শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি ও প্রাসঙ্গিক কথা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মাছুম বিল্লাহ | 2023-08-25 22:30:56

দীর্ঘ সাড়ে নয় বছর অপেক্ষার পর ২৭৩০টি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওর আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে এবং ২০১৯-২০ অর্থ বছর থেকেই এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। এটি বর্তমান সরকারের একটি প্রশসংনীয় পদক্ষেপ।

আমরা জানি, সর্বশেষ ২০১০ সালে ১ হাজার ৬২৪টি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছিল। এরপর থেকে শিক্ষকদের বহু আন্দোলন হয়েছে। এতদিন পরে হলেও একসঙ্গে এতগুলো প্রতিষ্ঠানকে এমপিও দেওয়া এক বিরাট সাহসের ব্যাপারও বটে। ধন্যবাদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে তথা বর্তমান সরকারকে। এই উদ্দেশ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এমপিওভুক্ত নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাযথ নীতিমালা মেনে চলার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, " আপনারা নীতিমালা অনুযায়ী সব নির্দেশনা পূরণ করতে পেরেছেন বলে এমপিওভুক্ত হয়েছেন। কাজেই এটি ধরে রাখতে হবে। কেউ যদি এটি ধরে রাখতে ব্যর্থ হন, সাথে সাথে তার এমপিওভুক্তি বাতিল হবে। কারণ, এমপিওভুক্তি হয়ে গেছে, বেতন তো পাবই, ক্লাস করানোর দরকার কী, পড়ানোর দরকার কী, এ চিন্তা করলে কিন্তু চলবে না।" মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন।

রাষ্ট্রীয় অনেক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই, সরকারি বিধায় তারা জনগণকে সেবা দিতে চান না, কারণ সেবা দিলেও তাদের বেতন আছে, না দিলেও বেতন আছে।

নতুনভাবে এমপিওভুক্ত হওয়া স্কুল ও কলেজের সংখ্যা ৬৫১টি, মাদরাসার সংখ্যা ৫৫৭টি এবং কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫২২টি। সম্পূর্ণ নতুন স্কুল-কলেজ এমপিওভুক্ত হয়েছে ৬৮০টি এবং প্রতিষ্ঠানের নতুন স্তর এমপিওভুক্ত হয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯৭১টি।

নতুন এই এমপিওভুক্তির কারণে মোট ব্যয় হবে ৮৮১ কোটি টাকা।

বর্তমানে এমপিওভুক্ত আছে ২৮ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করতে এমপিওখাত থেকে প্রতি বছর ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়।পুরো টাকাটাই জনগণের। কাজেই জবাবদিহিতা এখানে থাকতেই হবে।

আগে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বেতনের টাকা সরাসরি প্রতিষ্ঠানে চলে যেত। ফলে, অনেক শিক্ষক বেতনের টাকা ঠিকমতো পেতেন না। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষকদের অ্যাকাউন্টে সরাসরি বেতন পাঠানো শুরু হয়। এই অবস্থা চালুর পর ৬০ হাজার ভুয়া শিক্ষক আবিষ্কৃত হলো। এ কেমনতর দুর্নীতি শিক্ষা বিভাগে? এর অর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় খাতের বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় যা শিক্ষকদের নামে টাউট বাটপাররা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিত। এ অবস্থার অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এখনও শিক্ষা বিভাগের জেলা উপজেলা অফিস থেকে শুরু করে মাউশি ও মন্ত্রণালয় পর্যন্ত নাকি ঘুষের কালচার চালু আছে। আশা করি, অচিরেই এসব কালো কালচার শিক্ষা বিভাগ থেকে চিরতরে বিদায় নেবে।

যোগ্য নির্বাচিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই এমপিওভুক্ত করা হয়েছে দাবি করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘কিছু উপজেলা রয়েছে যেখান থেকে এমপিওভুক্তির জন্য কোনো আবেদনই আসেনি। আবার নারী শিক্ষা, পাহাড়ি অঞ্চলসহ অনগ্রসর এলাকা বিবেচনা করে নীতিমালা অনুযায়ী কিছু প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। তবে, খুব কমই উপজেলা রয়েছে যেখান থেকে প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়নি।’ অর্থাৎ এবার এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে মোটামুটি ইউনিফর্মলি নিয়ম মানা হয়েছে।

আমি কয়েকজন শিক্ষক নেতার সাথে কথা বলেছি, তারাও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এমপিও মানে মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার। এমপিওভুক্ত হলে একজন শিক্ষক সরকারি কোষাগার থেকে একজন সরকারি শিক্ষকের মূল বেতন স্কেলের সমপরিমাণ ও তার সাথে কিছু বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা পান এমপিওভুক্তরা। এমপিওভুক্তির ঘোষণার ফলে বহু শিক্ষক কর্মচারীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পুরণ হলো।

২০১০ সালে এমপিওভুক্তির সময় প্রতিষ্ঠান ছিল ১ হাজার ৬২৪টি। অথচ সুবিধাভোগী শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার। অথচ এবার এমপিওভুক্ত করা হলো ২৭৩০ প্রতিষ্ঠান, কিন্তু সুবিধাপ্রাপ্তদের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ১০ থেকে ১২ হাজারের মতো।

নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি বলেছেন, তারা চেয়েছিলেন স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি; যেটি করা হয়নি। তিনি বলেন, ‘সারাদেশের ছয় হাজার ১৪১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৭৫ থেকে ৮০ হাজার শিক্ষক এমপিওভুক্তির অপেক্ষায় ছিলেন। সরকারের বর্তমান সিদ্ধান্তে মাত্র ১০ থেকে ১২ হাজার শিক্ষক এমপিও সুবিধার আওতায় এলেন। বাকি ৬০-৬৫ হাজার শিক্ষক বঞ্চিতই থেকে গেলেন।’ এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসব প্রতিষ্ঠান ও এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এদেশেরই সন্তান। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করার দায়িত্বও কিন্তু রাষ্ট্রেরই। যে দায়িত্ব থেকে রাষ্ট্র সড়ে এসেছে। রাষ্ট্রের যুক্তি হচ্ছে, এগুলো অপরিকল্পিতভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে কেন প্রতিষ্ঠা করা হয়, করা হলে রাষ্ট্রের কী দায়িত্ব রয়েছে সে বিষয়ে সঠিক নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। শুধুমাত্র একটি যুক্তি দেখিয়ে অবজ্ঞা করা বা দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।

চলতি অর্থ বছরে স্কুল ও কলেজ এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগে বরাদ্দ ছিল ৮৬৫ কোটি টাকা। কিন্তু এমপিও পাওয়া প্রতিষ্ঠানের পেছনে বছরে ব্যয় হবে ৪৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। যোগ্য প্রতিষ্ঠান না পাওয়ায় ৪১৪ কোটি টাকা ব্যবহার করতে পারল না শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এবার ৮৯টি উপজেলা যোগ্যতাসম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠানও পাওয়া যায়নি এমপিওর জন্য। তবে এমপিও নীতিমালা ২০১৮-এর ২২ ধারা অনুযায়ী নারীশিক্ষায় অগ্রাধিকার, দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকা, চরাঞ্চল ইত্যাদি বিবেচনা করে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০০ এবং স্বীকৃতির মেয়াদ দুই বছর ধরে এসব উপজেলা থেকে ৫৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। আবার ৩১টি উপজেলা থেকে কোনো প্রতিষ্ঠানকেই এমপিওভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। আর ২৩টি উপজেলা থেকে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য আবেদনই করেনি। একটি প্রতিষ্ঠান দেখলাম সরকারি ঘোষণা করা হয়েছে অথচ আবার এমপিওভুক্তিতে নাম এসেছে। ইতিমধ্যে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের নামও পুনরায় এমপিওভুক্তির তালিকায় চলে এসেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়েছে যাদের শিক্ষক নেই, শিক্ষার্থী নেই, শিক্ষাগৃহ নেই কিন্তু এমপিওভুক্ত হয়েছে। এগুলো কোন ধরনের ভুল? ডিজিটাল না ইচ্ছাকৃত?

 

মাছুম বিল্লাহ: ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত এবং ভাইস-প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ টিচার্স এসোসিয়েশন (বেল্টা), সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর