঁছায় না- পৌঁছায় সৎ নিয়ত ও তাক্কওয়া। লোভ, হিংসা ও ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে কাবিলের কোরবানি যেমন বৃথা হয়ে গিয়েছিল আমরা তেমনভাবে আমাদের কর্ষ্টাজিত কোরবানিকে বৃথা যেতে দিতে পারি না। আমরা সবাই কোরবানির মাধ্যমে দেহ-মনের তথা পঞ্চইন্দিয়ের পশুত্বকে বিনাশ করে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীনের সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভে সজাগ থাকি- এবারের ঈদুল আযহায় এই কামনা।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

এ সম্পর্কিত আরও খবর