বিদায় শেলী স্যার

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ , কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-08-28 12:41:28

ষাটের দশকে স্বল্প সময়ের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার করার সুবাদে তিনি ছিলেন আমাদের শিক্ষকদের শিক্ষক। আমাদের অনেক শিক্ষকের মুখেই শুনেছি তাদের প্রিয় শেলী স্যারের গুণগান। মীজানুর রহমান শেলী স্যার বলতে তারা ছিলেন অজ্ঞান।

শেলী স্যার নামে আরেক জন সুপরিচিত ছিলেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নের সময়ে। একদা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুবাদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান তার ডাকনাম শেলী স্যার নামে পরিচিত মহলে আলোচিত হতেন। উভয় শেলী স্যার ছিলেন আমাদের উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র।

তুখোড় মেধাবী, পণ্ডিত, বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় সমান পারদর্শী, একাডেমিক নৈপুণ্যের পাশাপাশি সাহিত্যিক প্রতিভার কারণে ড. মীজানুর রহমান শেলী তার সমকালের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অগ্রগণ্য রূপে বিবেচিত হতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ও মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। ১৯৬৪ সালে স্বল্প সময়ের জন্য সে বিভাগে শিক্ষকতায় যোগ দিয়েও তিনি রেখেছিলেন কৃতিত্বের স্বাক্ষর।

সে আমলের রেওয়াজ ছিল এমন যে, শ্রেষ্ঠ ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় যোগদান করলেও কিছুদিনের মধ্যেই তারা সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে সিএসপি হয়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের আমলাতন্ত্রের সদস্য হতেন। পাকিস্তান আমলে একাধিক কৃতি ছাত্র ও সম্ভাবনাময় শিক্ষক আমলা জীবন বেছে নিয়েছিলেন। শেলী স্যার তাদেরই একজন।

আশার কথা হলো, আমলা হলেও তিনি শিক্ষক সুলভ পাঠপ্রক্রিয়া ত্যাগ করেন নি। স্নায়ুযুদ্ধকালীন বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে ইংল্যান্ডের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্র অর্জন করেছিলেন। অনেক পরে, অবসর জীবনে গবেষণাতে ব্যাপ্ত থেকে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। স্বাধীন থিংক ট্যাংক ও গবেষণা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে এশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীক্ষা ও চর্চায় ব্যাপৃত থাকেন। প্রকাশ করেন আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত ও সমাদৃত একাডেমিক জার্নাল। তিনি ছিলেন একাডেমিক পাবলিশার্স নামক প্রকাশনা সংস্থার পৃষ্ঠপোষক।

সরকারি কর্মকর্তা পিতা মাহফুজুর রহমানের বদলির চাকরির কারণে শেলী স্যার বেড়ে উঠেন বিভিন্ন স্থানে। ঢাকার গ্রিন রোডে ছিল তাদের পৈত্রিক বাড়ি আর আদি বাড়ি ছিল বিক্রমপুর অঞ্চলে। মজার ব্যাপার হলো শেলী স্যারের অন্য ভাইদের ডাকনামগুলো ছিল পাশ্চাত্যের বিখ্যাত কবি, দার্শনিক, পণ্ডিতদের নামে। তার এক ভাইয়ের নাম ছিলো রুশো। ইংরেজি কাগজে সাংবাদিকতা করতেন তিনি। এখন প্রয়াত।

অকৃত্রিম বন্ধুবাৎসল্য ও স্নেহপ্রবণতার গুণ ছিল শেলী স্যারের। আর ছিল বহুমাত্রিক মেধার বিকিরণ। বাগ্মিতায় তিনি ছিলেন সেরা। ধানমণ্ডির অফিসে গেলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কথা শোনার সুযোগ পেয়ে আমরা ধন্য ও ঋদ্ধ হয়েছি। একাডেমিক কোনও কাজে বা আলোচনায় তিনি উদারভাবে দিতে জানতেন। টক শো ও বিভিন্ন সেমিনারেও তিনি স্বকীয় ঔজ্জ্বল্যে সবাইকে বিমোহিত করতেন।

পেশা জীবনের শীর্ষ স্তরে আরোহণ করেছিলেন তিনি তার মেধা ও কৃতিত্বে। হয়েছিলেন বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী। সরকারের সচিব। রাজনীতি বিশ্লেষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক হিসাবেও তিনি উজ্জ্বল।

৭৬ বছর বয়সে সোমবার (১২ আগস্ট) ঈদুল আজহার দিনের বিকেল বেলা শেলী স্যার ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

রাজধানীর শমরিতা হাসপাতালের মরচুয়ারিতে তার মরদেহ রাখা হবে। বিদেশে অবস্থানরত তার ছেলে দেশে ফেরার পর আজিমপুর কবরস্থানে মরদেহ দাফন করা হবে।

শেষ দিকে তিনি প্রায়ই অসুস্থতায় ভুগেছেন। এর আগে, গত ২৫ জুন অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি।

বেসরকারি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ বাংলাদেশ-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং এশিয়ান অ্যাফেয়ার্স-এর সম্পাদক, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান উভয় দেশের সরকারি আমলা, মন্ত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক, অনন্য মেধাবী এবং কৃতিত্বপূর্ণ পেশা ও কর্মজীবনে সর্বোচ্চ সফলতা প্রাপ্ত শেলী স্যারকে বিদায় জানানো হলেও তিনি তার বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্বের আভায় আলোকিত হয়ে থাকবেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর