যে কলঙ্ক জাতি বয়ে বেড়াবে আজীবন

, যুক্তিতর্ক

ফরিদুল আলম | 2023-08-23 23:43:23

আমাদের জাতীয় জীবনে কত ক্ষতই না বিভিন্ন সময় দেখেছি। একটি ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই আরেকটির আঘাত আমাদের ঘাগুলোকে আরও খুঁচিয়ে জখম করে তোলে।

বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ বলি হয়েছে তারই সতীর্থদের হাতে। হন্তারকরা সবাই মেধাবী, এককথায় দেশসেরা ছাত্র সবাই। এই দুঃখ কোথায় রাখি? স্বাধীনতার ৪৮ বছর অতিক্রান্ত হবার পর এই শিক্ষা আর মেধা আমাদের কোন বাংলাদেশের দিকে ধাবিত করছে আমি জানি না। তবে এটুকু অনুমান করতে পারছি দেশে শিক্ষার উন্নয়ন ঘটলেও এর সাথে পাল্লা দিয়ে মানবিক মূল্যবোধের চরম অবনমন ঘটছে।

আবরার হত্যাকাণ্ডের পর অনেক চেষ্টা করেও কিছু লিখতে পারিনি। সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত অজস্র নিবন্ধের অনেকগুলোতেই চোখ পড়েছে। একটি নির্মম, নিষ্ঠুর আর পাশবিক হত্যাকাণ্ডকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আমার কেবল ঘুরে ফিরে একটা বিষয় মাথায় এসেছে, আর তা হল কুমারখালীর রায়ডাঙ্গার একটি গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আবরাররা সব সময় উঠে আসে না। কত যত্নে আর ত্যাগে একটি পরিবার একজন আবরারকে দেশের সেরা বিদ্যাপীঠে পাঠাতে সক্ষম হয়েছিল! আমাদের বিদ্যমান রাষ্ট্র আর সমাজব্যবস্থায় এরকম একটি আবরারের জন্ম হয় কালেভদ্রে, যে কিনা একাধারে বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম সারিতে নিজের যোগ্যতার ছাপ রেখেছিল।

তার চোখের স্বপ্নগুলো কেমন ছিল সেটা তার ফেসবুক প্রোফাইলে নিজেই লিখেছিল, ‘অনন্ত মহাকালে মোর যাত্রা অসীম মহাকাশের অন্তে’। আবরার অনন্ত মহাকালের পথ ধরে অসীম মহাকাশের অন্তে যাত্রা শুরু করেছিল। ক্ষণকালের জীবনকে নিয়ে সে যে বাজি রেখেছিল, আমাদের দেশে তার সমসাময়িক ক'জন জীবনকে নিয়ে এত গভীরভাবে কল্পনা করতে পারে তা আমার জানা নেই।

আবরার হত্যায় শোকে মুহ্যমান তার প্রিয় ক্যাম্পাস, শুধু কি তাই? শোকাতুর আমরা সবাই, গোটা দেশ। তার বন্ধুরা দাবি জানিয়েছে ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার। তাদের এই শোকের ভাষার প্রতি গভীর সম্মান রেখেই বলছি, যদি এমনও দাবি বাস্তবায়িত হয় তাহলে তা আবরারের রাজনৈতিক দর্শনের সাথে বড় বেমানান হবে। আবরার ছিল একজন আপাদমস্তক রাজনীতি সচেতন ছাত্র, বলা চলে প্রচলিত ধারার ছাত্র রাজনীতির বাইরে আমরা যে ধরণের রাজনীতি সচেতন ছাত্র সমাজকে প্রত্যাশা করি, আবরার মনে প্রাণে তাই লালন করত। আর তাই ঘাতকদের মৃত্যু পরোয়ানার মুখেও নিজের আদর্শ থেকে একফোঁটা বিচ্যুত হয়নি। দেশ, সমাজ এবং রাজনীতি নিয়ে কতটা প্রজ্ঞা থাকলে এবং বুকের ভেতর কতটা দেশপ্রেম থাকলে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি নিয়ে নিজের মন্তব্যটুকু তুলে ধরা যায়, আবরারের কাছ থেকে আমাদের সমাজের অনেকের জন্য এটা শিক্ষণীয় হতে পারে। হতে পারে তার ধারণা ভুল, কিন্তু তার কথাগুলো ছিল হৃদয় নিঃসৃত, গভীর দেশপ্রেমের চেতনাবোধ থেকে উৎসারিত।

আবরারের বন্ধুদের তথা যারা আজ ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ তাদের তাই এটা অনুধাবন করতে হবে যে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ নয়, এর ধারা পরিবর্তন করে একে দলীয় শৃংখলমুক্ত করতে হবে। আমি তাদের দাবির সাথে যুক্ত করে বলতে চাই, কেবল বুয়েট নয়, দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের উচিত হবে সকল পর্যায়ের দলীয় ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে ছাত্রছাত্রীদের রাজনীতির মুক্ত হাওয়ার স্বাদ আস্বাদন করতে দেয়া। কেবল বুয়েটের হলগুলো নয়, বাংলাদেশের এমন অসংখ্য হল রয়েছে , যেখানে রয়েছে অঘোষিত টর্চার সেল। আর এইসব হলগুলোর দায়িত্বরত প্রভোস্ট এবং হাউস টিউটরগণ কতটুকু লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি করেন এর প্রমাণ হচ্ছে তারা দিনের পর দিন এ সবকিছু দেখেও দেখছেন না। সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত টানা সাড়ে ছয় ঘণ্টা ধরে একজন ছাত্রকে পেটানো হল, কেউ কোন আওয়াজ পেল না, কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারল না, কি অবাক বিষয়!

আমিতো মনে করি কেবল দায়ী ছাত্রদের নয়, এর পাশাপাশি দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের আইনের আওতায় আনা উচিত।

বুয়েটের ভিসির বিষয়ে মন্তব্য করতে এই মূহুর্তে আমার রুচিতে বাঁধছে। তারপরও লেখার স্বার্থে বলছি, একটি প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা হয়েও এমন একটি ঘটনার ৪০ ঘণ্টা পর্যন্ত কি করে তিনি ছাত্রছাত্রীদের আড়ালে থাকলেন? কি করে পারলেন ছাত্রটির মৃতদেহ না দেখে এবং জানাজায় সামিল না হতে। হত্যাকাণ্ডের দুদিন অতিবাহিত হবার পর তিনি যদি মনে করে থাকেন নিহতের গ্রামের বাড়ীতে তার সশরীরে উপস্থিতি এবং সান্ত্বনা প্রদান সব কিছুর সমাধান করে দেবে তাহলে তিনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। আর যে কায়দায় তিনি সেখানে গেলেন, ডিসি, এসপি এবং পুলিশ, র‍্যাবের নিরাপত্তা নিয়ে তাতে করে তিনি একজন শিক্ষক নাকি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এটা নিয়ে সাময়িক বিভ্রম সৃষ্টি হতে পারে।

সবশেষে, একজন আবরার চলে গেলেন। একটি পরিবার অসহায়ের মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে এখন ঘোর অমানিশা। আবরারের একমাত্র ছোট ভাই ফাইয়াজ এখন তাদের একমাত্র ভরসা। যারা হত্যার দায়ে অভিযুক্ত তারাও মেধাবী, তাদের পরিবারগুলোতেও হতাশা, সাথে লজ্জায় মুখ দেখাতে না পারার কষ্ট। এক একজন ছেলেকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে আসতে গিয়ে এক একটি পরিবারকে কত সংগ্রাম করতে হয়েছে এর সবকিছুই সহসা অতীত হয়ে গেল। চোখজুড়ে কেবল কলঙ্ক, এ কলঙ্ক এ জাতিকে বয়ে বেড়াতে হবে আজীবন।

 

ফরিদুল আলম: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এ সম্পর্কিত আরও খবর