নীতির রাজার বিদায়

, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-28 23:03:52

আমার গ্রামের বাড়ি দাউদকান্দি। দেবীদ্বার আমার পাশের উপজেলা, যেটি ছিল অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের নির্বাচনী এলাকা। তাই ন্যাপ, মোজাফফর, কুঁড়েঘর শব্দগুলোর ঢেউ দেবীদ্বার থেকে দাউদকান্দিতে আমাদের কানে পৌছে যেতো অনায়াসে। ৭৩এর নির্বাচনের স্মৃতি তেমন নেই। শুধু মনে আছে জাসদের বেশ দাপট ছিল। পরে জেনেছি, দাউদকান্দিতে জাসদের রশিদ ইঞ্জিনিয়ারকে হারিয়ে খন্দকার মোশতাককে জেতাতে হেলিকপ্টারে ব্যালট বাক্স ঢাকায় নিতে হয়েছিল। যা বলছিলাম, আমাদের স্মৃতির প্রথম নির্বাচন ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন। ১০ বছর বয়সে অতকিছু বুঝিনি, খালি বুঝেছি, নির্বাচন মানেই স্লোগান, মিছিল, আনন্দ। তো সেই নির্বাচনে নিজের এলাকা ছাপিয়ে পাশের এলাকার কিছু স্লোগান এখনও কানে গেঁথে আছে। হয়তো ছন্দময়তার জন্য, তবে ভুলিনি এখনো- আমার নাম মোজাফফর, মার্কা আমার কুঁড়েঘর; আমার নাম মোজাফফর আহমেদ নুরী, আমি পথে পথে ঘুরি; মোজাফফরের কুঁড়েঘর, ভাইঙ্গা-চুইড়া নৌকাত ভর। এরকম মোজাফফরের পক্ষে-বিপক্ষের নানা স্লোগান কানে আসতো, আসতো নানা গল্পও। ৭৫'র আগ পর্যন্ত আমাদের অঞ্চলে সবচেয়ে বড় জাতীয় নেতা ছিল খন্দকার মোশতাক। এই কুলাঙ্গারের পতনের পর সবচেয়ে কাছের জাতীয় নেতা হলেন মোজাফফর আহমেদ। তখনও দেখিনি, কিন্তু নানান অবিশ্বাস্য গল্প কানে আসে। বিশাল বড় নেতা, কিন্তু একদম মাটির মানুষ। মার্কা যেমন কুঁড়েঘর, মানুষও তেমনি কুঁড়েঘরেরই। মানুষের সাথে মিশে যাচ্ছেন, তাদের মত করে। তাদের ভাষায় কথা বলছেন। লুঙ্গি পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ১৯৭৯ সালের সাজানো একতরফা নির্বাচনে ধানের শীষের জোয়ারও মোজাফফরের কুঁড়েঘরকে ভাসিয়ে নিতে পারেনি। ১৯৮১ সালে ন্যাপ-সিপিবির প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন কুঁড়েঘরের মোজাফফর। জিয়াউর রহমানকে জেতাতে আয়োজিত সে নির্বাচনে অন্য কারো জেতার সুযোগই ছিল না।

আমাদের পাশের বাড়ির নেতা হলেও পরে বুঝেছি তিনি দেবীদ্বার বা কুমিল্লা বা বাংলাদেশের নেতা নন; বিশ্বের বাম আন্দোলনেও তার নাম লেখা আছে। ছেলেবেলা থেকে নাম, স্লোগান, নানান গল্প শুনলেও অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদকে প্রথম দেখি ১৯৯১ সালে। তখন আমরা প্রিয় প্রজন্ম নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করতাম। ফজলুল বারী সম্পাদিত সে পত্রিকার অফিস ছিল ৭৬ সেগুনবাগিচায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দক্ষিণ পাশে। আর অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের বাসা ছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উত্তর পাশে কাকরাইলে। তিনি প্রায়শই সকালে লুঙ্গি পড়ে আমাদের অফিসে চলে আসতেন, একসাথে অনেক পত্রিকা পড়ার আকাঙ্খায়। তিনি পত্রিকা পড়তেন, আর আমরা তাঁর গল্প শুনতাম। ছেলেবেলায় তাঁর সম্পর্কে যা যা শুনেছি, তার একবিন্দুও মিথ্যা নয়। সেই কুঁড়েঘরের মাটির মানুষ। কুমিল্লার আঞ্চলিক টানে কথা বলছেন, বকা দিচ্ছেন। আমরা জানতাম রোদ চড়লে তাঁর মেজাজও চড়ে যায়।

আমাদের কাছে মনে হয় অতি কাছের জন, কিন্তু তিনি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ; ইতিহাসের সাক্ষি নন, তিনি নিজেই ইতিহাস। শুধু বাংলাদেশ নয়, এই উপমহাদেশের বাম আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, মুজিবনগর সরকারের ৬ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদের একজন, ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়ন গেরিলা বাহিনীর সংগঠক, একাত্তরে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন দেশ, প্রতিনিধিত্ব করেছেন জাতিসংঘে, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন, ভিন্ন দলের হলেও বঙ্গবন্ধু যাকে মন্ত্রী করতে চেয়েছিলেন; সেই অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ পত্রিকা পড়তে আমাদের অফিসে আসেন! নিজেদের ভাগ্যকে ঈর্ষা করার মত ম্যাচুরিটি তখনও হয়তো হয়নি আমাদের।

১৯৩৭ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে চান্দিনায় মহাত্মা গান্ধীর জনসভায় যোগ দিতে গিয়ে রাজনীতিতে হাতেখড়ি। তারপর মৃত্যু পর্যন্ত রাজনীতির লাঠি আর ছাড়েননি। বরং রাজনীতি করবেন বলে ছেড়েছেন অনেককিছু, এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার মত নিশ্চিন্তের চাকরিও। বরং বেছে নিয়েছেন মামলা, হুলিয়া, আত্মগোপন আর কারাবরণের ঝুঁকি। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ- ২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রামেও ছিলেন মোজাফফর।

৫৪এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ৩২ বছরের টগবগে তরুণ মোজাফফর তখনকার মুসলিম লীগের শিক্ষামন্ত্রী মফিজুল ইসলামকে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি ছিলেন মাওলানা ভাসানীর অনুসারী। কিন্তু ৬৭ সালে আদর্শের প্রশ্নে দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে বেকে যায়। ভাসানীর নেতৃত্বে রয়ে যায় চীনপন্থি বামরা। আর মস্কোপন্থিদের নেতৃত্ব দেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ। সেই থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনিই ন্যাপ'এর সভাপতি। আপনি তার অনেক কাজের সমালোচনা করতে পারবেন। কেন তিনি ৫২ বছর ধরে একটি দলের সভাপতি, ধর্ম-কর্ম-সমাজতন্ত্র আসলে এক ধরনের বিভ্রান্তি, সমাজতন্ত্রকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌছাতে পারেননি কেন? স্বাধীনতার পর ন্যাপ-সিপিবি কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকা রাখতে পারেনি বলেই উগ্র জাসদ আর প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সেই জায়গাটা  পূরণ করে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করেছিল। এই সব প্রশ্ন-অভিযোগ আপনি তুলতেই পারেন। সাংগঠনিক ভাবে অনেক প্রশ্ন থাকলেও ব্যক্তি অধ্যাপক মোজাফফরের বিরুদ্ধে কেউ কখনো কোনো অভিযোগের আঙ্গুল তুলতে পারেনি। তাঁর সততা, নিষ্ঠা, আদর্শের প্রতি একাগ্রতার কোনো তুলনা নেই। তিনি আদর্শের সাথে একচুলও আপস করেননি। বিশ্বাস থেকে নড়েননি এক ইঞ্চিও। তার অনেক কমরেড যখন নামের আগে আলহাজ্ব বসিয়ে নেন, তখনও তিনি বামপন্থায় অবিচল। আপস না করে, লোভের উর্ধ্বে থেকেও যে এই বাংলাদেশে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাজনীতি করা যায়, তার উদাহরণ হয়ে থাকবেন মোজাফফর আহমেদ। এখনকার রাজনীতিবিদদের দেখলে মনে হয়, রাজনীতি মানে রাজা হওয়ার নীতি। আর অধ্যাপক মোজাফফরদের দেখলে মনে হয়, রাজনীতি আসলে নীতির রাজা। মন্ত্রিত্ব যার সম্মতির অপেক্ষায় ফিরে যায়, সেই তিনি শেষ বয়সে স্বাধীনতা পদকও ফিরিয়ে দেন, কারণ পদকের জন্য বা কিছু পাওয়ার আশায় মুক্তিযুদ্ধ করেননি। মন্ত্রিত্ব ফিরিয়ে দেয়া, পদক ফিরিয়ে এমন সন্তপুরুষ রাজনীতি আর কখনো পাবে?

অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের একটা যুগের অবসান ঘটলো। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া সর্বশেষ জাতীয় নেতা ছিলেন তিনি। তার স্মৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। আমাদের এখনকার রাজনীতিবিদরা যদি অধ্যাপক মোজাফফরের জীবন থেকে কিছু শেখেন, জাতির বড্ড উপকার হয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর