দাবি যৌক্তিক, আন্দোলনের পদ্ধতি অযৌক্তিক

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-30 18:17:41

বাংলাদেশের ক্রিকেটে এত বড় ঘটনা আগে ঘটেনি। অনেকেই ২০০০ সালের ধর্মঘটের কথা বলেন। তবে সেটা টেস্টপূর্ব বাংলাদেশের ঘটনা। বাংলাদেশের ক্রিকেট লায়েক হওয়ার পর এটাই সবচেয়ে বড় ধাক্কা। বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন যে পর্যায়ে আছে, তাতে এটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করার কথা। ক্রিকেট বিশ্বেই আলোড়ন সৃষ্টি করবে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের এই ধর্মঘট।

বিপিএল থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজি তুলে দেয়ার পর থেকেই ক্রিকেটারদের মধ্যে অসন্তোষের খবর আসছিল। তবে ধর্মঘটের ঘোষণাটা এসেছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। অন্তত দুটি পত্রিকায় সাকিব আল হাসানের সাক্ষাৎকারেও ইঙ্গিত ছিল। সোমবার সকালে দুয়েকজন ফেসবুকে জানাচ্ছিলেন, ক্রিকেটে বড় খবর আসছে। কিন্তু খবরটা কত বড়, তা ধারণাও করা যায়নি।

সুনির্দিষ্ট ১১ দফা দাবিতে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা সব ধরনের ক্রিকেট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। নির্দিষ্ট কোনো সংগঠনের অধীনে দাবি জানানো না হলেও ক্রিকেটাররা বেশ সংগঠিতভাবেই দাবি তুলে ধরেছেন। সাকিবই নেতা, তবে একেকটি দাবি সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন একেকজন ক্রিকেটার। তাতে পুরো আন্দোলনে সবার সম্পৃক্ততার একটা বার্তা ছড়িয়ে দেয়া গেছে।

মাশরাফি বিন মর্তুজা ছাড়া বাকি সব ক্রিকেটারই আছেন এই আন্দোলনে। মাশরাফি কেন নেই, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে নজর দেয়া যাক, ক্রিকেটারদের দাবি প্রসঙ্গে। ক্রিকেটাররা সবাই মিলে যে ১১টি দাবি তুলে ধরেছেন, তার সবগুলোই যৌক্তিক। শুধু যৌক্তিকই নয়, এ আন্দোলনের সৌন্দর্য হলো—ক্রিকেটাররা শুধু নিজেদের স্বার্থের কথা বলেননি, বলেছেন সামগ্রিক ক্রিকেটের স্বার্থের কথা। এই আন্দোলনের সামনে যারা আছেন, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহরা চাইলে চুপ করে, এড়িয়ে গিয়ে বোর্ডের কাছে ভালো থাকতে পারতেন। কারণ এই ১১ দফায় তাদের স্বার্থের কথা খুব বেশি নেই।

কিন্তু এই আন্দোলনের মূল থিমই হলো—‘রেসপেক্ট ফিউচার’। সিনিয়র ক্রিকেটাররা চান নতুন যারা ক্রিকেট খেলতে আসবেন, তারা যেন একটা ভালো পরিবেশ পান, ভালো সুযোগ-সুবিধা পান, আর্থিক নিশ্চয়তা পান। এই আন্দোলনে যেন সুকান্তের সুর— এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।

আন্দোলনের খবর শোনার পর আমার এক সহকর্মী বললেন, ক্রিকেটাররা তো কোটি কোটি টাকা কামায়, তাদের বেতন আরো বাড়াতে হবে কেন? আমি বললাম, প্রথমত জাতীয় দলের ৫/৬ তারকা ক্রিকেটার ছাড়া আর কেউই কোটি কোটি টাকা কামাতে পারেন না। দ্বিতীয় কথা হলো, তাদের দাবি শুধু বেতন বাড়ানোর নয়। তবে সত্যি কথা হলো, দাবিগুলো এতই যৌক্তিক, শুনে অবাক হতে হয়; একটি টেস্ট প্লেয়িং দেশে এইসব বিষয়ে দাবি জানাতে হয় কেন? ভালো মানের বল দিতে হবে, কোচ-ফিজিও দিতে হবে, বিভাগীয় পর্যায়ে প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা করতে হবে, ঘরোয়া ক্যালেন্ডার ফিক্সড করতে হবে, ভালো হোটেলে রাখতে হবে, ভ্রমণ ভাতা বাড়াতে হবে। এসবই একটি টেস্ট প্লেয়িং দেশের প্রাথমিক শর্ত।

ক্রিকেটারদের তুলে ধরা সবগুলো দাবিই যৌক্তিক। কিন্তু আমার কাছে আন্দোলনের ধরনটা অযৌক্তিক মনে হয়েছে। ক্রিকেটাররা তাদের দাবিগুলো নিয়ে বোর্ডের সাথে কথা বলতে পারতেন, বোর্ডকে আলটিমেটাম দিতে পারতেন। কিন্তু কোনোরকম আলোচনা ছাড়াই সরাসরি দাবি দিয়ে ধর্মঘটে যাওয়াটা অযৌক্তিক। পরিবহন শ্রমিকরা যেমন ধর্মঘট ডেকে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে দাবি আদায় করতে চায়, আমাদের প্রিয় ক্রিকেটারদের মধ্যেও তেমন প্রবণত দেখা গেছে। এটা না হলে খেলবো না—এটা ছেলেমানুষি এবং দুঃখজনক। এই আন্দোলনের আইডিয়া মনে হয় সাকিবের মাথা থেকে এসেছে। কারণ এর আগে একবার সাকিব ব্যক্তিগতভাবে তার দাবি মানা না হলে দেশের হয়ে না খেলার হুমকি দিয়েছিলেন।

দাবি যতোই যৌক্তিক হোক, ভারত সফরকে সামনে রেখে ধর্মঘটে যাওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক। কোনোভাবেই দেশকে জিম্মি করার সুযোগ কারো নেই। আমার ধারণা, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ দল ভারত সফরে যাবে। তবে তার আগে খেলোয়াড়দের এই আন্দোলন, দলের মনোবলে চিড় ধরাবে, আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করবে।

অন্যায় হলে আন্দোলন হবে, প্রতিবাদ হবে; কিন্তু সেটা ক্রিকেটকে জিম্মি করে নয়। আন্দোলন করে করে একসময়ের প্রবল প্রতাপশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট এখন তলানিতে। আন্দোলনের কথা শুনে তাই আমার মনে কু-ডাক ডাকছে। আমাদের অনেক ভালোবাসার বাংলাদেশ ক্রিকেট কোনো বিপদে পড়বে না তো!

বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন অবাক হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন। তার দাবি, ক্রিকেটাররা সব বিষয় নিয়ে তার সাথে যোগাযোগ করেন। সেখানে এই দাবি নিয়ে তার সাথে কথা বললো না কেন, এটাতে তিনি বিস্মিত। পাপনের দাবি, বাংলাদেশের ক্রিকেটের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ এই আন্দোলন। ষড়যন্ত্র কিনা আমি জানি না, বিশ্বাসও করতে চাই না। আমি বিশ্বাস করতে চাই, ক্রিকেট নিয়ে আমরা যেমন গভীর আবেগ পোষণ করি, ক্রিকেটরাদের কাছেও দেশ সবার আগে।

তবে একটা বিষয় নিয়ে আমার খটকা কিছুতেই যাচ্ছে না। বাংলাদেশের ক্রিকেটে এখন একটা পরিবর্তন চলছে। ধীরে ধীরে মাশরাফির কাছ থেকে নেতৃত্ব বুঝে নিচ্ছেন সাকিব আল হাসান। ইতিমধ্যেই টেস্ট ও টি-২০ দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পেয়েছেন সাকিব। তবে এখনও বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি। গত নির্বাচনের আগে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। আাওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়া এবং বিশ্বকাপের বাজে পারফরম্যান্সে তার জনপ্রিয়তা কমেছে বটে, তবে এখনও মাশরাফিই বাংলাদেশের ক্রিকেটের আইকন। তাকে বলা হয়, বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক। শুধু বাংলাদেশ নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও মাশরাফির নেতৃত্ব গুণ প্রশংসিত। সেই মাশরাফি এত বড় আন্দোলনে নেই। এটা বিস্ময়কর।

সিনিয়র ক্রিকেটাররা সবাইকে এক করে ফেললেন, আর বোর্ড বা মাশরাফি কিছুই জানলেন না, এটাও অবিশ্বাস্য। মাশরাফি কেন নেই? এই প্রশ্নের জবাব জানাটা জরুরি। মাশরাফিকেও এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তিনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। মাশরাফি লিখেছেন, ‘অনেকেই প্রশ্ন করছেন যে, দেশের ক্রিকেটের এমন একটি দিনে আমি কেন উপস্থিত ছিলাম না। আমার মনে হয়, প্রশ্নটি আমাকে না করে, ওদেরকে করাই শ্রেয়। এই উদ্যোগ সম্পর্কে আমি একদমই অবগত ছিলাম না। নিশ্চয়ই বেশ কিছু দিন ধরেই এটি নিয়ে ওদের আলোচনা ছিল, প্রক্রিয়া চলছিল। কিন্তু এ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। সংবাদ সম্মেলন দেখে আমি ওদের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে পেরেছি। ক্রিকেটারদের নানা দাবির সঙ্গে আমি আগেও একাত্ম ছিলাম, এখনো আছি। আজকের পদক্ষেপ সম্পর্কে আগে থেকে জানতে পারলে অবশ্যই আমি থাকতাম। মিডিয়ায় ওদের খবর দেখার পর থেকে হাজারবার আমার মাথায় এই প্রশ্ন এসেছে যে, কেন আমাকে জানানো হলো না। অনেকে আমার কাছে জানতেও চেয়েছেন। কিন্তু আমি নিজেও জানি না, কেন জানানো হয়নি। তবে আমার উপস্থিত থাকা কিংবা না থাকার চেয়ে, ১১ দফা দাবি বাস্তবায়িত হওয়াই বড় কথা। সবকটি দাবিই ন্যায্য, ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের মঙ্গলের জন্য জরুরি। আমি মাশরাফি বিন মর্তুজা, ১১ দফা দাবি শান্তিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হওয়ার পক্ষে আছি, থাকব।‘

মাশরাফির না থাকা সম্পর্কে আমার নিজের একটা ব্যাখ্যা আছে। সাকিব বাংলাদেশের সেরা পারফরমার হলেও নেতৃত্ব গুণে তার ঘাটতি আছে। সাকিব জানেন, স্বাভাবিকভাবে পরিবর্তনটা হলে তিনি কখনোই মাশরাফির নেতৃত্বের ছায়া থেকে বেরুতে পারবেন না। তাই মাশরাফিকে ছাড়িয়ে নিজেকে নেতা করে তুলতেই সাকিব এই আন্দোলন নিয়ে মাঠে নেমেছেন। এ আন্দোলনে সফল হলে সাকিব হয়ে যাবেন, দেশের ক্রিকেটারদের সত্যিকারের নেতা।

যত যাই হোক, কে বড় নেতা, কার কী দাবি এসবের চেয়ে দেশ অনেক বড়। পাপন দাবি করেছেন, ক্রিকেটাররা যে দাবিগুলো জানিয়েছেন, সেগুলো আগে থেকেই আছে; দাবি করার কিছু নেই। টুকটাক যেগুলো আছে, কথা বললে সেগুলোও মিটে যাবে। আমি চাই ক্রিকেটারদের সবগুলো দাবি মেনে নেয়া হোক। তবে ক্রিকেটারদের কাছে আবেদন, তারা যেন দেশকে জিম্মি করে দাবি আদায়ের চেষ্টা না করেন। দেশ যেন সবার ওপরে থাকে।

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

এ সম্পর্কিত আরও খবর