আরও ‘ব্যাকফুটে’ নানক!

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

রেজা-উদ্-দৌলাহ প্রধান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ঢাকা | 2023-08-28 07:25:41

কথায় আছে ‘হাতি গর্তে পড়লে চামচিকাও লাথি মারে’। চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে এমন করুণ দশা হয়েছে অনেক বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদের। এক সময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী নেতাদের মনে ভয়— কখন যেন কী হয়! ক্যাসিনো ও দুর্নীতি বিরোধী চলমান অভিযানকে শুদ্ধি অভিযান হিসেবে দেখছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে নিজ ঘর থেকেই শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে বলে মনে করছেন দলটির নেতারা।

চলমান শুদ্ধি অভিযানে দুর্নীতিগ্রস্ত নেতারা আতঙ্কে থাকলেও এর ফলে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন তৃণমূলের অনেক নেতা-কর্মী। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘জিরো টলারেন্স’ অবস্থান দেখে অনেক বড় নেতা ঘাবড়ে গেলেও সাধারণ মানুষ অভিযানের প্রশংসা করছেন। অভিভূত হয়ে তারা দেখছেন পরাক্রমশালী নেতাদের নীরব পতন।

চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের ডান হাত, বাম হাত বলে পরিচিত অনেক মধ্যম সারির নেতা আটক হওয়ায় তাদের অনেকেই এখন ক্ষতিগ্রস্ত। এদের মধ্যে অন্যতম আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের (মোহাম্মদপুর-বসিলা) কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব গ্রেফতার হওয়ার পর অভিযোগের তীর নানকের দিকে। কথিত আছে কাউন্সিলর রাজীব নানকের ছত্রছায়ায় গড়ে তোলেন সম্পদের বিশাল পাহাড়।

সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের অভিযোগে গত শনিবার (১৯ অক্টোবর) আটক হন তারেকুজ্জামান রাজীব। তার ‘রাজনৈতিক পিতা’ বলা হয় নানককে। কথিত আছে, নানকের পালকপুত্র হিসেবে মোহাম্মদপুর এলাকায় নিজেকে পরিচয় দিতেন রাজীব। ২০১৫ সালে এক মুক্তিযোদ্ধাকে লাঞ্ছিত করায় মোহাম্মদপুর থানা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়কের পদ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। পরে নানকের সুপারিশে সেই বহিষ্কার আদেশ তুলে নিয়ে তাকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে প্রমোশন দেয় কেন্দ্রীয় যুবলীগ। অবশ্য সেজন্য কোটি টাকার উপরে লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন হারানোর পর থেকেই নানকের উল্টো রথযাত্রা শুরু হয়। যেটা এখনও অব্যাহত আছে।

একসময়ের প্রতাপশালী প্রতিমন্ত্রী নানকের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়া ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘চমকপ্রদ’ ঘটনা। রাজনৈতিক এই ধাক্কার পরে নানা ঘটনায় তিনি আরও ব্যাকফুটে চলে যেতে থাকেন।

ঢাকা-১৩ আসনের এমপি থাকা অবস্থায় তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া ব্লুম বার্নিকাটের গাড়ি বহরে হামলা, নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে মোহাম্মদপুরে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে একজনের মারা যাওয়া— এসব ঘটনার দায়ভার এসে পড়ে নানকের কাঁধে। মনোনয়ন মন্ত্রিত্ব কিছুই না পাওয়া থেকে শুরু করে সর্বত্রই কালো ছায়া লেগে আছে নানকের ভাগ্যে।

মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ার পর নানকসহ আরও একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও দুজন সাংগঠনিক সম্পাদককে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রমে সক্রিয় করেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। তাদের দিয়ে নির্বাচন পরিচালনা করান তিনি। সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যখন অসুস্থ হয়ে সিঙ্গাপুরে দেড় মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন তখন শেখ হাসিনার নির্দেশে ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের দেখভালের দায়িত্ব পান তিনি। কিন্তু সেই অ্যাসাইনমেন্টেও বিতর্কিত হন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নানক। বিবাহিত, মাদকাসক্ত, শিবির ও ছাত্রদলের লোকজনকে ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে স্থান দিয়ে নানকসহ দায়িত্বপ্রাপ্তরা প্রধানমন্ত্রীর আস্থার প্রতিদান দিতে ব্যর্থ হন।

এরপর শুরু হয় শুদ্ধি অভিযান। সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া অভিযানের শুরুতেই ছাত্রলীগের দায়িত্ব থেকে শোভন ও রাব্বানীকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ছাত্রলীগের ধাক্কা না যেতেই যুবলীগের নাম আসে অবৈধ ক্যাসিনো বাণিজ্যে। চালঞ্চল্যকর খবরে সারা দেশে ইমেজ সংকটে পড়ে যুবলীগ। আটক হন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ ভূইয়া। তাদের রিমাণ্ডে নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেতে থাকেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। সেখানে তাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অনেকের নাম আলোচনায় আসে। বিতর্কিত হওয়ায় যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকেও দায়িত্ব থেকে অব্যাহিত দেওয়া হয়।

ইমেজ সংকট কাটিয়ে মুজিববর্ষের আগেই সহযোগী সংগঠনগুলোকে ঢেলে সাজানের অংশ হিসেবে হঠাৎ করেই যুবলীগের সপ্তম জাতীয় কংগ্রেসের তারিখ চূড়ান্ত করা হয়। গত রোববার (২০ অক্টোবর) যুবলীগের কংগ্রেসের প্রস্তুতি হিসেবে গণভবনে যুবলীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী। ওই বৈঠকে যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান হিসেবে নানকের ‘অনুপস্থিতি’ রাজনৈতিক মহলে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

Nanok
জাহাঙ্গীর কবির নানক

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুবলীগের কয়েকজন নেতা বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে যুবলীগও নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে একটা সিন্ডিকেট। সাবেক চেয়ারম্যান হিসেবে যুবলীগে নানকের একটা প্রভাব আছে সংগঠনটিতে। এখনো অনেক কিছুই তার ইশারাতে হয়। চলমান শুদ্ধি অভিযানে যারাই বিতর্কিত হয়েছেন তাদের দূরে সরিয়ে রাখছেন প্রধানমন্ত্রী। এমনকি তাদের মুখোমুখিও হতে চান না তিনি। যুবলীগ নিয়ে নানা তথ্যই এখন প্রধানমন্ত্রীর হাতে। প্রধানমন্ত্রী যদি কাউকে দূরে রাখেন সেটাও অনেক ইঙ্গিতপূর্ণ। আর সেটি বুঝতে হলে আগামী কাউন্সিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

রোববার (২০ অক্টোবর) রাতে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোতে ধূমপানরত অবস্থায় টিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ে নানকের ‘দুঃসময়ের’ ষোলকলা যেন পূর্ণ হয়েছে।

সার্বিক অভিযোগগুলো নিয়ে তার মন্তব্যের জন্য সোমবার সন্ধ্যায় জাহাঙ্গীর কবির নানকের মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলে তিনি কল রিসিভ করেননি। এসএমএস পাঠিয়েও তার কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর