‘ঘানা’! ‘সিউল’!! ও ‘ডেঙ্গু’!!!

, যুক্তিতর্ক

চৌধুরী মুফাদ আহমদ | 2023-09-01 20:28:14

আরবরা ‘প’ ধ্বনি  উচ্চারণ করতে পারে না বলে পাকিস্তানকে বলে ‘বাকিস্তান’, পেপসিকে বলে ‘বেবসি’। অনেক দেশের লোকই ‘ট’ এর উচ্চারণ করে ‘ত’। হোয়াট কে বলে ‘হোয়াত’?  ইংরেজরা অনেক মহাপ্রাণ ধ্বনি (যেমন খ, ঘ, ছ, ঝ) ইত্যাদি উচ্চারণ করতে পারে না। তাই ঠাকুরকে ওরা বানালো ‘টেগোর’! জাপানিদের ‘ল’ ধ্বনি ‘ল’ এবং ‘র’ এর মাঝামঝি কিছু। তাই তারা রাইস বললে শোনায় ‘লাইস’ আর বেলুন বললে শোনায় ‘বেবুন’! চৈনিকদের সমস্যা হয় ‘র’ উচ্চারণ করতে। এ ধরণের উচ্চারণ বিভ্রাট ঘটে বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর কোনো কোনো ধ্বনি সৃষ্টির সীমাবদ্ধতার জন্য।

আমরা এদিক দিয়ে খুবই ভাগ্যবান। কারণ, আমাদের ধ্বনি ভাণ্ডার যথেষ্ট সমৃদ্ধ। তাছাড়া আমাদের বর্ণমালা ধ্বনি অনুসারী। আমরা যা লিখি তা বলতে গেলে প্রায় সবসময় একইভাবে উচ্চারণ করি। ইংরেজি p-u-t ‘পুট’ এবং b-u-t ‘বাট’ এর সমস্যা আমাদের নেই।

ইংরেজি ভাষার প্রায় প্রতিটি বর্ণ ও শব্দের উচ্চারণ আমরা বাংলায় লিখতে পারি। কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতিটি শব্দ ইংরেজিতে লেখা সম্ভব নয়। যেমন- খ, ঘ, ঠ ইত্যাদি ধ্বনির অনুরূপ ধ্বনি ইংরেজিতে নেই। তাই তাদের হালকা ধ্বনি র পেছনে h বসিয়ে আমরা সেটাকে ভারী করি এবং kh কে খ, gh কে গ, jh কে ঝ বানিয়ে কাজ চালাই।

এরকম বেশ কিছু ভারতীয় শব্দ ইংরেজি ভাষায় ঢুকেও গেছে। যেমন, ghat, dhoti, ghee, lathi এর মতো শব্দ ইংরেজি অভিধানে পাওয়া যায়। কিন্তু শব্দের উচ্চারণ ঘাট নয় গাট, ধুতি নয় ডোটি, ঘি নয় গি, লাঠি নয় লাটি !

তার মানে আমাদের শব্দ ইংরেজি ভাষায় ঢুকে গেলেও আমাদের মতো উচ্চারণ হচ্ছে না। ‘জগন্নাথ’-ও এখন ইংরেজি ভাষার শব্দ। কিন্তু কোনো ইংরেজের মুখে তার উচ্চারণ শুনলে পিলে চমকাবে। এতক্ষণ যা বললাম তা এখন যা বলতে চাই তার গৌরচন্দ্রিকা।

২.

সম্প্রতি আমি একটি বিষয়ে দুটি লেখা লিখেছিলাম। লেখা দুটির একটি অনলাইন পত্রিকায় এবং অপরটি একটি মাসিক পত্রিকায় বেরোয়। দুটি ক্ষেত্রেই আমি পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গানার নাম লিখেছিলাম ‘গানা’। কিন্তু লেখা প্রকাশ হওয়ার পর দেখি উভয় লেখায়ই ‘গানা’ ‘ঘানা’ হয়ে গেছে। কারণ আমার বানান ‘সংশোধন’ করা হয়েছে। গানার এই ঘানায় পরিণত হওয়ার কারণ আর কিছু নয়, কারণ এর বানান। GHANA-এর GH-কে আমরা বাংলা বর্ণমালার ‘ঘ’ ধরে নিয়েছি। যেভাবে অনেকে GHOST কে উচ্চারণ করেন ‘ঘোস্ট’। উভয় ক্ষেত্রেই এবং সম্ভবত ইংরেজি সকল শব্দের ক্ষেত্রে এর GH-এর উচ্চারণ হবে ‘গ’, কখনই ‘ঘ’ নয়।

মনে পড়ছে বহু বছর আগে আমার এক সহপাঠিনি ফ্লোরেন্স অকু-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তোমার দেশের নাম তোমরা কীভাবে উচ্চারণ করো বলোতো?’ সে বলেছিলো ‘গানা’। আমি আবার ‘গানা’ না ‘ঘানা’ জিজ্ঞেস করলে সে বলেছিল, ‘ইট ইজ গানা, গানা, গানা’।

এই লেখা তৈরি করার আগে আবার নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমার এক দক্ষিণ কোরিয়ান সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমাদের রাজধানীর নাম তোমরা কীভাবে উচ্চারণ করো?’ সে বললো, ‘সউল’। তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কিন্তু তোমাদের দেশে ‘সিউল’ না কি যেন বলে।’ Seuol কে আমরা সারা জীবন আমাদের স্টাইলে পড়েছি ও ভুল উচ্চারণ করে এসেছি। ইংরেজি শব্দ থেকে আমাদের নিয়মে উচ্চারণ করে লেখার কারণে আমরা এই শব্দটি ভুলভাবে বাংলায় লিখে এসেছি।

কিন্তু বৈশ্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থার চরম উৎকর্ষতার এই যুগে কোনো স্থান বা ব্যক্তির নামের সঠিক উচ্চারণ শুনে নেয়া মোটেই কঠিন নয় এবং সঠিকভাবে না লেখা মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়।

কেউ কেউ বলতে পারেন আরবরা যদি পাকিস্তানকে ‘বাকিস্তান’ বলতে পারে তবে আমরা ‘ঘানা’ বললে দোষ কি। দোষ আছে বৈকি! আরবি বর্ণমালায় কোনো ‘প’ ধ্বনি  নেই। তাই তাদের কাছাকাছি কিছু দিয়ে কাজ চালানো ছাড়া উপায় নেই। আমরাও এরকম করে থাকি। যেমন গানার স্বাধীনতা আন্দোলনের বিখ্যাত নেতার নাম বাংলায় আমরা লিখি নক্রুমা। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তার নামের প্রথমে এমন একটি আফ্রিকান বর্ণ আছে যার উচ্চারণ আমাদের ‘ঙ’ এর মতো। আমরা শব্দের প্রথেম ‘ঙ’ দিয়ে কিছু উচ্চারণ করতে পারি না বলে ‘ন’ দিয়ে কাজ চালাই। তাই ধ্বনিগত সীমাবদ্ধতার জন্য কোনো ইংরেজ ‘ঢাকা’কে ‘ডাকা’ বললে সেটা মেনে নেয়া যায়।

কিন্তু কাউকে বাংলাদেশকে ‘বেংলাদেশ’ বা পাঞ্জাবকে ‘পুঞ্জাব’ বলতে শুনলে মেজাজ খারাপ হওয়া সঙ্গত। অনুরূপভাবে আমাদের ভাষায় সেই আফ্রিকান ধ্বনিটি নেই বলে নক্রুমার নাম অমরা একটু অন্যরকম লিখতে পারি কিন্তু তার দেশের নাম ভুল লেখার পক্ষে যুক্তি নেই।

৩.

প্রসঙ্গত আরেকটি শব্দের কথা বলে শেষ করবো।

এডিস মশা দ্বারা ছড়ানো নানা রোগ ও সেগুলো থেকে বাঁচার বিভিন্ন উপায় সম্পর্কে এক বক্তা বক্তৃতা করছিলেন। কখনও কথা বলছেন বাংলায় কখনো বা ইংরেজিতে। এক পর্যায়ে একজন তাকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি ইংরেজিতে বলার সময় বলছেন ‘ডেঙ্গি’ কিন্তু বাংলায় বলার সময় বলছেন ‘ডেঙ্গু’! কোনটা সঠিক?” বক্তা ঝানু লোক। জবাবে বললেন, “বাংলায় বললে বলবেন ‘ডেঙ্গু’ কিন্তু ইংরেজিতে বললে বলবেন ‘ডেঙ্গি’।”

আসলে এই রোগের ইংরেজি বানানটাই সকল অনিষ্টের মূল। Dengue শব্দটি সম্ভবত আফ্রিকার বা ওয়েস্ট ইন্ডিজ এর কোনো ভাষা থেকে স্প্যানিশ ভাষায় গৃহীত হয়। এর উচ্চারণ ‘ডেঙ্গি’। যে সকল শব্দের শেষে ‘gue’ আছে সেগুলোর উচ্চারণ নিয়ে আমাদের সমস্যা হয়ে থাকে। যে কারণে রসিকতা করে ‘fatigue’ কে ‘ফেটিগু’ এবং tongue কে ‘টাঙ্গু’ বলা হয়।

এই বানান সমস্যার কারণে পত্রিকায় একবার যখন ‘ডেঙ্গু’ শুরু লেখা হয়েছে তারপর তা রোগটির চেয়েও দ্রুতবেগে বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে । ‘ডেঙ্গু’ বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও বলা হয় বলে জানি না। পশ্চিমবঙ্গের পত্রিকায় কিন্তু ‘ডেঙ্গি’-ই লেখা হয়, ‘ডেঙ্গু’ নয়।

এডিস মশার বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর পাশাপাশি এই মশা দ্বারা ছড়ানো রোগটির নাম সঠিক উচ্চারণে বলা ও লেখাও জরুরি।

চৌধুরী মুফাদ আহমদ: প্রাবন্ধিক

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর