তারেক জুয়া ও বাজি সম্রাট

, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স | 2023-09-01 03:04:41

ইস্যুর অভাব নাই এই দেশে। এই দেশে একেকটি ইস্যুর মেয়াদ বড়জোর ৭২ ঘণ্টা। এর মধ‌্যেই নতুন ইস্যুর সৃষ্টি হয়। পাবলিকও ভুলে যায় আগের ইস্যুর কথা। ইস্যু নিয়ে এতো কিছু বলছি এ কারণে যে অনেক দিন শুধু জুয়াবাজি নিয়ে কথা হচ্ছে। সেই সঙ্গে  যোগ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের কাণ্ড। ছাত্রলীগের শোভন-রাব্বানী ইস্যু গত হয়েছে বেশ কিছু দিন।

ছেলেবেলায় কথায় কথায় বাজি ধরতাম। বন্ধুদের মাঝে বাজি ধরা একটি স্বাভাবিক বিষয়ই ছিল। সেটা আর ধরে রাখতে পারিনি। পাারলে এক সময় জুয়া খেলতাম। আজ হয়তো ক্যাসিনোও চালাতাম। সব কিছুতেই সাধনা, একাগ্রতা লাগে। সেই সাধনা আর একাগ্রতা থাকলেই সম্রাট হওয়া যায়। না হলে ছাপোষা কলাম লেখক হয়েই সারাজীবন আফসোস করতে হয়। আর নীতিবাক্যের বান মারা যায়।

ছেলেবেলায় আমরা যখন বাজি ধরতাম, তখন কেউ কেউ, জুয়াও খেলতো। সিনিয়ররাই জুয়া খেলতেন। মুরুব্বিরা জুয়াকে ভালো চোখে দেখতেন না। গ্রামে যাত্রা-সার্কাসের সঙ্গে বাজিও চলত। এই সমাজ জুয়াকে আগেও যে চোখে দেখত এখনও সে চোখেই দেখে। আসলে সমাজ এক জায়গাতেই আটকে আছে! কিন্তু রাষ্ট্র ও বিশ্বতো এক জায়গায় থেমে নেই। তাই বাজি থেকে জুয়া, জুয়া থেকে ক্যাসিনো।

এই দেশে ক্যাসিনো আছে তা আমার জানা ছিল না। অনেক সাংবাদিক এমনকি অনেক জুয়ারি বা ক্যাসিনোর ভোক্তারও সে কথা জানা ছিল না। এতো গোপনীয়তার মাঝে এই মহাযজ্ঞ কীভাবে হলো সেটা অনেকের কাছে এক বিস্ময়। কিন্তু এক থানার ওসি নিজেই স্বীকার করেছেন যে বিষয়টি তিনি জানতেন। থানার ওসি জানা মানে রাষ্ট্র জানা। কিন্তু তারপরও এ বিষয়টি রাষ্ট্র হয়নি। গোপন জিনিস গোপন থাকাই ভালো বটে!

ঢাকায় এখন টাকার অভাব নেই। অনেক মন্ত্রীও এ কথা বলেছেন। আমরা নাদান পাবলিক মন্ত্রীদের কথা বিশ্বাস করিনি। তারা তো আগেই বলেছিলেন যে বাংলাদেশ এখন আর সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড নাই, কানাডা-আমেরিকা হয়ে গেছে। গণ্ডাখানেক ক্যাসিনো ক্লাব অভিযানে সে সত্যই বেরিয়ে এসেছে। আমরা না জানলেও ভেতরে ভেতরে দেশে ক্যাসিনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। তা না হলে বিদেশি বিশেষজ্ঞ কর্মীদের এনে ঢাকায় ক্যাসিনো চালানো হতো না। ক্যাসিনো চালাতে নেপালি শ্রমিক নিয়োগ করা হতো ঢাকার ক্লাবগুলোতে। আমাদের ব্যর্থতা আমরা ক্যাসিনো শিল্পে দক্ষ শ্রমিকের যোগান নিশ্চিত করতে পারিনি। ক্যাসিনো উদ্যোক্তাদের তাই বিদেশ থেকে শ্রমিক নিয়োগ করতে হয়েছে। একটি বিষয় অবশ্য প্রশংসার দাবি রাখে। দেশের টাকা দেশেই আছে। ফিলিপাইন, মালয়েশিয়ার ক্যাসিনোতে ঢালা হয়নি। 

দেশের ফুটবলের অবস্থা আজ তথৈবচ। এক সময় দেশের প্রতিটি গ্রামে, ইউনিয়নে ফুটবল ক্লাব ছিল। গ্রামে হাডুডু আর ফুটবল ছিল আমাদের সংস্কৃতির অংশ। সে সবই আজ ইতিহাস। ঘরোয়া ফুটবল বলতে দেশে আজ আর কিছু নেই। নামকাওয়াস্তে কয়েকটি ক্লাব ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে। ফুটবল ক্লাবে এখন ফুটবলের বদলে জুয়া চলে। দেশের নামকরা সব ক্লাবেই চলছে এ কর্মকাণ্ড। ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র, মোহামেডান, আবাহনী ও বনানীর ঢাকা গোল্ডেন ক্লাব-সবখানেই চলছে ক্যাসিনো। সব কিছুরই পরিবর্তন হয়। খেলারও, খেলোয়ারেরও।

ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে একটা অভিযান চলছে। কিন্তু সব কিছুতেই আমরা রাজনীতির গন্ধ খুঁজে বেড়াই। জুয়াড়ি যুবলীগারদের বিরুদ্ধে একটা শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী। সাথেই সাথেই এক পক্ষ এর পেছনের কারণ খুঁজতে শুরু করল। কেন হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী এমন অভিযান শুরু করলেন। নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো স্বার্থ আছে, ইত্যাদি, ইত্যাদি। ভালো কিছুর নির্মোহ প্রশংসা করতে আমরা যেন ভুলেই গেছি। এমন পরশ্রীকাতর জাতিকে (আমাদেরকে) লইয়া আমরা কী করিব?

প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের অধিবেশন শেষে দেশে ফেরার সময় নিউইয়র্কে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমরা আগে থেকেই ব্যবস্থা নিচ্ছি, যাতে ১/১১-এর মতো কোনো ঘটনা দেশে আর ঘটতে না পারে। আমি আপনাদের বলতে পারি, ওয়ান ইলেভেনের মতো কোনো পরিস্থিতির প্রয়োজন নেই। কারণ, সরকার কঠোরভাবে সব ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে।"

প্রধানমন্ত্রী একেবারে পরিষ্কার করেই বলেছেন, ‘যদি কোনো অন্যায় কিছু হয়, কে করেছে সেটা দেখা হবে না, এমনকি আমার দলের লোক হলেও আমি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। শুদ্ধি অভিযান নিজ বাড়ি থেকেই শুরু করা উচিত।’

প্রধানমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন এবং তিনি ঠিক কাজটিই করছেন। ছাত্রলীগ থেকে শুরু করেছেন। যুবলীগের বিরুদ্ধে এখন অভিযান চলছে। আশা করি, এরপর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেও অভিযান শুরু হবে। কারণ, বাড়ির কাচাড়িঘর আর উঠোন ঝাড়ু দেওয়ার পাশাপাশি বৈঠকখানাও পরিষ্কার করা জরুরি। জানি, এ কাজটি কঠিন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যার জন্যতো নয়।

এই যে সব কিছুর মধ্যেই রাজনীতির অনুসন্ধান, এটা শুধু বিরোধী দলই নয়, সরকারি দলও কম যায় না। অনেক নেতা বলে উঠলেন, দেশে ক্যাসিনো শুরু করেছেন জিয়াউর রহমান, আর তারেক জিয়া। সব ক্রেডিট কি সবাইকে না দিলেই নয়? কে প্রথম চুরি করেছে, আর কে পরে ঘরে ঢুকেছে সেটি বড় কথা নয়। কে সিঁদেল চোর আর কে সাইবার চোর সেটাও বড় কথা নয়। চোর চোরই। এদেশে এক সময় ঘরে ঘরে মাটির ব্যাংক ছিল। তখন গৃহস্থের ওই মাটির ব্যাংক চুরি মানে তার মাথায় হাত। আজকে তফসিলি ব্যাংক চুরি হলেও আমাদের হয়তো গায়ে লাগে না। কারণ, হালে আমরা বড়লোক হয়েছি বটে, কিন্তু তাই বলে কি চুরিকে চৌর্যশিল্প বা হস্তশিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে? মনে রাখতে হবে, আগে যে মাটির ব্যাংক চুরি করত, কলিকালে সেই তফসিলি ব্যাংক চুরি করে। চোর-ডাকাত-দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তাই সব সময়ই জেহাদ জারি রাখতে হয়। ঘরে কর্তা বা রাষ্ট্রের কর্তা-সবার বেলায়ই একই কথা। 

গত দুই শতকের সবচেয়ে বড় চোর ফিলিপাইনের স্বৈরশাসক মার্কোস অথবা কঙ্গোর মবুতুকে জনরোষে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছে। তারেক জিয়া বা তার বাবা জিয়াউর রহমানের জুয়া, ক্যাসিনোর কারবার হয়তো ছিল, কিন্তু তাতে ক্যাসিনো সম্রাটের কারবার হালাল হয়ে যায় না। জানি, রাজনীতি নিজেই এক জুয়া। একে অপরের বিরুদ্ধে দোষ চাপিয়ে এই জুয়ায় জয়ী হতে সবাই চায়। জুয়ার ক্ষেত্রেও তাই। তাই জুয়া এখন তারেক জুয়া। বাকি সব কি তবে ভুয়া?

দেশে উন্নয়ন হয়েছে। দেশে আর চোর নেই। কিন্তু গরিব সিঁদেল চোর বা ছিঁচকে চোরের কপাল পুড়লেও মহাচোরেরা বাড়বাড়ন্ত। তারওপর যোগ হয়েছে, জুয়া, ক্যাসিনো। একটা কথা আছে, ঝিকে মেরে বউকে শেখানো। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে মনে পড়ে। বলেছিলেন, বাঘে ধরলে ছাড়ে, শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়ে না। এখনও যারা বাড়বাড়ন্ত, সময় থাকতে সাবধান!

বাজি নিয়ে দেশে অনেকে কৌতুক আছে। দুই মাতাল মদ খেয়ে একজন আরেকজনকে বলছেন, বলতো ওটা চাঁদ না সূর্য? ওরে মাতাল, একটা জ্বলজ্বলে সূর্যকে বলছিস চাঁদ। আরেক মাতাল: আরে না, ওটা চাঁদ। ঠিক আছে, আয় বাজি ধরি। পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন এক নারী। মাতালরা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপা মণি, একটু বলবেন ওই যে ওইটা কি সূর্য, না চাঁদ?” জবাবে ওই নারী বললেন, ‘আসলে আমি সঠিক জানি না। আমি এই এলাকায় থাকি না তো।’

আরেক মার্কিন সৈনিককে আফগানিস্তান থেকে বদলি করে পাঠানো হল কান্দাহারে। ওই সৈনিকের কথায় কথায় বাজি ধরার অভ্যাস ছিল। নতুন কমান্ডার তাকে জিজ্ঞেস করলেন: তুমি নাকি কথায় কথায় বাজি ধর? তা, কি নিয়ে বাজি ধর তুমি? সৈনিক বললেন, যে কোনো সময়, যে কোনো কিছু নিয়ে। যেমন স্যার, আপনার মেরুদণ্ডের নিচে একেবারে শেষ মাথায় বড় কালো একটা তিল আছে তা আমি বাজি ধরে বলতে পারি। কমান্ডার: আরে নাহ। ঠিক আছে স্যার বাজি। জিতলে আপনি ২০০ ডলার দেবেন। হারলে আমি। সাক্ষী হিসেবে দুই-চারজন মেজর ও সৈন্যকেও ডাকা হলো। কমান্ডার সবাইকে পোশাক খুলে দেখালেন যে তার মেরুদণ্ডের শেষ মাথায় (মানে পশ্চাদ্দেশে)  কোনো কালো তিল নাই। সৈনিক বাজিতে হেরে ২০০ ডলার দিলেন। ওদিকে কমান্ডার বাজি জিতে সৈনিকের আগের কমান্ডারকে ফোন দিয়ে বললেন, বন্ধু তোমার সৈন্যককে তো আমি বাজিতে হারিয়ে দিয়েছি। ও নাকি শুধু বাজি ধরে। ও বললো, আমার পশ্চাদ্দেশে নাকি একটা তিল আছে। আমি সব খুলে দেখালাম যে নাই। সাক্ষীও ছিল কয়েকজন। আগের কমান্ডার বললেন, বলো কি, হায় হায়! তুমি তো আমার ৫০০ ডলার লস করাইয়া দিলা। ওকে বিদায়ের সময় বলেছিলাম যে তোমার নতুন কমান্ডার কিন্তু খুব রাগি। ওর সঙ্গে বাজিটাজি ধরতে যেও না। ও বললো  ‘আমি যোগ দেয়ার তিন দিনের ভেতর ওকে (নতুন কমান্ডারকে) সবার সামনে ন্যাংটা করে ছাড়ব, বাজি ধরতে চান?’ আমি তখন ওর সাথে ৫০০ ডলারের বাজি ধরেছিলাম। এরপরের ঘটনা আমাদের জানা নেই।

কিন্তু এ জাতীয় বাজিকর, জুয়ারি, দুর্নীতিবাজ তারেক জুয়া আর বাজি সম্রাটদের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে। এরা দেশকে নিয়েও বাজি ধরে। বাজি ধরাই এদের নেশা ও পেশা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর