পরিবেশ বিষয়ক শিক্ষা ও টেকসই উন্নয়ন

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. মো. কামাল উদ্দিন | 2023-09-01 10:55:47

গত ৩ থেকে ৭ নভেম্বর ব্যাংককের ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টার ও কনভেনশন হলে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক এনভায়রনমেন্টাল এডুকেশন কংগ্রেস ২০১৯। ওই ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে পৃথিবীর ১০৪টি দেশের প্রায় ৩০০০ ডেলিগেটস অংশ নেন। এর মধ্যে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ১০০ জন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের আমরা দুই শিক্ষক ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে আরো চারজনের অংশ নেওয়ার কথা ছিল। আমরা দুইজন ছাড়া বাকি চারজন কনভেনশনে রেজিস্ট্রেশন করলেও তাদের উপস্থাপনার সময় তারা কেউ উপস্থিত ছিলেন না। বিষয়টি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

কারণ, ওই কনভেনশনের একজন ডেলিগেটকে প্রায় ৪০ হাজার টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে হয়েছে। ওই চারজন ডেলিগেট রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়েও বা ওই সময়ে থাইল্যান্ডে উপস্থিত থেকেও প্রবন্ধ উপস্থাপনার সময় অজানা কারণে সেমিনারস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। কংগ্রেস আয়োজক কমিটি ও বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ডেলিগেটসরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাদের না পেয়ে বেশ বিরক্ত হয়েছেন। সেমিনারের কার্যক্রমও এতে ব্যাহত হয়েছে। আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে দেশ থেকে গিয়েও প্রবন্ধকাররা উপস্থিত না থাকায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, যা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত।

কনভেনশনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল পরিবেশগত শিক্ষা, টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশ সমস্যা কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করা। বিভিন্ন আলোচকদের আলোচনা থেকে যে সব বিষয় আমার ভালো লেগেছে তা পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করতে চাই।

সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে ভুটানের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ঠাকুর এস পাউডিয়েলকে, যিনি বর্তমানে রয়েল থিম্পু কলেজের প্রেসিডেন্ট। তার উপস্থাপিত 'মাই গ্রিন স্কুল ফর ভুটান' শীর্ষক আলোচনাটি ছিল খুবই মনোজ্ঞ। ভুটানের ওই সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ভুটানের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত শিক্ষামন্ত্রী, যিনি ৪৮ বছর শিক্ষকতা করেছিলেন। তার গ্রিন স্কুল ও গ্রিন এডুকেশন বিষয়ক আলোচনা উপস্থিত অনেককেই আলোড়িত করে।

ওই গ্রিন এডুকেশনের ধারণা, গ্রিন স্কুল ও টেকসই উন্নয়ন নিয়ে আলোচনার আগে ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসের কিছু দিক, যা আমার মত শিক্ষার্থীর কাছে বড্ড ভালো লেগেছে, তা উল্লেখ করছি। পুরো কংগ্রেসকে এমনভাবে সাজানো হয়েছিল যে দেখলেই বোঝা যায়, এটি পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কংগ্রেস। পুরো কংগ্রেসে তাত্ত্বিক আলোচনার পাশাপাশি বিভিন্ন স্টলের মাধ্যমে প্রাকটিক্যাল আলোচনা, পোস্টার ও ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনা ছিল উল্লেখ করার মতো।

যে বিষয়টি আমার হৃদয়ে সবচেয়ে বেশি দাগ কাটে, তা হল পুরো কংগ্রেসের সময়টুকুতে থাইল্যান্ডের বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের গ্রুপে গ্রুপে বিভক্ত করে কংগ্রেসে হাজির করানো। তাদের জন্য এমন কিছু ইভেন্ট রাখা হয়েছিল যে তারা যেন বাস্তবে পরিবেশগত জ্ঞান অর্জন করতে পারে। বিশেষ করে পরিবেশগত শিক্ষা কি, পরিবেশগত শিক্ষার ওপরে ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনা ও প্রাকটিক্যাল এক্সারসাইজ করানো হয়।

পরিবেশ যে একটি মৌলিক সমস্যা এবং পরিবেশগত শিক্ষার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা যায়, তা এই সম্মেলন থেকে বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি থাইল্যান্ডের কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও ভালো করে উপলব্ধি করতে পেরেছে বলে আমার বিশ্বাস।

কীভাবে একজন শিক্ষার্থী তার অন্তর পরিষ্কার করবে, পরিবেশ বিপর্যয় থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করবে, নিজে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হবে না বা কীভাবে কার্বন নিঃসরণ কমানো যায়, সেসব বিষয়ে তাদের হাতে-কলমে শেখানো হয়েছিল। রিসাইক্লিং কি, কীভাবে রিসাইক্লিং করা যায়, রিসাইক্লিং করলে পরিবেশ বিপর্যয় কীভাবে রোধ করা যায়, তা প্রাকটিক্যালি দেখানো হয়েছিল।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে পরিবেশ রক্ষা ও ভবিষ্যৎ জেনারেশনের জন্য টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে গেলে এখনকার শিক্ষার্থীদের মনোজগতে পরিবর্তন আনতে হবে আর সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্যই তাদের ওই কনভেনশনে আনা হয়েছিল। একটি সেমিনার থেকে যতটুকু জ্ঞান কাজে লাগানো যায়, তার সর্বোচ্চ করা হয়েছে। শুধু কথাবার্তা, চা-নাস্তা ইত্যাদিতে আয়োজনটি নষ্ট হয়নি, যেমনটি হরহামেশাই আমাদের দেশে ঘটতে দেখা যায়।

এবার আসা যাক ভুটানের সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর গ্রিন স্কুল ও গ্রিন এডুকেশন প্রসঙ্গে। এখানে গ্রিন বলতে কোনো রঙকে বোঝানো হয়নি। তিনি গ্রিন এডুকেশন ও গ্রিন স্কুল তত্ত্ব বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গ্রিনের অনেকগুলো ডাইমেনশন এবং উপাদানের কথা বলেন। আর এসব ডাইমেনশন বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা বিষয়টি জানতে চেষ্টা করব।

গ্রিন এডুকেশন বোঝার জন্য গ্রিনের যে ডাইমেনশন ব্যবহার করা হয়েছে, তার মধ্যে প্রথমত ন্যাচারাল গ্রিন, যা বলতে বোঝায় আমাদের আশপাশে যে প্রাকৃতিক পরিবেশ আছে এবং মানুষ ছাড়া যেসব জীবন আছে, সেগুলোর সঙ্গে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কারণ মানুষের জীবনকে পরিপূর্ণ করতে গেলেই প্রাকৃতিক অন্যান্য জীবন সংরক্ষণ করা জরুরি। অন্যান্য জীবনের তুলনায় মানবজীবনকে শুধু প্রাধান্য দিতে হবে, এমন চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃতিতে বসবাসকারী অন্যান্য জীবনের সঙ্গে আমাদের নতুন সম্পর্ক আবিষ্কার করার নামই হচ্ছে ন্যাচারাল গ্রিন এডুকেশন।

পরবর্তী উপাদান বা ডাইমেনশন হলো কালচারাল গ্রিন, যা বলতে আমাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের মধ্যে পরিবেশকে প্রাধান্য দেয়াকে বোঝায়। কালচারাল গ্রিন বলতে আরো বোঝায়, আমরা কারা, কেন আজ আমরা আমাদের যে এই অবস্থানে এসেছি, তার পেছনে পরিবেশের অবদান কতটুকু, তা গভীরভাবে উপলব্ধি করা। এবং এভাবে আমাদের মূল্যবোধ তৈরি করা, যা প্রকৃতি ও পরিবেশ সংশ্লিষ্ট।

এনভায়রনমেন্টাল এডুকেশন ও গ্রিন স্কুলের আর অন্যতম উপাদান সোশ্যাল গ্রিন আমাদের এমন একটি সামর্থ্য, যার মাধ্যমে আমরা প্রকৃতির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে পারি। এটি আমাদের সামাজিক দায়িত্ব এবং দায়বদ্ধতা। সামাজিকভাবে স্বেচ্ছায় দলগতভাবে পরিবেশ সুরক্ষার শিক্ষাই হচ্ছে গ্রিন স্কুল বা গ্রিন এডুকেশনের সামাজিক উপাদান বা ডাইমেনশন।

এর অন্য আরেকটি ডাইমেনশন হচ্ছে ইন্টেলেকচুয়াল গ্রিন, যা পরিবেশ সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও এ সম্পর্কে নতুন ধারণা, জ্ঞান এবং তথ্য অনুসন্ধানে মনের উন্মুক্ততা বাড়ায় এবং নতুন আবিষ্কারের পথ দেখায়। এসব আবিষ্কার সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে মানব সমাজকে রক্ষা করার জন্য যোগ্যতার উন্নয়ন ও প্রয়োগ ক্ষমতার বিকাশকে ইন্টেলেকচুয়াল গ্রিন নামে অভিহিত করা যেতে পারে।

গ্রিন এডুকেশনের অন্যতম আরেকটি উপাদান হলো একাডেমিক গ্রিননেস, যা গ্রিন এডুকেশনের বিভিন্ন ধারণার সংজ্ঞায়ন করে এবং গ্রেট আইডিয়াগুলোর আবিষ্কারকে বাস্তবে প্রয়োগের জন্য দক্ষতা অর্জনের পথ দেখায়। আমাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও শিক্ষার প্রত্যেকটি স্তরের সঙ্গে এগুলো সম্পৃক্ত করার নামই একাডেমিক গ্রিননেস।

এর পরে আসে স্পিরিচুয়াল গ্রিন। স্পিরিচুয়াল গ্রিন হলো আমাদের সীমিত ও অসম্পূর্ণ জীবনের জন্য আরো পরিপূর্ণতা এবং আমাদের সমাপ্তি উপলব্ধি করবার জন্য একটি উচ্চতর ও উৎসাহজনক বস্তুর প্রয়োজনীয়তার দিক। এর সর্বশেষ স্তর বা উদ্দেশ্য হচ্ছে মোরাল গ্রিন। মোরাল গ্রিন হচ্ছে এমন একটি যোগ্যতা অর্জন করা, যার মাধ্যমে মানুষ তার মূল্যবোধগুলোর মধ্যে পার্থক্য তৈরি করতে পারে। এটি এমন একটি দক্ষতা যার মাধ্যমে কি করলে পরিবেশের বিপর্যয় হবে এবং কি করলে পরিবেশ রক্ষা পাবে, সে ধরনের মূল্যবোধ তৈরি করা সম্ভব।

'গ্রিন'কে সামনে রেখে এই পরিবেশগত শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্তর পরিষ্কার করা, যার মাধ্যমে পরিবেশ-বান্ধব একটি মন তৈরি করা। আর এগুলোর সম্মিলিত রূপই হচ্ছে গ্রিন এডুকেশন ও গ্রিন স্কুলের মূল বিষয়বস্তু।

আমরা জানি বাংলাদেশ চরমভাবে পরিবেশ বিপর্যয় কবলিত একটি দেশ। আমরা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি ২০৩০ সালে। আমাদের বর্তমান পরিবেশগত শিক্ষার প্রতি জোর দিলেও পরিবেশগত শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে গ্রিন এডুকেশন ও পরিবেশগত শিক্ষানীতির অভাব পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশকে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জন্য ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গ্রিন কনসেপ্টকে সামনে রেখে এডুকেশন সিস্টেম চালু ও স্কুল প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি।

ড. মো. কামাল উদ্দিন: অধ্যাপক, সাবেক চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এ সম্পর্কিত আরও খবর