এটি বিয়ে নয়, অনাচার!

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মুফতি এনায়েতুল্লাহ | 2023-09-01 09:59:43

বিয়ের মাত্র এগারো দিন পর স্ত্রী নূরন্নাহার খাতুনকে (১৯) তালাক দিয়ে বর মোনছের আলী (৩২) শাশুড়ি মাজেদা বেগমকে (৪০) বিয়ে করেছেন। ঘটনা টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার কড়িয়াটা গ্রামের। গ্রাম্য সালিশে স্থানীয় হাদিরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য ও এলাকার গণ্যমান্যদের উপস্থিতিতে এমন বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রকাশ করেছে। জামাই কর্তৃক শাশুড়িকে বিয়ে করা নিয়ে এলাকায় সমালোচনার ঝড় বইছে। তবে কী কারণে স্ত্রীকে ছেড়ে শাশুড়িকে মোনছের আলী বিয়ে করেছেন, সেটা অজানা। ধারণা করা হচ্ছে, পরকীয়ার কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার আগে নানা সময় শাশুড়িকে নিয়ে জামাই ভেগে যাওয়ার কিংবা বিয়ে করার খবর পাওয়া গেছে।

এসব ঘটনা সামাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত নজির। না হলে, মানবীয় সমাজে পাশবিকতা ও লাম্পট্যের এমন ঘটনা কী করে ঘটে? বহমান এ সময়ে রক্ত হিম করা এমন ঘটনা আমাদের বিবেকবোধ এবং চিন্তা শক্তিকে বিকল করে দেয়। বস্তুত কোনো অবস্থা বা প্রেক্ষিতেই মানব সমাজে এ জাতীয় ঘটনা ঘটার কথা নয়, তারপরও ঘটছে। মানুষ যেনো পশুকে হার মানিয়ে দিচ্ছে। মানুষের স্বাভাবিক বিবেক ও বুদ্ধিকে ভোঁতা করে দেওয়ার মতো এ ঘটনা নিন্দনীয় কাজ নিঃসন্দেহে।

মানবীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ যখন শেষ হয়ে যায়, তখন মানুষ আর মানুষ থাকে না; সে পশুর চেয়েও অধম হয়ে যায়। তাইতো আজ দিকে দিকে পশুত্বের জয়ধ্বনি শোনা যাচ্ছে, যা আদিম বর্বরতা এবং জাহিলিয়াতকে হার মানাচ্ছে। ধর্মহীনতা ও অজ্ঞতার কারণে সভ্যতা আমাদের কাছ থেকে ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে। আধুনিক জাহেলিয়াত মানুষের বিবেকবোধ, চেতনাবোধ, প্রেম, ভালোবাসা সব কেড়ে নিয়ে মানুষের অবয়বে অমানুষে পরিণত করেছে। যার কিছু নমুনা আমরা প্রায়ই দেখতে পাই। এগুলো দেখে মানুষ হিসেবে আমরা বেদনায় নীল হই, প্রতিবাদে উত্তাল হই, ঘৃণায় কুঁকড়ে উঠি। তাতে সমাজ বদলায় না, বরং ধেয়ে আসে অনৈতিকতার মাত্রা ভিন্নরূপে, অন্য নামে। এবারের ঘটনা তারই প্রমাণ। না হলে সমাজের নেতৃস্থানীয় মানুষের উপস্থিতিতে কী করে এমন অভব্য কাজ স্বীকৃতি পায়?

মূলত পরকীয়ার মতো অনৈতিক বিষয় সমাজের অভ্যন্তরে জেঁকে বসেছে। পরকীয়া মানে একটি গোপন বিষয়, একটি অন্যায়, একটি অনাচার, একটি অপরাধ। পরকীয়ার দরুন শুধুমাত্র একটি পরিবার ধ্বংস হয় না, এর সঙ্গে আরও কিছু পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের সন্তান এবং আত্মীয়রা একটি অপরাধবোধ মাথায় নিয়ে, এক ধরনের মানসিক যন্ত্রণা বুকে নিয়ে সমাজের মধ্যে কালাতিপাত করে।

জন্মগতভাবে মানুষ দু’টি সত্ত্বার সমম্বয়ে গঠিত। একটি পাশবিক সত্ত্বা অপরটি মানবিক সত্ত্বা। পাশবিক সত্ত্বাকে নিয়ন্ত্রণ করে মানবীয় সত্ত্বার বিকাশ ঘটিয়ে মানুষ তার মানবীয় মূল্যবোধের পরিচয় দেবে এটাই মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য। মানুষের মানবীয় সত্ত্বার পাশাপাশি আল্লাহ তায়ালা তাকে আরও কিছু গুণাবলী দিয়ে সৃষ্টি করেছেন তা হচ্ছে- প্রেম, ভালোবাসা, মায়া, মমতা, উদারতা, বদান্যতা, সন্তান বাৎসল্য, স্নেহ, প্রেম-প্রীতি, ভক্তি-শ্রদ্ধা ইত্যাদি।

পরকীয়ার ঘটনা এসব কিছুকে পায়ে ঠেলে নিমিষেই সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। পৃথিবীর আদি হতে আজ পর্যন্ত মানব বংশের গতিধারা রক্ষার জন্য অনন্য যে পদ্ধতি মানব সমাজে চালু আছে তা হচ্ছে পরিবার। সেই পরিবারে জ্বেলে দেয় অশান্তির আগুন। বয়ে আনে অপমানের স্রোত। যে পরিবার টিকে থাকে স্নেহ-ভালোবাসা ও সন্তান বাৎসল্যতার কারণে, তাকে সমূলে ধ্বংস করে দেওয়া হয় এহেন বিকৃত কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষিতে।

অথচ মানব ইতিহাসের এমন হাজারও বর্ণনা পাওয়া যায়, যেখানে স্বামীর জন্য স্ত্রীর অসাধারণ আত্মত্যাগ, সন্তানের জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করা, সন্তান বাৎসল্যে নিজের আরাম-আয়েশ, সুখ-সুবিধা বিসর্জন দেওয়ার ঘটনা। যার কারণে ভালোবাসার সৌধ রচিত হয় ঘরে-ঘরে, পরিবারে-পরিবারে। সেখানে পরকীয়ার মতো তমসাচ্ছন্ন বিকৃত চিন্তা মুহূর্তেই ভেঙে খান খান করে দেয় ভালোবাসার সৌধসমূহ। তাই এমন প্রলয় থেকে বাঁচার পথ এখনই খুঁজতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন রক্ষায় একযোগে কাজ করতে হবে। নীতি, নৈতিকতা ও আদর্শকে সর্বাগ্রে স্থান দিতে হবে।

এটা সত্য, আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানেরা তাদের মর্যাদা, স্বকীয়তা, কৃষ্টি, কালচার, পারিবারিক বন্ধন শতভাগ ধরে রাখতে পারেনি। তারপরও বলা চলে, ক্ষয়িষ্ণু এ সমাজে এখনও যে সভ্যতা, ভদ্রতা, লজ্জাশীলতা, পবিত্রতা এবং সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন টিকে আছে এর একমাত্র কারণ এ জনপদে ইসলামের অনুসারী মানুষের সংখ্যা বেশি। ইসলাম আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে একমাত্র মনোনীত জীবন বিধান। যে জীবন বিধানের অনুসরণের মাধ্যমে এসব অন্যায়, অনাচার, পাপাচার, অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা দূর করা সম্ভব।

পরকীয়ার ক্ষেত্রে নারীকে এককভাবে দোষারোপ করার সুযোগ নেই। নারী মানব সভ্যতার অর্ধাংশ, সভ্যতার সূচনা ও বিকাশে এক অনবদ্য ভূমিকা পালনকারী। নারীর অবদান ছাড়া এই সভ্যতা অচল। আর একটি অনিবার্য সত্য হলো, সমাজের নৈতিকতা রক্ষার মূল চাবিকাঠি নারীর হাতে নিহিত। তাই নারীকে হতে হয় সাবধানী। বর্তমানে সংগঠিত অনেক ঘটনাতেই নারীকে তার চিরায়ত চরিত্রে দেখা যায়নি। এটা দুঃখজনক, এমনটি কাম্য নয়। নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত এমন কাজ সমাজের বিষফোঁড়া। এগুলোর যথোপযুক্ত চিকিৎসা এখনই দরকার। নইলে এই সংক্রমণ সমাজকে ধ্বংস করে দেবে।

নৈতিকতা বিষয়টি নীতির অনুসরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আর এই নীতি হতে হবে শুদ্ধ ও সুস্থ। নারী ও পুরুষের উভয়ের নৈতিকতা রক্ষার মাধ্যমে সমাজের নৈতিক মান অর্জিত হয়। নারী ও পুরুষের সম্পর্কের নীতিমালার ওপর সমাজের নৈতিক অকল্যাণের তারতম্য অনেকাংশেই নির্ভরশীল। একজন নারীর ভূমিকা এই জায়গায় অবশ্যই বিশেষ গুরুত্বের দাবী রাখে।

মানব সমাজের নারী ও পুরুষের যৌন সম্পর্কের স্বীকৃত বৈধ ভিত্তি স্থাপিত হয় বিয়ের মাধ্যমে। বিয়ে ব্যতীত বা বিবাহ বহির্ভূত অবাধ যৌনাচার মানবীয় নৈতিক দৃষ্টিকোণ, সামাজিক দৃষ্টিকোণ ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণসহ সব দিক থেকেই একটি ঘৃণিত কাজ। ইসলামসহ বেশিরভাগ ধর্মেই কাজটিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে। বিভিন্ন জাতি ও সভ্যতার ইতিহাস থেকে দেখা যায়, যে জাতি বা সভ্যতায় ব্যভিচারের জীবাণু প্রবেশ করেছে, সে জাতি বা সভ্যতা টেকেনি, দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে।

এবার একটু মাসয়ালা নিয়ে আলোচনা করি। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিয়ে হয়নি। কারণ, মেয়েকে বিয়ের মাধ্যমে শাশুড়ি (স্ত্রীর আপন মা) সম্পূর্ণরূপে হারাম হয়ে যায়। স্ত্রীর সঙ্গে মিলন হোক বা না হোক এবং স্ত্রী জীবিত থাকুক বা না থাকুক সর্বাবস্থায় শাশুড়ি মাহরামের অন্তর্ভুক্ত। তাকে বিয়ে করা হারাম এবং তার সঙ্গে দেখা দেওয়া জায়েজ। এমনকি স্ত্রীর মৃত্যুর পরও তার সঙ্গে দেখা দেওয়া জায়েজ।

কোরআনে কারিমের সূরা নিসার ২৩ নম্বর আয়াতে শাশুড়ির সঙ্গে বিয়ে হারাম হওয়ার কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। প্রসিদ্ধ তাফসিরগ্রন্থ রুহুল মাআনিতে আল্লামা আলূসি (রহ.) বলেন, কোরআন মাজিদে ‘উম্মাহাতু নিসাইকুম’ (তোমাদের স্ত্রীদের মাতা) স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। এখানে ভিন্ন কোনো অর্থ করার সুযোগ নেই (তাফসিরে রুহুল মাআনি: ৪/২৫৭)।

একটি হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি কোনো নারীকে বিয়ে করবে তার সঙ্গে মিলন হোক বা না হোক (সর্বাবস্থায়) তার মায়ের সঙ্গে বিয়ে নাজায়েজ (বাদায়েউস সানায়ে: ২/৫৩১)।

এ বিষয়ে সব মাজহাবের উলামায়ে কেরাম একমত যে, কোনো নারীর সঙ্গে ইজাব-কবুল হলেই তার মাতা চিরতরে ছেলের জন্য হারাম হয়ে যাবে। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, শাশুড়ির সঙ্গে বিয়ে কস্মিনকালেও বৈধ নয়। এটা শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ নয়; বরং সামাজিকভাবেও এটা গর্হিত কাজ বলে পরিগণিত।

যখনই তারা জানবে, তাদের এ বিয়ে বৈধ হয়নি তখনই তাদের উচিত পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে যাওয়। বিগত সময়ে না জেনে একত্রে থাকা ও দৈহিক সম্পর্কের কারণে আল্লাহ তায়ালার কাছে কায়মনোবাক্যে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। আশা করা যায়, আল্লাহ তায়ালা তাদের গোনাহ মাফ করে দেবেন। কারণ, তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। কিন্তু জেনে-বুঝে, ধর্মীয় বিধান, মুসলিম ঐতিহ্য, পরম্পরা ও সামাজিক রীতি-নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তারা যদি ঘর-সংসার করতে থাকে, তাহলে প্রশাসনের দায়িত্বশীলদের উচিত হবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কারণ, সমাজকে সংক্রমণ করে এমন কাজ চলতে দেওয়া যায় না।

 

মুফতি এনায়েতুল্লাহ: বিভাগীয় প্রধান, ইসলাম, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর