ডাবল স্টান্ডার্ড

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

শিমুল সুলতানা | 2023-09-01 13:57:26

সব মানুষই কম বেশি অভিনয় জানেন। এটি মানুষের সহজাত একটি বৈশিষ্ট্য। হাসির আড়ালে কান্না, আর কান্নার আড়ালে হাসি লুকাননি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। আবার ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড ঘৃণা করলেও উপরে উপরে দিব্বি ভালোবাসা-ভালোলাগার ভান করে যাচ্ছি আমরা অনেকেই। স্মরণ করি, শেক্সপিয়রের বিখ্যাত উক্তি, ‘পুরো দুনিয়াটাই একটা রঙ্গমঞ্চ, আর প্রতিটি নারী ও পুরুষ সে মঞ্চের অভিনেতা।’

আমরা যে কাজের জন্য একজন আরেকজনকে ছি ছি করছি, পেছনে তার সমালোচনা করছি, পরক্ষণেই কাকের মতো চোখ বুজে অবলীলায় সে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ছি। নিজে করলে সাত খুনও মাফ, অন্যের বেলায় পান থেকে চুন খসলেও ছাড় নেই! পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বত্রই মানুষের এ দ্বিমুখী আচরণ লক্ষ্যণীয়।

ধরুন, মফস্বলের এক যৌথ পরিবারের কথাই। পরিবারের সব মেয়েরাই সালোয়ার-কামিজ, ম্যাক্সি, মিডি পরতে পারে। আর যারা এখনও ছাত্রী, তাদের স্কার্ট, জিন্স, টিশার্ট থেকে শুরু করে হালফ্যাশনের নানা ধরনের পোশাক কোনোকিছুই পরতে বাধা নেই। যতো গণ্ডগোল ওই বাড়ির বৌদের বেলায়। ১২ হাত কাপড় পরেই তাকে বৌগিরি করতে হবে। বাড়ির বৌদের সালোয়ার-কামিজ পরার জন্য ভাসুর, শ্বশুরের অনুমতির প্রয়োজন হয়। এটা কি ওই বাড়ির কর্তাদের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড না? শ্বশুর বাড়ি ও বাবার বাড়ির মানুষের এই দ্বিমুখী ভূমিকার ফিরিস্তি অনেক দীর্ঘ।

আজকাল একটি বিষয় বেশ চোখে পড়ে। অনেক নারীকেই দেখা যায় অন্য নারীর সঙ্গে দেখা হলে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে। চুমু বললে ভুল হবে, আসলে একে অপরের গালের সঙ্গে গাল মিলিয়ে চুমু দেওয়ার মতো ‘উ-ম্মা উ-ম্মা’ শব্দ করেন আর কি! কারণ পাছে গালে লিপস্টিক লেগে যায় বা মুছে যায়! এমন করে শুভেচ্ছা বিনিময় যে শুধু পরিচিত, সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে করা হয়, তা কিন্তু নয়। স্বল্প পরিচিত বা প্রথম পরিচয়ের সময়ও অনেকে এমন করে থাকেন। তাদের এমন আলিঙ্গন দেখে মনে হয়, তারা একে অপরের কতই না শুভাকাঙ্ক্ষী! কত জনমের পরিচিত! কিন্তু এখানেই ভুল। এমনও হতে পারে তারা পরস্পরের প্রতি মনে মনে চরম শত্রুতা পোষণ করেন বা কেউ কাউকে পছন্দ করা তো দূরের কথা, উল্টো ঘৃণা করেন। ‘উ-ম্মা উ-ম্মা’ সেরে একে অপরের দৃষ্টি ও শ্রবণসীমা থেকে দূরে গিয়েই সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে অপরের বিরুদ্ধে বদনাম করতে থাকেন। যেন অন্তরে বিষ, আর মুখে কিস (চুমু)!

ছেলেদের ক্ষেত্রেও অনেকে ওপরে ওপরে ‘ব্রো’ ‘ব্রো’, কিন্তু ভেতরে ভেতরে হয়তো সহ্যই করতে পারেন না, গালি দেন। কেন এ অভিনয়?

যাকে আমরা পছন্দ করি না, তাকে সেটা বুঝতে দেওয়ার যেমন দরকার নেই, তেমনি তাকে পছন্দ করার অভিনয় করারও প্রয়োজন আছে কি? 

আমরা হয়তো কারো সঙ্গে কথা বলার সময় বিনয়ে গলে পড়ার ভান করি, আর আমরাই তাকে নিয়ে, শুধু তাকে নিয়ে বললে ভুল হবে, পরিচিত আরো কয়েকজনকে নিয়ে নিয়মিতই নেতিবাচক কথা চালাচালি করি, টিপ্পনী কাটি। এ কেমন দ্বিচারিতা?

সম্প্রতি উন্নয়ন কাজের কমিশন চাওয়াসহ বেশ কিছু অভিযোগ ওঠায় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ খোয়াতে হয়েছে শোভন-রাব্বানীকে। এতে আমরা আমজনতা আশার আলো দেখতে পাই। কিন্তু শোভন ও রাব্বানীও অভিযোগ করেছেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিপুল অঙ্কের টাকা কমিশন বাণিজ্য করেছেন এবং তিনি সেই টাকার ভাগ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাদেরও দিয়েছেন। ভাগ দেওয়া টাকার পরিমাণ এক কোটিরও বেশি।

টাকা চাওয়ায় ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও বাকি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এখনও কোনো ব্যবস্থা দৃশ্যমান নয়। এখন অনেকেরই প্রশ্ন, চাইলে দোষ, খাইলে কী? মানে টাকা চাওয়ার দোষে যদি শোভন আর গোলাম রাব্বানীর শাস্তি হয়, তাহলে উপাচার্যসহ যাদের বিরুদ্ধে টাকা খাওয়ার অভিযোগ উঠেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তো? অপরাধ যে-ই করুক অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী যার যতটুকু শাস্তি পাওনা, তা তাকে দেওয়াই উচিত। তিনি ছাত্রই হোন বা বা শিক্ষকই হোন।

আমাদের রাজনীতিতো দ্বিচারিতায় ভরপুর। ক্ষমতায় গেলে নেতা-নেত্রীকে তেলের সাগরে ভাসিয়ে দেয়া খুবই সহজ। তারচেয়েও সহজ ক্ষমতায় না থাকলে গালাগাল দেওয়া। আসলে এরাই সুবিধাবাদী, বর্ণচোরা। ক্ষমতার ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে এদেরও রং বদল হয়।

পদ হারানোর পর গভীর রাতে শোভন যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যান, তখন শোভনের সঙ্গে থাকা কর্মী-সমর্থকদের অনেককেই দেখা গেছে তার সামনেই ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পাওয়া আল নাহিয়ান খান জয়কে নিয়ে স্লোগান দিতে। একদিন আগে হয়তো তারাই শোভন-রাব্বানীর ডান হাত ছিলেন। ডাবল স্ট্যান্ডার্ড একেই বলে। আসলে এরাই পল্টিবাজ! শোভন-রাব্বানী, ভিসি, ডিসি, ওসি-আসলে সবাইকেই ঘিরে আছে এসব তেলবাজ, পল্টিবাজরা। সিসি ক্যামেরায় ধরা খেয়েছে ডিসি, আমরা করছি ছি ছি! কিন্তু আয়নার সামনে কি একবার দাঁড়িয়ে দেখেছি নিজের পল্টিবাজ চেহারা, তেলবাজ মন আর ডাবল স্টান্ডার্ড চরিত্র?  

মূলত মন থেকে ভালোবাসে বা শ্রদ্ধা করে, সমাজে এমন লোকের ঘাটতি আছে বৈকি। কে শত্রু আর কে বন্ধু, এক জীবনে ক’জনই বা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারি? হয়তো বা সে জন্যই শেক্সপিয়রের কথা মতো আমরা নারী-পুরুষ এক জীবনে শুধু অভিনয়ই করে যাচ্ছি দুনিয়া নামক এই রঙ্গমঞ্চে। প্রশ্ন জাগে, জীবন কি তবে শুধুই অভিনয়?

শেষ কথা হলো যা খারাপ, তা যে-ই করুক না কেন খারাপই। একই অপরাধে কারো জন্য ফাঁসি, আর কারো জন্য হাসি দিলে চলবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, কোনো ব্যক্তি নিজের জন্য যা পছন্দ করেন, অন্যের জন্য তা-ই যেন পছন্দ করেন, এটাই ঈমান, এটাই ধর্ম। ডাবল স্টান্ডার্ড পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে করে তোলে জটিল। আর সত্য ও সারল্যবর্জিত এ জীবন এক প্রশ্নবিদ্ধ জীবনই বটে।

শিমুল সুলতানা: আউটপুট এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর