বঙ্গবন্ধুর যে আওয়াজ গণমাধ্যমের কানে আজও পৌঁছেনি

, যুক্তিতর্ক

ফরহাদুজ্জামান ফারুক | 2023-08-28 17:57:18

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ১৪ বছর ১৭ দিনের মাথায় আমার জন্ম। আমি এক হতভাগা বাংলাদেশি। জন্মের পর দেখতে পাইনি আমার মাতৃভূমির জনককে। যার জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। স্বাধীনতার সেই স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার। শুধু শুনেছি মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত অপশক্তির তোষামতকারী  ক্ষমতালোভী  ঘাতকরা  তাঁকে বাঁচতে দেয় নি। সেই ঘাতকরা সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা তথা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দর্শন বিশ্বাস করতেন না।

বাংলাদেশ নামক শিশু রাষ্ট্রের ৪ বছর পূর্ণ না হতেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির সিড়ি বেয়ে পিতার বুক ছিঁড়ে নেমে আসা রক্তের ললাটে ভিজেছে লাল-সবুজ পতাকা। আমি সেই পতাকা দেখেছি। যেখানে জাতির পিতার মুখবয় দেখতে পাই। শুনতে পাই ৭ মার্চ এর সেই ঐতিহাসিক শব্দ উচ্চারণের আওয়াজ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রামের আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

প্রাইমারির গণ্ডি পেরুনোর আগ থেকেই বঙ্গবন্ধুর নাম আর ভাষণ শুনেছি। আমার বাবা ছোট্ট বেলা থেকেই অবসর সময়ে আমাদের পরিবারের সবাইকে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের তার স্মৃতিবিজড়িত দিনগুলোর কথা শোনাতেন। এখনও সময় হলেই বাবার কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে জানার চেষ্টা করি। সঙ্গে অবসর পেলেই বইয়ের পাতায় খুঁজি ইতিহাসের মহানায়ককে। তাকে নিয়ে জানার শেষ নেই।

আমি তো জানতাম, বঙ্গবন্ধু মানে মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে জেনেছি পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীসহ তাদের হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুর নির্মমতা, নির্যাতন, নিপীড়ন আর শোষণের ইতিহাস। শুনেছি স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠে উচ্চারিত ৭ মার্চ এর বিশ্বজয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের গীতিবাক্য। আসলে শৈশব বয়স থেকে বঙ্গবন্ধু বলতে শুধুই ৭ মার্চের ভাষণটাই আমার কানে বেজেছে। তার অন্য কোন বক্তব্য বা উচ্চারণ সেভাবে শোনা হয়নি।

সাংবাদিকতা পেশায় জড়িয়ে পড়ার পর থেকে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন সংগ্রাম আর বিপ্লবী উচ্চারণ নিয়ে কিছুটা জানার সুযোগ হয়েছে । বঙ্গবন্ধুর সাথে গণমাধ্যম কর্মীদের যে সখ্যতা ছিলো তাও জেনেছি বই পড়ে।

বই থেকে জানলাম, আজ থেকে ৪৭ বছর আগে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রথম বার্ষিক সাধারণ সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘আপনারা সাংবাদিক। আপনাদের স্বার্থরক্ষা করতে হলে আপনারা নিজেরাও আত্মসমালোচনা করুন। আপনারা শিক্ষিত, আপনারা লেখক, আপনারা ভালো মানুষ। আপনারাই বলুন, কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ। গণতন্ত্রের একটা নীতিমালা আছে। সাংবাদিকতারও একটা নীতিমালা আছে। এ দুটো মনে রাখলে আমরা অনেক সমস্যা সমাধান করতে পারব।’

১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই জাতীয় প্রেসক্লাবে জাতির জনকের দেয়া দীর্ঘ বক্তৃতার শেষাংশের কথাগুলো আমার খুব বেশি স্মরণ হয়। আমরা গণতন্ত্রের নীতিমালা, সাংবাদিকতার নীতিমালা নিয়ে কথা বলি, অথচ নিজেরাই মানতে চাই না। আর এজন্যই সমস্যা আমাদের পিছু হটছে না।

৪৭ বছর আগে দালাল সাংবাদিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের সাংবাদিক সমাজকে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। অথচ আজও দালাল সাংবাদিকতা বন্ধ হয়নি। সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমরা গণতন্ত্র চাই, কিন্তু উচ্ছৃঙ্খলতা চাই না, কারও বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি করতেও চাই না। অথচ কোন কাগজে লেখা হয়েছে-‘‘মুসলমানকে রক্ষা করার জন্য সংঘবদ্ধ হও’’। যে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আমার দেশের মানুষ রক্ত দিয়েছে, এখানে বসে কেউ যদি তার বীজ বপন করতে চান, তাহলে তা কী আপনারা সহ্য করবেন? আপনাদের যে কোন কথা বলবার অধিকার আছে। কিন্তু আপনাদের একটা নীতিমালাও রয়েছে।’

নীতিমালার বাস্তবায়ন ও চর্চা না থাকায় আমাদের সাংবাদিকতার আদর্শ কি হবে তা নিয়েও দ্বি-মতের দ্বন্দ্ব লেগে আছে। যা ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভায় এসে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘আপনারা (সাংবাদিকরা) খবরের কাগজের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা-এই চারটি আদর্শের ভিত্তিতে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছি এবং এইসব আদর্শের ভিত্তিতেই রাষ্ট্র পরিচালিত হবে, এটাও আপনারা (সাংবাদিকরা) বিশ্বাস করেন।’

আজ বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪৮ বছরে দাঁড়িয়ে আমরা গণতন্ত্র আর সাংবাদিকতায় নীতিমালার প্রতিফলন বা চর্চা কোনটাই আশানুরূপ দেখতে পাওয়া যায়নি। মনে হয়, জাতির জনকের ৭২’র সেই আওয়াজ আজও পুরোপুরি গণমাধ্যমের কানে পৌঁছেনি। যে কারণে ধর্ম নিরপেক্ষতার বিপরীতে বারবার সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠার চেষ্টা করে। এই অপশক্তির বিনাসে আমাদেরকে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে হবে । যেখানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সাথে মিলে যাবে আমাদের সবার স্বপ্ন। তবেই গণমাধ্যম কর্মীদের আলোর প্রজ্জ্বলন থেকে বইতে শুরু হবে সুবাতাস। আসবে সোলানী দিন। হাসবে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।

লেখক: স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, রংপুর।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর