রাঙ্গার বোধোদয়!

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-08-19 15:02:04

অবশেষে জাতীয় পার্টি (জাপা)-এর নেতা মশিউর রহমান রাঙ্গা স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামের শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইলেন। রাঙ্গার এই বোধোদয় তার নিজের ও দলের জন্য স্বস্তি নিয়ে এসেছে। তার বক্তব্যের কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্ট একটি উত্তপ্ত ও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি কিছুটা হলেও আপাতত শান্ত হয়েছে।

আরও পড়ুন: নূর হোসেনের পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইলেন রাঙ্গা

স্বৈরাচারী এরশাদ মারা গেলেও তার দলে যেন রয়ে গিয়েছিল স্বৈরপ্রেতাত্মা। ছিল স্বৈরাচারসুলভ দম্ভ প্রকাশ। মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জনপদ বাংলাদেশে যা মোটেও কাম্য ছিল না।

'গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক' স্লোগানে উচ্চকিত স্বৈরাশাসন বিরোধী ঐতিহাসিক ১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবসের এতো বছর পর আবার স্বৈরপ্রেতাত্মার কর্কশ কণ্ঠ শুনতে পাওয়ার ঘটনাটি ছিল সমগ্র জাতির জন্য দুঃখজনক ও বেদনার। সমগ্র জাতি বিস্মিত, ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হয়েছে গণধিক্কৃত-পতিত স্বৈরাচারের পদাঙ্ক অনুসারে পুরনো আস্ফালনে। গণতান্ত্রিক পরিবেশের বর্তমান জাপার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে যা কোনোভাবেই মানানসই ছিল না।

ধারণা করা হয়েছিল যে, গণতান্ত্রিক শক্তির অনুসরণের মাধ্যমে স্বৈরাচারের গর্ভে জন্ম নেয়া দল জাতীয় পার্টি (জাপা) কিছুটা হলেও পরিশুদ্ধ হবে। অতীতের রক্তচিহ্ন ও কলঙ্ক মুছে স্বৈরতান্ত্রিক অবয়ব ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি! কয়লা ধুইলেও ময়লা যায় না। কয়লা কালো ও কুৎসিতই রয়ে যা। এমনই একটি নেতিবাচক বার্তা জাপা সম্পর্কে জনমনে ছড়িয়ে গেছে শহীদ নূর হোসেন সম্পর্কে রাঙ্গার অশালীন বক্তব্যের মাধ্যমে।

স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি আর ক্ষমতার পদসেবা করে যে দলের অতীত কেটেছে, তার বর্তমানকে উজ্জ্বল করার সুযোগ ছিল ও আছে। এখনো কেন সে দলের নেতার আচরণ অতীতের মতো নিকৃষ্ট হবে? ইতিহাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কথা বলার দুঃসাহস দেখানো তাদের সাজে না। তথাপি কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষের বদলে মূর্খতা ও অর্বাচীনতা কেন গ্রাস করবে দলকে ও দলের নেতাকে?

নূর হোসেনকে ইয়াবাখোর বলা শুধু ধৃষ্টতাই নয়, চরম মিথ্যাও বটে। কারণ নূর হোসেন যখন নব্বই দশকে শহীদ হন, তখন ইয়াবা নামক মাদকের উৎপত্তিই হয়নি!

শহীদের প্রতি চরম অসভ্যতা ও ভয়ানক মিথ্যাচারের মাধ্যমে জাপা নেতা ইতিহাস বিকৃতি করতে গিয়ে সমগ্র জাতির কাছে নিজেই লাঞ্চিত ও অপমানিত হয়েছেন। সবাই তাকে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। কোথাও কোথাও তাকে ও তার দলের লোকজনকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: ক্ষমা চাইতে রাঙ্গাকে আইনি নোটিশ

স্বৈরাচারের ঔরসজাত দলের নেতা রাঙ্গা একজন পরিবহন মালিকও বটে। এহেন নেতা নামধারীদের জন্যই সম্ভবত বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থা চরম নৈরাজ্যে নিমজ্জিত। এমনই নিম্নস্তরের বোধ ও বিবেচনার মানুষের নেতৃত্বে জাপার ভবিষ্যত অন্ধকার ছাড়া আলোর দিশা পাবে না। রাজনীতি করলেও তার এই সামান্য সাধারণ জ্ঞানটুকুও নেই যে, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতার স্পৃহা ও গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে অমান্য করে রাজনীতি করা যায় না।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক মূলস্রোতের ঐতিহাসিক ধারার বিরোধিতা করে উক্ত নেতা নিজেকে রাজনৈতিক এতিম ও দলকে রাজনৈতিকভাবে অন্তঃসারশূন্য ও দেউলিয়া রূপে প্রমাণিত করেছেন।

তার সারবত্তাহীন কথায় কর্ণপাত না করে উপেক্ষা করা যেতো। তার মতো নেতাদের অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছু করাও যায় না। কিন্তু যেহেতু তিনি জাতীয় ইতিহাসকে বিকৃত করেছেন, সেহেতু তাকে জাতীয়ভাবে ভুল স্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থনা করতেই হতো। অবশেষে তিনি সেটা করেছেনও। নচেৎ ইতিহাস বিকৃতকারী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি অশ্রদ্ধা পোষণকারী হিসেবে তিনি যুগে যুগে নিন্দিত, সমালোচিত ও ঘৃণিত হতেই থাকতেন।

তার ও তার দলের নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য তিনি ভুল স্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থনা করে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। একদার কদর্য, স্বৈর অতীত থেকে কিছুটা হলেও বের হয়ে আসার সুযোগটি কাজে লাগিয়েছেন তিনি। তিনি অতিদ্রুত ক্ষমা চেয়ে শুধু তারই নয়, দলেরও বিরাট ক্ষতিকে সামাল দিয়েছেন।

দম্ভ এমনিতেই একটি দোষণীয় বিষয়। পতিত স্বৈরাচার ও গণধিক্কৃতের পক্ষে দম্ভ দেখানো তো অকল্পনীয়। যে বা যারা জনগণের করুণায় রাজনৈতিকভাবে উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছে, তারা যদি নিজের নাজুক অবস্থানের কথা চিন্তা না করে দম্ভ দেখায়, তাহলে তাদের কপালে চরম লাঞ্ছনা ও নিগ্রহ ছাড়া আর কী-ই বা জুটবে! রাজনীতি করতে হলে দম্ভ নয়, বিনয় ও ভব্যতার অনুসরণ করতে হবে।

এরশাদ স্বৈরাচারী ও অপরাপর দোষে দোষী হলেও দাম্ভিক ছিলেন না। এক ধরনের বিনয় ও ভব্যতা, লোক দেখানো হলেও তার ছিল। তার চেলা-চামুণ্ডা ও সাঙ্গপাঙ্গরা তার কুস্বভাব পেলেও সুস্বভাবের ছিটেফোঁটাও পায়নি। এদের হাতে দল তুলে দিয়ে এরশাদ শান্তি তো দূরের কথা, জনঅভিসম্পাতই পেতে থাকবেন। রাঙ্গার বক্তব্য দলকে সেই বিপদের দিকেই নিয়ে যাচ্ছিল।

ফলে নিজেকে, দলকে ও রাজনৈতিক জন্মদাতাকে রাজনৈতিক বিপদ ও কষ্টের হাত থেকে বাঁচাতে এবং জনঘৃণা ও রোষানল থেকে রক্ষা পেতে স্বৈরাচার বিরোধী গণ-আন্দোলনের মহান শহীদ নূর হোসেন সম্পর্কে মিথ্যা, বানোয়াট, কাল্পনিক, আপত্তিকর ও অশালীন বক্তব্য অবিলম্বে প্রত্যাহার করে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে তিনি শেষ রক্ষা করেছেন। তার বোধোদয়ে তার ও তার দলের মঙ্গলই হয়েছে। গণতান্ত্রিক শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাঙ্গা জাপার স্বৈরঅতীতে গণতান্ত্রিকতার প্রলেপ লাগিয়েছেন।

রাঙ্গার অসংলগ্ন বক্তব্য তাকে রাজনৈতিকভাবে বিপদগ্রস্ত করলেও দ্রুত ভুল স্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থনা করার উদ্যোগ তাকে সে বিপদ থেকে উত্তরণ করেছে। এই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির দীক্ষায় চললে তার ও তার দলের ভবিষ্যৎ বরং উজ্জ্বলই হবে।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর