নুসরাত হত্যা: শাস্তি, স্বস্তি ও শঙ্কা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-22 18:22:50

ফেনীর চাঞ্চল্যকর নুসরাত হত্যা মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে। মামলার রায় হয়েছে দ্রুততম সময়ে। আসামীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

এই ধরনের শাস্তিকে দৃষ্টান্তমূলক বলে চিহ্নিত করা হয়। এমন রায়ে অপরাধীদের শাস্তির পাশাপাশি অপরাধচক্রকে কঠিন বার্তা জানানো হয় এবং সমাজে এরূপ রোমহর্ষক অপরাধ করতে যেন কেউ উৎসাহিত না হয়, তারও প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দেওয়া হয়।

স্বাভাবিকভাবেই এ রায়ে ক্ষতিগ্রস্ত নুসরাতের পরিবার, ফেনীবাসী এবং দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ খুশি। আশা করা যায়, এতে স্বস্তির পরিবেশ বিরাজমান হবে এবং অপরাধমূলক মানসিকতার অধিকারীরা সতর্ক ও ভীত হবে।

কিন্তু বাস্তবে এমন হয়নি। শাস্তি ও স্বস্তির পিছুপিছু কিছু শঙ্কার চিত্রও দেখা যাচ্ছে। বিরাজমান শঙ্কার দুটি দিক আছে। একটি স্থানীয় স্তরের এবং আরেকটি জাতীয় স্তরের।

স্থানীয় স্তরের শঙ্কার মধ্যে দেখা যাচ্ছে, মাদ্রাসায় নুসরাত হত্যার মূল আসামীর নাম এখনও ঝুলছে এবং নুসরাত পরিবার রয়েছে নিরাপত্তাহীনতায়।

আরো পড়ুন: নুসরাত হত্যা: মাদ্রাসা থেকে মুছে যায়নি সিরাজের নাম

আরো পড়ুন: দণ্ডপ্রাপ্তদের হুংকারে আতঙ্কিত নুসরাতের পরিবার

নুসরাত হত্যাকারীচক্র আইন ও সমাজকে প্রভাবিত করে হত্যাকে আত্মহত্যা বলে সাজাতে চেয়েছিল। হত্যার মতো জঘন্য ঘটনার পক্ষে সংঘবদ্ধ হয়ে মাঠে নেমেছিল এবং প্রকাশ্যে আন্দোলন শুরু করেছিল। এমন নিকৃষ্ট মানসিকতার লোকজন গোপনে কত কিছু করতে পারে, তার ইয়ত্তা নেই।

ফলে কঠিন অপরাধের শাস্তি ও স্বস্তির পরেও ভয় আর শঙ্কা মুছে যাচ্ছে না। স্থানীয় স্তরে ভিকটিমের পরিবার ও শান্তিপ্রিয় মানুষ একটি আশঙ্কার মধ্যে আবর্তিত হচ্ছেন। অপরাধে জড়িতরা যদি সমাজ ও প্রশাসনকে প্রভাবিত করার অপচেষ্টা করতে পারে, তবে তারা গোপনে কি না করতে পারে? এমন ভীতিও সৃষ্টি হয়েছে সঙ্গত কারণে। যেজন্য অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতের পাশাপাশি তাদের দম্ভ, শক্তি, সামাজিক ও পেশাগত প্রতিপত্তি এবং ক্ষতি করার সাহস ও ক্ষমতাকেও মিটিয়ে দিতে হবে। নচেৎ রোমহর্ষক অপরাধের হার কমবে না।

জাতীয় স্তরে শঙ্কার বিষয় হলো এটাই যে ফেনীর নুসরাত ও বুয়েটের আবরার হত্যায় অতিদ্রুত কার্যক্রম নেওয়া হলেও দেশের অপরাধী চক্র হুশিয়ার হয়নি। বরগুনা, কটিয়াদি, সুনামগঞ্জ ইত্যাদি জায়গায় নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। শিশু হত্যা করা হয়েছে। বাসে নার্সকে ধর্ষণের পর নির্মমভাবে মারা হয়েছে। পায়ুপথে বায়ু প্রবেশ করিয়ে অতি বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দিয়ে হত্যা করা হয়েছে একাধিক শিশু-কিশোরদের।

ফেনীর মাদরাসায় নুসরাতকে হত্যার পর বিভিন্ন মাদরাসায় যৌন নির্যাতন থেমে যায়নি। ধর্ষণ ও লাগাতার ধর্ষণের ঘটনা অবিরাম চলছে। এমতাবস্থায়, ফেনীর নুসরাত হত্যায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হলেও অপরাধ কমছে না বা অপরাধী চক্র নিবৃত্ত হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতি অবশ্যই শঙ্কার সৃষ্টি করে।

অপরাধীরা মনে হচ্ছে শাস্তিরও পরোয়া করছে না যেন। এই বেপরোয়া মনোভাবের কারণ অনুসন্ধান করা দরকার। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি বিশেষ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ারও প্রয়োজন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমনের মতো নৃশংস ও রোমহষর্ক অপরাধের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিষয়টিও সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় আনতে হবে।

শঙ্কা যেন অপরাধের শাস্তি ও স্বস্তির চেয়ে বড় হয়ে না দাঁড়ায়, তা দেখা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। অপরাধের শাস্তির পর যদি পরিস্থিতির উন্নতি না হয় তাহলেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। শাস্তির পর স্বস্তিকে স্থায়ী করতে হবে। শঙ্কাকে শাস্তি ও স্বস্তির চেয়ে বড় হতে দেওয়া কোনোক্রমেই উচিত হবে না।

 

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম এবং অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর