বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়: প্রত্যাশা-প্রাপ্তি-সঙ্কট-সম্ভাবনার ১১ বছর

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

তুহিন ওয়াদুদ | 2023-08-22 21:36:11

গতকাল ছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে যে কারোরই ভালো লাগবে। সবুজের ছায়াঘেরা এই ক্যাম্পাস। সীমাহীন সীমাবদ্ধতা নিয়ে এই ক্যাম্পাস দাঁড়িয়ে থাকলেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক সৌহার্দ্যবোধ এ ক্যাম্পাসের সবচেয়ে বড় সম্পদ।

বিকেল বেলা সবুজ চত্বরে অনেক শিক্ষার্থী বৃত্তাকারে বসে। কোথাও হয়তো বিতর্কচর্চা হয়, কোথাও বিজ্ঞান চেতনা পরিষদের আলোচনা। কোথাও কোথাও রণন, উদীচী, গুনগুনসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাংস্কৃতিক অনুশীলন চলতে থাকে। অনেক শিক্ষক তো রীতিমতো শিক্ষার্থীদের সাথে মাঠে খেলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করে দেশে ফিরছেন। তাদের সেসব অভিজ্ঞতারও ছোঁয়া লাগছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে।

ধীরে ধীরে এ প্রতিষ্ঠান একটি উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র লাভ করছে। প্রতিষ্ঠার ১১ বছর একটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে না পারারই কথা। তবে এ বিশ্ববিদ্যালয় একটি ইতিবাচক সংস্কৃতির পথে হাঁটছে।

দেশের অপরাপর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এ বিশ্ববিদ্যালয়েও অনেক সমস্যা আছে। নতুন হিসেবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়তো সমস্যা কিছুটা বেশি আছে। তবে সম্ভাবনাও কম নেই।

শিক্ষার্থীরা যে পরিমাণ সম্ভাবনা নিয়ে ক্যাম্পাসে আসছেন হয়তো তার উপযুক্ত পরিচর্যা করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষক সঙ্কট আছে, গবেষণার পরিবেশও কম। এর মধ্য দিয়ে চলছে এ বিশ্ববিদ্যালয়।

এরই মধ্যে অনেক শিক্ষার্থী এখানে স্নাতকোত্তর শেষে বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে। চাকরির ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীরা ভালো করছে। কয়েকদিন আগে ঠাকুরগাঁও-এ ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও) নামের একটি বেসরকারি সংস্থায় গিয়েছিলাম। নামকরা এ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামান বলছিলেন- ‘আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খুব ভালো। পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও শিক্ষার্থীরা অনেক জ্ঞান রাখে।’ এ কথা শুনে মনটা ভরে গিয়েছিল। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অভিজ্ঞ অধ্যাপকগণও শিক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ করে বলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মান ভালো। এসব মূল্যায়ন আমাদের আশাবাদী করে।

রংপুরে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে আছে দীর্ঘ আন্দোলন। দেশবিভাগের পরপরই রংপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপিত হয়েছিল। পাকিস্তান শাসনামলে সেটি হয়নি।

১৯৭১ এর জানুয়ারি মাসে লালমনিরহাটে স্থানীয় সাংসদকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। সেখানে সাংসদকে দেওয়া মানপত্রেও রংপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি ছিল। ২০০১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নামের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। ওই বছরেই চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এলে প্রতিহিংসাবশত বিশ্ববিদ্যালয়টি নোয়াখালিতে নিয়ে যাওয়া হয়।

২০০৭-২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে এই আন্দোলন আবারও চাঙা হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন কারমাইকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক রেজাউল হক। ঢাকার সাথে সমন্বয় করার কাজ করতেন চৌধুরী খালেকুজ্জামান। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমানের অবদান অনস্বীকার্য। তাদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ছাড়া এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব ছিল। অগণিত সাধারণ মানুষ, সাংবাদিক এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন।

২০০৮ সালে ১২ অক্টোবর রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ফখরুদ্দীন আহমেদ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের ওপর রংপুরবাসীর কোনো আস্থা ছিল না। এর অন্যতম কারণ- ২০০১ সালে কাজ শুরু হওয়া একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে এখানে থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে হবে।

প্রথম উপাচার্য হিসেবে ড. এম লুৎফর রহমানকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজের একটি জীর্ণ পরিত্যক্ত ভবনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করেন। রংপুরবাসীর দাবির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে তিনি ৬টি বিভাগে শিক্ষার্থী ভর্তির কাজ করেন। বাংলা, ইংরেজি, অর্থনীতি, গণিত, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, এবং বিবিএ চালু করা হয়। ছয়টি বিভাগে ৩০০ শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়েছিল। কারমাইকেল কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ অধ্যাপক দীপকেন্দ্রনাথ দাস তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে প্রথম ভর্তি কার্যক্রমে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছেন।

শিক্ষার্থী ভর্তিরও প্রায় ৩ মাস পর নিয়োগ করা হয় শিক্ষক। প্রথম দফায় ১২জন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছিল। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দুজন শিক্ষকের একজন গণিত বিভাগর বর্তমান অধ্যাপক তাজুল ইসলাম, অন্যজন আমি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষক হওয়ার সুবাদে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় শুরু থেকে সবটাই দেখা। ২০১১ সালে স্থায়ীয় ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম স্থানান্তরিত করা হয়।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অনেকের আক্ষেপ আছে। কিন্তু এখনো এ বিশ্ববিদ্যালয় ভীষণ সম্ভাবনাময়। এ বিশ্ববিদ্যালয়টির উপযুক্ত পরিচর্যা করা সম্ভব হলে এটি একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেই গড়ে উঠতে পারে। এর জন্য সবারই আন্তরিকতা থাকতে হবে। উপাচার্যকে সেই স্বপ্ন দেখতে হবে। শিক্ষকদের সেই লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য উপযুক্তভাবে তৈরি করতে হবে। শিক্ষার্থীদেরও সম্মানজনক উচ্চতায় নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠাকালীন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ছিল রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ২০০৯ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করে ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর’। যদিও রোকেয়া সাখাওয়াত নিজের নামে কখনো বেগম যুক্ত করেননি। ভুল নামেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলছে। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত হয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সব বিভাগে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ওপর একটি করে কোর্স পড়ানো হবে। সেই সিদ্ধান্ত এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি।

প্রতিকূল সময়ে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের চেতনা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হলে তার নামকরণের সার্থকতা থাকবে। নয়তো শুধু নামে বিশেষ কোনো কল্যাণ হবে না।

বর্তমান ২১টি বিভাগে প্রায় সাড়ে আট হাজার শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। শিক্ষার্থী আর বিভাগের তুলনায় অবকাঠামো খুবই কম। সরকার নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নয়নে অনেক টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে। উপাচার্য মহোদয় চাইলেই এ বিশ্ববিদ্যালয়কে আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে শিক্ষা ও গবেষণার উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে প্রস্তুত করতে পারবেন। যে সেশনজট আছে তাও শূন্যের পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব। বর্তমান সরকারের শুভদৃষ্টি আছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি। এখন প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এগিয়ে আসা।

তুহিন ওয়াদুদ: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভরাইন পিপলের পরিচালক

এ সম্পর্কিত আরও খবর