'মেধাবী' কেন 'দানব'?

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-09-01 17:22:41

ঢাকাই সিনেমা আমাদের অদ্ভুত অদ্ভুত ধরনের কিছু মর্ডান ফ্যান্টাসি উপহার দিয়েছে। ইবনে মিজান, দেলোয়ার জাহান ঝণ্টু নামীয় পরিচালনা স্ট্যান্ডার্ড থেকে আমরা পেয়েছি বাবা কেন চাকর, মা কেন দাসী, প্রেমিক কেন খুনি, প্রেমিকা কেন ডাইনি ইত্যাদি মার্কামারা ছবি। বুয়েট আমাদের উপহার দিল বাস্তব সিনেমাটিক আখ্যান 'মেধাবী' কেন 'দানব'?

বুয়েটে নারকীয় ও সুপরিকল্পিতভাবে আবরার হত্যাকাণ্ডের পর মিলিয়ন ডলার দামের এই প্রশ্নটিই সকলের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। সবাই জানতে চাচ্ছে, কেন এবং কীভাবে এতোগুলো মেধাবী ছেলে দানব ও হন্তারকের অভিযোগ মাথায় নিল? 

অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, অভিযুক্তরা শুধু মেধাবীই নয়, কঠোর জীবন সংগ্রামে জয়ী হয়েই প্রত্যন্ত গ্রামের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত অবস্থান থেকে দেশের সর্বোচ্চ ও সম্মানজনক প্রতিষ্ঠান বুয়েট পর্যন্ত এসেছিল। এখানে তারা রাজনৈতিক অবস্থান ও পরিচিতিও পেয়েছিল। ভবিষ্যতে তারা আরও উজ্জ্বল অবস্থানে উত্তীর্ণ হতো, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

এইসব মেধাবীরা বাবা-মায়ের কষ্টার্জিত অর্থ, পাড়া-প্রতিবেশীদের দান-খয়রাত ইত্যাদি পেয়ে 'গোবরে পদ্মফুল' হয়ে ফুটেছিল। তারা আর ফুল থাকে নি।

'গোবরে পদ্মফুল' ছাড়াও বাংলা ভাষায় আরেকটি শব্দ আছে, যা হলো 'পঙ্কজ'। এ শব্দের মানে হলো পঙ্কে যার জন্ম। বাংলাদেশ বা উন্নয়নশীল বিশ্বে মধ্যযুগীয় রাজা-বাদশাহর মতো সোনার চামচ মুখে দিয়ে, রুপার থাকায় অন্ন গ্রহণ করে খুব কম জনই জন্ম নেন ও বেড়ে উঠে। আধুনিককাল পঙ্কজদেরই যুগ। নিজেকে শ্রমে-মেধায় সর্বোচ্চ শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার কাল এখন। এমনটিই এখন হয়। ক্লিনটন, ওবামা, মোদী হয়েছে এভাবেই। বুয়েটের মেধাবীরাও তা হতে পারতো। কিন্তু হলো না। কেন হলো না?

নিজের পরিশ্রম, পরিবারের সংগ্রাম ও সমাজের আনুকূল্য ও বদান্যতায় তারা পঙ্কজ তো হলোই না, বরং এতো কিছুর প্রতিদানে তারা চরম অকৃতজ্ঞতা ও অসাধুতার পরিচয় দিয়েছে, হয়েছে দানব ও হন্তারক। তারা ১) সহপাঠীকে হত্যা করেছে, ২) পিতা-মাতার স্বপ্ন ও সংগ্রামকে ধূলিসাৎ করেছে, ৩) পাড়া, প্রতিবেশী, স্বজনদের সম্মান হানি করেছে এবং ৪) বুয়েটের মতো মর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কালিমা লিপ্ত করেছে।

প্রশ্ন হলো, এতোসব গহির্ত ও অপরাধমূলক কাজ তারা কেন করলো? আবরার হত্যার অপরাধের আইনানুগ প্রক্রিয়ার পাশাপাশি দোষীদের এইসব মনস্তাত্ত্বিক কার্যকারণ গভীরভাবে অনুসন্ধান করে দেখাও অপরিহার্য।

কারণ, মাত্র ক'মাস আগেই একেবারে রাত দিন পড়ুয়া নিম্নবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারের আপাত ভদ্র, নিরীহ ছেলেটি যখন সহপাঠীকে পিটিয়ে হত্যা করার মতো জঘন্য অপরাধ করতে পারে এবং এমনকি পিটিয়ে প্রায় মৃত কাউকে রুমে ফেলে রেখে টিভি রুমে গিয়ে নিশ্চিন্তে বার্সিলোনার উত্তেজক ফুটবল খেলা দেখতে পারে, তখন বুঝতে হবে কোথাও ঝামেলা আছে, বড় কোন ঝামেলা আছে। ক্রিমিন্যাল দিকের মতো সাইকোলজিক্যাল দিক থেকেও অনেক ঘাপলা আছে এই অপরাধের মধ্যে।

এইসব মেধাবী থেকে দানবে রূপান্তরিতদের মনস্তাত্ত্বিক দিকটি কত নির্মম ও পাশবিক ছিল, তাও লক্ষ্যনীয়। কারণ, নৃশংস নির্যাতনের পর আবরারের মৃত্যু নিশ্চিত  হলেও খুনিরা পালিয়ে যায়নি, সারারাত বুয়েটের হলেই ছিল। স্বাভাবিক কাজ-কর্ম করেছে। আমোদ আহ্লাদে লিপ্ত থেকেছে। একটি ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পরেও তাদের মধ্যে অনুশোচনা দূর অস্ত, সামান্য মনোবৈকল্যেরও সৃষ্টি হয়নি! এমন নির্বিকার নৃশংসতা কেবল সিরিয়াল কিলার ও কোল্ড হেডেড খুনিরাই দেখাতে পারে।

তাহলে কি এটাই প্রমাণ হয় যে মেধাবীর ছদ্মাবরণে তাদের মধ্যে লুকিয়ে ছিল খুনির সত্ত্বা? কিংবা মেধাবীদের প্ররোচিত করে ঠাণ্ডা মাথার খুনিতে পরিণত করেছিল কোনও অদৃশ্য কালোহাত বা জঘন্য পরিবেশ ও পরিস্থিতি?

কারণ যা-ই হোক না কেন, একথা সত্যি যে এরা বা এদের মতো মেধাবীরা খুন না করলেও ছাত্রজীবন শেষে প্রকৌশলী হলে রাস্তা, ঘাট, সেতু, ভবন নির্মাণে এমন অসাধুতা দেখাতে পারতো, যাতে বহু মানুষের প্রাণহানি হতো। পরহিত ও জীবনমুখী কোনও কার্যক্রম ও আচরণ যে এদের দ্বারা সম্ভব হতো না, এ কথা বলাই বাহুল্য। 

অবস্থাদৃষ্টে এবং দোষীদের আচরণের পূর্বাপর কার্যক্রমের নিরিখে এটা প্রতীয়মান হয় যে, তাদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, তাদের কিছুই হবে না। কেউ ওদের কিছুই করতে পারবে না। ওরা পার পেয়ে যাবে। এই খুনটাকে কোনো না কোনোভাবে ধামাচাপা দেয়া যাবে। এরকম ভাবাটাই, ভাবতে পারাটাই মূল সমস্যা। এবং অপরাধের জন্মও এখান থেকেই।

বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের আইনকানুন সম্পর্কে তাদের মানসপটে এত বড় আস্থাহীনতা কেন হলো? কেন কিছু হবে না বলে মনে হলো তাদের? কেন তারা সব কিছু সামাল দেওয়ার সাহস পেলো? এসব নিয়েও গভীরভাবে ভাবতে হবে। কেননা, এমন পরিস্থিতি বিরাজমান থাকলে আরও কেউ কেউ যে মানব থেকে দানব হবে না, এমন গ্যারান্টি দেওয়া অসম্ভব। 

প্রসঙ্গত বলা দরকার, বুয়েটের আবরার হত্যাকাণ্ড ছাড়াও দেশে হত্যাজনিত অপরাধের হার আশংকাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সময়কালে সারা দেশে শারীরিকভাবে আঘাত করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে ৫৫৪টি। হত্যাকাণ্ডগুলোতে চরম নৃশংসতা, উন্মত্ততা প্রকাশ পেয়েছে। একা বা দলবদ্ধভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যাকাণ্ডগুলো হয়েছে। খুনিরা ছিল বেপরোয়া ও নির্বিকার।

অতএব, এসব খুন যত না আকস্মিক দুর্ঘটনা, তারচেয়ে বেশি ঠাণ্ডা মাথার পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ। একই সঙ্গে এইসব অপরাধ আইনের শাসনের শৈথিল্য এবং অপরাধমূলক মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা বৃদ্ধির পরিচায়ক। এ কারণে শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি এসব হত্যামূলক মনস্তত্ত্ব ও পরিবেশ বৃদ্ধির কার্যকারণের গভীরেও যেতে হবে। সমাজে, পরিবেশে, সিস্টেমে গলদ রেখে এরকম নৃশংস ঘটনা ভবিষ্যতে এড়ানো যাবে না। মেধাবী বা মানুষ নামধারীরা ক্রমশ দানব ও হন্তারক হতেই থাকবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর