গত কয়েক দিনে শিকলে বাধা এক ঘুমন্ত শিশুর ছবি ফেসবুকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। শিশুটির মা তাকে এভাবে রেখেই কাজে যান নিত্যদিন। এর আগে যশোরের এক প্রতিবন্ধী সন্তানকে শিকলে বেধে রেখে মায়ের কাজে যাওয়ার ছবি আমরা দেখেছিলাম। এসব ছবি ক্রমশ প্রতিদিনের পথ চলতে দেখা স্বাভাবিক ছবিতে পরিণত হচ্ছে। কর্মজীবী মায়ের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু তাদের কাজের পরিবেশ নারীবান্ধব হচ্ছে না। কেউ এগিয়ে আসছে না তার কোলের শিশুটার একটা নিরাপদ আশ্রয়ের টেকসই সমাধান নিয়ে।
দিনাজপুর থেকে রেলগাড়িতে ফিরছিলাম। আমার আসনের সাথে আরো দুই আসন নিয়ে চাদরে মুখ ঢেকে শুয়ে আছেন একজন। উল্টোদিকের সীট খালি। একবার ভাবলাম সেখানেই বসি। চাঁদর ঢাকা শরীরটায় প্রাণ আছে বোঝা যায়। নারী না অনারী বোঝা যাচ্ছে না। উল্টো দিকের আসনে বসা যায় কিন্তু সে আসনের মালিক আসার পর যেমন আদর যত্ন খোঁজখবর করেন তাতে গাগুলিয়ে বমির ভাব এসে যায়। তাই সাহস করে ডাকাডাকি করতেই উঠে বসলেন চাদর ঢাকা মানুষ। তিনি রেলের একজন নারী নিরাপত্তাকর্মী। বোদায় বাড়ী। ঈশ্বরদীতে পোস্টিং। দুই লাখ বিশ হাজার টাকায় চাকরিটা পেয়েছেন। ডিগ্রী পর্যন্ত পড়ার ইচ্ছা আছে। মাসে এক দুইবার মাকে দেখতে বাড়ী যান। বস এলাকার মানুষ ভালো লোক তার স্ত্রীর সাথে খাতির আছে। গৃহকর্মের কাজে তাকে সাহায্য করেন প্রাণ খুলে। তাই মাসে দুই একবার ফাউ ছুটি মিলে যায় ‘মাকে দেখবার যাইতে পারে’।
আমার আসন ছেড়ে দিয়ে কোনার আসনে গুটিসুটি দিয়ে বসে।নিজের আসনে বসে সামনে তাকাতে দেখি বছর দেড়েকের এক ফুট ফুটে মেয়ে বসে আছে। মুখ দিয়ে অস্ফুট আওয়াজ বের করার চেষ্টা করছে। কোথা থেকে এলো এই দেবশিশু? নিরাপত্তা কিশোরীর সাথে হালকা দু’একটা কথা বলার ফাঁকে এই শিশুটির আগমন ঘটেছে।
গাড়ী ছাড়ার তোড়জোড় চলছে। কিন্তু এই শিশুটি কার? পাশের কামড়ার কারো কি? ব্যাংকারে কেউ নেই তো ? উঠে দাঁড়াই ইতিউতি চায় না কেউ নেই। শিশুটি এক মনে মুখে একটা আঙ্গুল দিয়ে গলা দিয়ে গরগর আওয়াজ করছে। তার কোনো হিলদোল নাই, বড়ই নিশ্চিন্ত সে। রেলের শেষ বাঁশি আর ষ্টেশন ছাড়ার ঘণ্টা বেজে যেতে যেতে হুরমুর করে আমাদের কামড়ায় তিনটা ব্যাগ আর বাক্স নিয়ে ঢুকলেন এক তরুণ।
শিশুটি দুলে দুলে তার পিতাকে স্বাগত জানাল। আমি দরজার দিকে উকি দেই। গাড়ি ছেড়ে দেয়। আমার অজান্তইে আমি ককিয়ে উঠি ‘ওর মা উঠতে পারেনি? আমার চোখে মুখে আতংকের ছাপ দেখে তরুণ হাসেন। আমাদের একটা টিকেট, ও আমার কোলে বসবে। আমরা মানে আমি আর ওর মা ঢাকায় থাকি। আমাদের মেয়ে থাকে ওর নানীর কাছে বিরলে। ওর ছোটখালা পোয়াতী। আমার শাশুড়ি যাবে সেখানে। তাই মেয়েকে নিতে এসেছিলাম। আমরা দু’জনেই চাকরি করি। সাত মসজিদ রোডে একই অফিসে দু’জন চাকরি করি। পোশাক কারখানার মালামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। আমদানি রফতানির কাজও আছে। জমজমাট অফিস, কিন্তু অফিসে কেউ কোলের শিশুকে নিয়ে আসতে পারে না। তাই দুই মাস বয়স থেকেই শিশু থাকে নানীর কাছে। মায়ের দুধ পায়নি দু’মাসের পর থেকে। টিনের দুধ, গুড়ো দুধ খেয়ে বড় হচ্ছে আমাদের নতুন প্রজন্ম, মাকে ছাড়া বাবাকে ছাড়া অনেক দূরের এক জনপদে। একটু পরেই শিশুটির হাসিখুশি ভাব চলে গেলো। সে এখন ঘুমাবে। নানীর কোলের ওম রেলের বগীতে নেই। নানীর পুরাতন শাড়ি দিয়ে বানানো কাথায় মুড়ে বাবার কোলে কি সে ওম আসে। শিশু বিরক্ত হয়। ঢাকা থেকে ফোন আসে মা অফিস থেকে চুপি চুপি ফোন করেছে মনে হলো, তার চাপা স্বরের কথা শুনে। মোবাইলের পর্দায় ভেসে ওঠে মায়ের ছবি। দেড় বছরের শিশু পরিষ্কার ডাকে মা। ওপার থেকে অস্ফুট স্বর ভেসে আসে- আবার বলো আবার বলো। শিশু আর মা বলে না, সে শুধু গলা দিয়ে গড় গড় আওয়াজ করে। মোবাইল নিয়ে শিশুটা খেলতে থাকে। বাবার একটু জিরোবার ফুরসৎ মেলে। উপর থেকে ঝোলা নামিয়ে শিশুর বালিশ বের করে। দুধের বোতল, ফ্লাক্সে গরম পানি, কৌটাতে গুড়া দুধ। শিশু চুপচাপ খেলা করে মোবাইল সেট নিয়ে।
আমি তরুণ বাবাকে শিশু সুরক্ষার মন্ত্র পড়াই। মোবাইল দিতে না করি। তরুণ বাবা মুচকি হাসে কোনো বিরোধে যায় না বলে দেই না তো। দেবে কোথা থেকে? থাকে তো নানীর কাছেই। তবে শিশুটির এই বিনোদন যন্ত্রটি নাড়াচাড়া থেকে মনে হলো নানা-নানী নিশ্চয়ই তাকে মোবাইল সেট দিয়ে বসিয়ে রাখে। রেলগাড়ি চলতে চলতে এসে থামে পার্বতীপুর। এবার এক মা ওঠেন। সাথে বেশ কয়েকজন আসনের নীচে বস্তা, ব্যাংকারের উপরে বস্তা, কোনটায় অসময়ের কাঁঠাল, কোনটায় সময়ের তাল, কাটারি ভোগ, ডাল আরো কতো কি! এর মধ্যেই ফেলে আসা ছাতুর বস্তার জন্যে হায় আফসোস । সাথে কেউ যাবে না সবাই একে এক নানা পরামর্শ দিতে দিতে নেমে যান। প্রবীণার বয়স হয়েছে। কোনো সাহায্য ছাড়া চলতে পারেন না। আমাকে বলে বাপ টয়লেট কই। চলন্ত গাড়ীতে তাকে টয়লেটে নিয়ে যাওয়া এক সার্কাস। সওয়াবের আশায় অনেকেই হাত বাড়িয়ে দেয়। ফিরে এসে তিনি সেই শিশুর সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করেন। ফেলে আসা নাতিপুতির কথা হয়তো তার মনে পড়েছে। একটা টুক টুকে পেয়ারা বের করেন কোনো এক পোটলা থেকে। প্রবীণ মার ফোন আসা শুরু হয় একের পর এক। কখনো বৌ-মা, কখনো কন্যা কখনো পুত্র। সাত ছেলে মেয়ে তার অসংখ্য নাতিপুতি আর তাদের ছেলে মেয়ে। সবাই প্রবীণার খোঁজ নিচ্ছেন। টের পেলাম তাদের কেউ থাকে জয়দেবপুর, কেউ উত্তরা, তিনি যাবেন বাসবো ছোট ছেলের কাছে। কদমতলায় থাকে তার মেজো মেয়ে। প্রত্যেকের হিস্যা তিনি নিয়ে যাচ্ছেন সঙ্গে। তারা জানতে ব্যস্ত কখন থামবে গাড়ী জয়দেবপুরে, এয়ারপোর্ট স্টেশনে তাদের বস্তাটা যেন হাতের কাছে থাকে। জানালা দিয়ে নামিয়ে দিতে পারবে না? কোন সাথী যাত্রীকে বললেই হবে। এসবই আলাপের মূল বিষয়। আহারে সাত সন্তানের জননী।
রেলগাড়ি এবার থামে ফুলবাড়ি সেশনে। রক্ত লাল ফুলবাড়ির কথা মনে হয়। একটু অন্যমনস্ক হয়ে যাই। রক্ত কি বৃথা গেলো। হঠাৎ এক নারী যাত্রী উঠে ঝাঁঝালো গলায় বলতে থাকেন- সব সীট আমাদের, আপনারা জায়গা ছাড়েন। তারা স্বামী-স্ত্রী দুইজন কিনেছেন চারটা সীট, শুয়ে বসে যাবেন বলে। কিন্তু তার ভাষায় তার আক্কেলবিহীন স্বামী কিনেছেন একদিকে দুইটা সীট আর অন্য দিকে দুইটা। এটা বুঝতে তার ২০ মিনিট সময় চলে গেলো। সকলের টিকেট আর নাম্বার দেখলেন তিনি। তারপর পড়লেন বেআক্কেল স্বামীকে নিয়ে। এরকম বোকা তিনি সাত জন্মেও দেখেননি। বেচারা কাঁচুমাচু।যাত্রীরা এগিয়ে আসে কাঁচুমাচু স্বামীকে উদ্ধারে। এক পাশের সীট খালি করে সবাই অন্য পাশে গিয়ে বসে। শিশুটি আমার কোলে মাথা রাখে পা দেয় প্রবীণের কোলো। তোমার এই বোকামির জন্যই বাড়ীর সামনের জায়গাটা আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেলো। দেশের বাড়ীর জমিজমা ভাগ করতে এসেছিলেন ফুলবাড়িতে শ্বশুরের ভিটায়। ফোন আসতে থাকে দেশ বিদেশের প্রন্সিপালাদের (মক্কেল) কাছ থেকে। দাম দর চলে ইংরেজিতে। ইমেইল পাঠান গাড়ী থেকেই। ইন্টারন্যাশনাল কল করেন। সহযাত্রীদের জানিয়ে দেন অস্ট্রেলিয়ায় এখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। সকাল হয়নি ফ্রান্সে। আমাদের রাত নেই দিন নেই। এর মধ্যেই স্বামী তার পোটলা থেকে খাবার বের করেন স্ত্রীর পছন্দের টুকরাটা মেলে ধরেন। নিজে চিপস খান। আমি ভাবি এক দেশ কত জীবন এক কামড়াতেই চার ভিন্ন জীবনের নারী। শুধু মনে হয় আহা দুধের শিশুটা যদি মায়ের সাথে থাকতে পারতো। নারী নিরাপত্তাকর্মী যদি একটু নিজের নিরাপত্তা পেতো। প্রবীণের সাথে যদি তার সন্তানরা একটু মানুষের মতো আচরণ করতো। করপোরেট নারীদের জন্যও আমাদের স্পেস দিতে হবে। এক পাশে সরে বসতেই হবে বিনা বাক্য ব্যয়ে।
গওহার নঈম ওয়ারা: শিক্ষক, লেখক