ভরসার প্রতীক

, যুক্তিতর্ক

ড. আতিউর রহমান | 2023-08-31 21:37:05

আজকের দুনিয়া প্রযুক্তি-নির্ভর। ব্যবসা-বাণিজ্য-শিক্ষা সবই আধুনিক প্রযুক্তির ওপর ভর করেই এগুচ্ছে। কোনো কোনো দেশ প্রযুক্তি হস্তান্তরে খুবই দূরদর্শী ছিল বলেই আজ তারা উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে। দক্ষিণ কোরিয়া তেমন এক দেশ। ঊনিশশো ষাটের দশকেও দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা প্রায় আমাদের ওই সময়ের অবস্থার মতোই ছিল। সে সময় দেশটির মাথাপিছু আয় ছিল (১৯৮০ সালের মূল্যে) মাত্র ৮৭ ডলার। আর আজ তা তিরিশ হাজার ডলারেরও বেশি। আমাদেরও তখন মাথাপিছু আয় এর ধারে কাছেই ছিল। ওরা এতটা এগিয়ে গিয়েছে প্রযুক্তি গ্রহণ করার সক্ষমতার জোরে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রযুক্তি নির্ভর করার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে সাহায্য করেছে সরকার। উদ্ভাবন ও উন্নয়ন খরচের ৮৫ শতাংশই আসে ব্যক্তিখাত থেকে। মোট জিডিপির প্রায় সাড়ে তিন শতাংশ খরচ হয় এই খাতে। অথচ ১৯৮১ সালেও তা ছিল মাত্র .৮১ শতাংশ। বর্তমানে দশ হাজারেরও বেশি পিএইচডি ব্যক্তিখাতের নানা কোম্পানির গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগে কাজ করেন।

আমাদের বেলায় ঠিক তার উল্টো। বিদেশ থেকে প্রযুক্তি আমদানি আমরা ঠিকই করছি। কিন্তু এই প্রযুক্তিকে ‘আনবান্ডল’ করে তাকে দেশোপযোগী করে উপযুক্ত উদ্ভাবন করার ক্ষেত্রে আমাদর জনশক্তি খুবই পেছনে। তাই আমাদের উৎপাদনশীলতাও সে হারে বাড়ছে না। তবে সম্প্রতি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার স্লোগান নিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবার যে সংকল্প গ্রহণ করেছে তার ফলে নয়া তরুণ উদ্যোক্তার বিকাশের বেশ কিছু ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। আর ডিজিটাল ব্যবসা-বাণিজ্যেই এই উদ্যোক্তাদের সংখ্যা দ্রুত হারে বাড়ছে। প্রযুক্তি বাইরে থেকে নিশ্চয় আনতে হবে। তবে তা আমাদের প্রয়োজনমতো গড়ে পিটে নেবার সক্ষমতাও অর্জন করতে হবে। যেমন ধরুন, আমাদের মোবাইল আর্থিক সেবা উন্নত বিদেশি প্রযুক্তি নির্ভর একটি ডিজিটাল ব্যবসা। প্রয়োজন অনুযায়ী আমরা বিদেশি ‘আলীবাবা’র প্রযুক্তি গ্রহণের জন্যে অংশীদারত্ব ভাগ করে নিতে দ্বিধা করিনি। কিন্তু আমরা মালিকানার প্রধান অংশ আমাদের হাতেই রেখেছি। ‘কাজ করে করে শেখার নীতি’ গ্রহণ করেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের উদ্যোক্তাদেরও অনুধাবন করতে হবে যে, উদ্ভাবন ও গবেষণায় তাদেরও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সরকারও সে জন্যে তাদের প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দিতে দ্বিধা করবে না। যদিও আমাদের বাজেটে এ বিষয়ে খানিকটা ঘাটতি রয়েছে, তবুও বলব ধীরে ধীরে দিন বদলাচ্ছে। সরকার ও উদ্যোক্তারা মিলে মিশেই দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের অর্থনীতির মূল শক্তি হচ্ছে আমাদের উদীয়মান উদ্যোক্তারাই। চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই শক্তিকে আরো মজবুত করতে আমরা কী ধরনের নীতি-সমর্থন দিতে পারি। সেজন্যে আমাদের পরিসংখ্যান ও ইতিহাস—দুটো দিকেই নজর দিতে হবে। শুরুতেই আমাদের অর্থনীতির ইতিবাচক দিকগুলোর দিকে তাকাই। গত দশ বছরে আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি অনেকটাই পোক্ত হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বেড়েছে। তবে বেসরকারি বিনিয়োগ আরো বাড়লে ভালো হতো। তাই আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে আমাদের প্রবৃদ্ধি হতে যাচ্ছে ৭.৬ শতাংশ। উন্নয়নশীল বিশ্বের চেয়ে অন্তত সাড়ে তিন শতাংশ বেশি। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বিদ্যুৎ উৎপাদন, ফ্লাইওভার মহাসড়কসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মেগা অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার একনিষ্ঠ রয়েছে বলেই অর্থনীতির চাকা এমন সচল রয়েছে। গত দশ বছরে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন তিনগুণ বেড়ে এখন প্রায় আঠেরো হাজার মেগাওয়াট। তবে সবাইকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে হলে আমাদের সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। আমরা অবশ্য সে পথেই হাঁটছি। কৃষি খুব ভালো করছে। এবছর সারা দেশেই কৃষি উৎপাদন স্থিতিশীল। ধানচাল ছাড়াও মাছ, সবজি, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগির উৎপাদনের ধারা বাড়ন্ত। অতিদারিদ্র্য কমে বারো শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। দশ বছর আগেও যা প্রায় ঊনিশ শতাংশ ছিল। আমাদের মাথাপিছু আয় এই দশ বছরে প্রায় তিনগুণ বেড়ে ১৭৫২ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। এর সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের মানব উন্নয়ন সূচকগুলোর সমান তালে এগিয়েছে। জীবনের গড় আয়ু, মাতৃমৃত্যুর হার, শিশু মৃত্যুর হার, নারীর শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন—সকল সূচকেই বাংলাদেশ তার পড়শি দেশসমূহের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হবার সবকটি সূচকেই বাংলাদেশ যোগ্যতা অর্জন করেছে। এখন আমরা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনের সংগ্রামে লিপ্ত। আশাকরছি ২০৩০ সালে এমডিজির মতোই এসডিজি অর্জনেও বাংলাদেশ তার সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবে।

আমাদের আর্থ-সামাজিক এই সাফল্যের পেছনে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তিখাতের উদ্যোক্তাদের অসাধারণ অবদানের কথা না বললেই নয়। আর এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের সামাজিক গতিময়তার জন্যেই। উদ্যোক্তা তৈরির একটা সহজাত সৃজনশীলতা এই সমাজে রয়েছে। এত ছোট দেশে এত মানুষের বাস। ‘ডেনসিটি ডিভিডেন্ড’ লাভের একটা স্বাভাবিক সুযোগ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এই দেশে খুঁজে পাওয়া যায়। এর ফলে আমাদের ‘কানেকটিভিটি’ বা সংযোগের সম্ভাবনাও বেশি। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়েই আমরা এখন জোর কদমে এগিয়ে চলেছি। একই সঙ্গে আমাদের সমাজ খুবই লড়াকু। একাত্তরের প্রতিকূলতা জয় করে এই সমাজ তার ভেতরে এক অভাবনীয় লড়াই করার শক্তি সঞ্চয় করে রেখেছে। আর সেই কারণে অসংখ্য তরুণ উদ্যোক্তা ব্যবসা-বাণিজ্যের নানামুখী বাঁধা ডিঙিয়ে ঠিকই বের হয়ে আসছে। সংখ্যার বিচারেও আমাদের জনসংখ্যা খুবই তরুণ। পনের বছরের কমবয়েসী তরুণের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৩৮%। ১৫-২৪ বছর বয়েসী তরুণের সংখ্যার হার ১৯.৫%। চীনে এই হার ১৩%। ভিয়েতনামে ১৬.৯%। ভারতে ১৮.৪%। এই তরুণরাই আমাদের মূল জনশক্তি। এদের অংশগ্রহণেই আমাদের শ্রম বাজার গতিশীল ও সাশ্রয়ী। আমাদের উদ্যোক্তরাও বয়সে তরুণ। তাই এই বৈশ্বিক পরিবেশে প্রযুক্তির সর্ব্বোচ্চ ব্যবহার করে তারা আমাদের শুধু রপ্তানি শিল্পেরই বিকাশ ঘটাচ্ছে তাই নয়, ই-কমার্স থেকে শুরু করে জ্ঞান-ভিত্তিক অর্থনীতি, সমাজ ও প্রশাসনকে গতিময় রাখতে তারা অসামান্য ভূমিকা পালন করছে। তবে যথেষ্ট গুণমানের শিক্ষা না পেয়ে তরুণদের বিরাট অংশের কর্মসংস্থান পর্যাপ্ত ঘটছে না। তাই তাদের মনে শঙ্কা ও অসন্তোষ রয়েছে। এর প্রমাণ আমরা হালের সরকারি চাকুরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় বেশ খানিকটা দেখতে পেয়েছি। তাই আরো কর্ম-সংস্থান সৃষ্টিই আমাদের জন্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই বাড়তি কর্মসংস্থানের সুযোগও ব্যক্তিখাতের উদ্যোক্তারাই বেশি করে করতে পারেন। উদ্যোক্তা তৈরির জন্যে তাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ও সরকারকে নতুন করে ভাবতে হবে। আমরা শতধিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেসব স্নাতক বের করছি তারা আমাদের আধুনিক শিল্পায়ন ব্যবস্থাপনায় অপ্রসাঙ্গিকই থেকে যাচ্ছে। অথচ আমাদের গার্মেন্টস, তথ্য প্রযুক্তি ও চামড়া শিল্পের মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপক ও প্রকৌশলী শ্রীলঙ্কা, ভারত ও আশেপাশের অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। সেজন্যে বছরে পাঁচ থেকে ছয় বিলিয়ন ডলার গুনতে হচ্ছে। আবার দেখুন তেজগাঁওতে অবস্থিত আমাদের টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো স্নাতকই কিন্তু বেকার নেই। তার মানে আমরা আমাদের অর্থনীতির দক্ষতার চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষিত কর্মী তৈরি করতে পারছি না।

প্রচলিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার পাশাপাশি আমাদের এক্ষুনি ব্যবসায় ও শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী স্বল্পমেয়াদি ট্রেডকোর্স চালু করা, আরো বেশি করে কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দিকে নীতি-সমর্থন জরুরি হয়ে পড়েছে। হালে তথ্য প্রযুক্তি বিভাগ ব্যবস্থাপক ও উদ্যোক্তা তৈরির প্রশিক্ষণে মনোযোগী হয়েছে। এই ধারা আরো জোরদার করতে হবে। আমরা জিডিপির মাত্র দশমিক এক পাঁচ শতাংশ আয় এন্ড ডি (গবেষণা ও উন্নয়ন) বাবদ ব্যয় করি। চীন এ বাবদ ব্যয় করে দেড় থেকে দুই শতাংশ। আমাদের ক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপযুক্ত উদ্ভাবনী কেন্দ্র (‘ইনোভেশন ল্যাব’) রয়েছে? আমাদের ব্যক্তিখাতই বা এই খাতে কতটা খরচ করে? শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতেও আমাদের সরকারি খরচ উন্নয়নশীল দেশগুলোর গড়পড়তা খরচের চেয়ে অর্ধেকেরও কম। ব্যক্তিখাতও শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে বরং ব্যবসাই বেশি করছে। উপযুক্ত জনশক্তি তৈরিতে নজর তেমনটা নেই। তা সত্ত্বেও আমাদের এতটা নিরাশ হবার কোনো কারণ নেই। আমাদের রয়েছে সমৃদ্ধ অতীত। সারা বিশ্বেই বস্ত্রখাতের হাত ধরেই উন্নতির মহাসড়ক নির্মিত হয়েছে। মনে রাখা চাই বাংলার উন্নত বস্ত্র শিল্পই সতের শতকে ভারত দখলের অভিপ্রায়ে ইউরোপীয়রা জাহাজ ভাসিয়েছিলেন। ভুল করে কলম্বাস ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও উত্তর আমেরিকা পৌঁছুনোর পর ভাস্কো দা গামা ভারতে আসেন। আরব ব্যবসায়ীরা আগে থেকেই ভারতে আসতেন। তাদের মুখ থেকেই ইউরোপীয়রা ভারতের ধন সম্পদের কথা শোনেন। ১৭৬০ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর থেকেই বাংলার লুণ্ঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। সেই লুটের অর্থ লন্ডনে যেতে শুরু করে। ১৯৬৬ সালে রবার্ট ক্লাইভ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে জানিয়েছিলেন বাংলা অফুরন্ত সম্পদের এক ভাণ্ডার। স্থানীয় বস্ত্রখাত ছিল তার মূলে। আর সেই আকর্ষণেই তারা বাংলা দখল করে। পরে পুরো ভারত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল বহুজাতিক কোম্পানি। তাদের মূল কাজই ছিল বাংলার সম্পদ আহরণ করে ইউরোপ নিয়ে যাওয়া। এই সময়টায় বাংলার স্থানীয় বস্ত্র শিল্প ধ্বংস করে ইংল্যান্ডে তার প্রসার ঘটানো হয়। এর মাধ্যমেই ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের উৎপত্তি। ম্যানচেস্টার ও ল্যাংকাশায়ারের শিল্পায়নের সাথে বাংলার শিল্পোয়নের সরাসরি সংযোগ রয়েছে। এই শিল্পবিপ্লব ইংল্যান্ডে বসে থাকেনি। আরো লাভের আশায় ব্রিটিশ পুঁজি ঊনিশ শতকে মার্কিন শিল্পায়নে বিনিয়োগ করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন পুঁজি আবার ইউরোপের পুনর্নির্মাণে ব্যবহৃত হয় মার্শাল পরিকল্পনার আওতায়। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিংগাপুর, হংকংও এই পুঁজির ভাগ পায় এবং মূলত বস্ত্রখাতের শিল্পায়নের হাত ধরে রপ্তানিমুখী শিল্পায়নের সফল মডেল দেশে পরিণত হয়। একই ধারায় ভারত ও চীনও এখন এই বিশ্ব পুঁজির ভাগ পাচ্ছে এবং উন্নতি করছে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর দক্ষিণ কোরিয়া থেকে দেশ গার্মেন্টেসের হাত ধরে পুঁজি আসতে শুরু করে আমাদের বস্ত্র শিল্পে। সেই বস্ত্র শিল্পের সুবাদেই আজ বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্ততম বস্ত্র রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। আহরিত পুঁজি বিনিয়োগ হচ্ছে এই শিল্পের আরো অনেকগুলো রপ্তানিমুখী শিল্পে। বর্তমানে পোশাক শিল্পের সহযোগী হিসেবে জুতো, ওষুধ, সিরামিক, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাইসাইকেল, জাহাজ নির্মাণসহ রপ্তানিমুখী শিল্পায়নে বড় ধরনের সাফল্য দেখিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। আর মূলত এই দ্রুত অগ্রসরমান শিল্পায়নের ফলেই গত দশ বছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় বেড়েছে তিনগুণ। এসবই সম্ভব হয়েছে এক দল তরুণ উৎসাহী এবং ঝুঁকি গ্রহণে সাহসী উদ্যোক্তার জন্যে। বাংলাদেশ সরকারের উপযুক্ত নীতি প্রণোদনা, ব্যাংকিং খাতের প্রয়োজনীয় উদ্ভাবনীমূলক সমর্থন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দূরদর্শী রেগুলেশন এই শিল্পায়নের শক্ত পাটাতন তৈরি করতে সাহায্য করেছে। এই ধারার শিল্পায়নের পেছনে পুঁজি ও শ্রমের সম্মিলন ছাড়াও আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক অনেক প্রতিষ্ঠান, সামাজিক গতিময়তা এবং সর্বোপরি উদ্যোক্তাদের সক্রিয়তা কাজ করছে। বিশেষ করে, আমাদের চলমান উন্নয়ন অভিযাত্রায় লক্ষ লক্ষ ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তার কঠোর পরিশ্রম ও এগিয়ে যাবার আকাঙ্ক্ষা বিরাট ভূমিকা রেখেছে। এদের মধ্যে থেকেই পরবর্তী সময়ে বড় বড় উদ্যোক্তার আবির্ভাব ঘটছে। বিশ্ব পরিস্থিতিও বাংলাদেশের অনুকূলে কাজ করছে। অনেকেই মনে করেছিলেন রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর বাংলাদেশের বস্ত্র শিল্পে ধস নামবে। কিন্তু আমাদের লড়াকু উদ্যোক্তারা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এই সংকটককে সুযোগে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছেন। এই সংগ্রামে ক্রেতাদের সংগঠন অ্যালায়েন্স ও অ্যাকর্ড, উন্নয়ন সহযোগীদের (বিশেষ করে জাইকা ও বিশ্বব্যাংক) সমর্থন, বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘প্রো-অ্যাকটিভ’ নীতি সমর্থন বড় ধরনের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।

আমার মনে আছে যেদিন রানা প্লাজা দুর্ঘটনাটি ঘটল ওই দিন সকালে হোটেল সোনারগাঁতে একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতও ছিলেন। আমরা সেদিন বলেছিলাম এই দুর্যোগ বাংলাদেশ কাটিয়ে উঠবে এবং পরবর্তীতে একে সুযোগে পরিণত করবে। পরের দিন জাপানী রাষ্ট্রদূত আমার বাসায় চলে এলেন। বললেন, এসএমই খাতে যে কমসুদের ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে জাইকা বিতরণ করছে তা থেকে একশো কোটি টাকা আলাদা করে ছোট ও মাঝারি গার্মেন্টস শিল্পের নিরাপত্তা বিধানে যেন দেওয়া হয়। আমরা দ্রুতই সরকারের সাথে আলাপ করে নয়া এক ঋণ কর্মসূচীর সূচনা করলাম। এই কর্মসূচী এখনো চলছে আরো বৃহত্তর পরিসরে। বাংলাদেশ ব্যাংক এরপর বিশ্বব্যাংকের সাথে আলাপ আলোচনা করে আরো তিনশো মিলিয়ন ডলারের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী কমসুদের ঋণের ব্যবস্থা করে। পাশাপাশি, আরো দুশো মিলিয়ন ডলার আমরা রিজার্ভ থেকে আলাদা করে শুধুমাত্র সবুজ বস্ত্র ও চামড়া কারখানার জন্যে নয়া ঋণ কর্মসূচি চালু করি। তাছাড়া, ইডিএফ বা রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলটি দুশো মিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে দুই বিলয়নেরও বেশি পর্যায়ে উন্নীত করেছিলাম। সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয় বেশি পরিদর্শক নিয়োগ ছাড়াও নানামুখী তৎপরতা বস্ত্র শিল্পের সামাজিক ও পরিবেশগত কমপ্লায়েন্সের ব্যাপক উন্নতি করতে নীতি সমর্থন প্রদান করে। এভাবেই বাংলাদেশের মূল রপ্তানি শিল্প একটি সংকট থেকে শুধু উঠে দাঁড়িয়েছে তাই নয় এখন তার প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে।

সর্বশেষ এক খবরে জানতে পারলাম যে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি গত চার মাসে প্রায় তিন শতাংশ হারে বেড়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তি থেকে সরে আসার পর থেকে ভিয়েতনাম, ক্যাম্বোডিয়া, চীনের কাছ থেকে যে হারে বস্ত্র কিনছে তার চেয়ে বেশি হারে বাংলাদেশ থেকে কিনছে। আর আগেই যেমনটি বলেছি, বর্তমানে মার্কিন খুচরো বিক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের বস্ত্রখাতের ভাবমূর্তি সামাজিক ও পরিবেশগত কমপ্লায়েন্সের উন্নতির কারণে বেশ উজ্জ্বল। তাই ৫.৬২ শতাংশ ডিউটি দিয়েও বাংলাদেশের শক্তিশালী বস্ত্রখাত মার্কিন বাজারে দিন দিনই তার শক্তিমত্তা দেখিয়ে চলেছে। এ বছর ভারতেও আমাদের পোশাক রপ্তানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। আর এসবই সম্ভব হচ্ছে আমাদের পরিশ্রমী ও সাহসী উদ্যোক্তাদের অদম্য প্রচেষ্টার জন্য।

আমাদের তৃণমূলের অসংখ্য ক্ষুদে উদ্যোক্তারা কৃষি, মৎস্য, তাঁত ও কুটির শিল্পের ভীষণ তৎপর। তৃণমূলেও তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর অসংখ্য ডিজিটাল উদ্যোক্তার সৃষ্টি হয়েছে। ইউনিয়ন তথ্য প্রযুক্তি কেন্দ্র সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। আউটসোর্সিং ব্যবসাও বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সামাজিক দায়িত্ববোধ সম্পন্ন অর্থায়নের নীতি সমর্থন দিয়ে নারীসহ এসএমই উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নেবার চেষ্টা করা হচ্ছে। ব্যাংকের সাথে সমঝোতা করে কৃষি ও এসএমই ঋণ দেবার জন্যে অ-সরকারি প্রতিষ্ঠানকে এসব ক্ষুদে উদ্যোক্তার পাশে থাকার অভিনব কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং চালু করা হয়েছে বাংলাদেশ। লক্ষ লক্ষ বর্গাচাষীরাও এই ঋণ সুবিধে পাচ্ছেন। গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্যে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক মাত্র দুই শতাংশ হারে গৃহায়ণ প্রদান করে তাদের আবাসনের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। সবাই চেষ্টা করেছে বলেই পোশাক শিল্পখাত এমন করে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই খাতকে আরো সবুজ ও সক্ষম করার জন্যে আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যেসব উদ্ভাবনীমূলক নীতি সমর্থন দিতে শুরু করেছিলাম তা যেন অক্ষুণ্ণ থাকে সেই প্রত্যাশাই করছি। একই সঙ্গে এই খাতের ওপর বাড়তি যে তিন শতাংশ করপোরেট করারোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে তা যেন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় সরকারের কাছে সেই অনুরোধ করছি। তাছাড়া, সবুজ কারখানার ওপর যে দুই শতাংশ বেশি করারোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে তারও পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। উল্টো এক্ষেত্রে বাড়তি প্রণোদনা দেওয়ার প্রস্তাব করছি। রপ্তানিমুখী শিল্পায়নের ঝুঁকিও অনেক। বিশেষ করে এরফলে নগরায়ন অপরিকল্পিত রূপ নিতে পারে, পরিবেশের অবনতি ঘটতে পারে, শ্রমিকদের জীবনমান চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। তাই বড় বড় উদ্যোক্তারা যেন এসব ঝুঁকি মোকাবেলায় নিজেরাও সক্রিয় হন এবং সরকারের সহায়তামূলক নীতিসমর্থন পান সেজন্যে সংগঠিত হন।

আমার ধারণা, আমাদের প্রকৃত শিল্প উদ্যোক্তরা এসব ঝুঁকি মোকাবেলায় তাদের বুদ্ধিমত্তা ও সমর্থন স্বস্বার্থেই দেবেন। বিশ্বায়নের এই যুগে পরিবেশগত ও সামাজিক ঝুঁকি মোকাবেলা করেই যে তাদের এগুতে হবে সেটা তারা জানেন। সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদেরও সঙ্গে নেবার মতো সক্ষমতা তাদের রয়েছে। কিন্তু ক্ষুদে মাঝারি উদ্যোক্তাদের সেই সক্ষমতা নেই। তাদের জন্যেও বড় উদ্যোক্তাদের চেম্বারকে উদ্যোগী হতে হবে। কারণ ছোট বড় মিলেই শিল্পায়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সার্বিক পরিবেশ বা ‘ইকো সিস্টেম’ গড়ে ওঠে। সেইজন্যেই এই নীতি সমর্থনের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ অপরিহার্য।

বস্ত্রখাত ছাড়াও বাংলাদেশের আরো অনেক খাতে উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। ডিজিটাল উদ্যোগের কথা আগেই বলেছি। ইলেকট্রিকাল যন্ত্রপাতি, প্লাস্টিক উৎপাদক, টায়ার উৎপাদক, আসবাবপত্র উৎপাদকদের প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দিলে তারাও বস্ত্র উদ্যোক্তাদের মতো বিশ্ব বাজার দখল করতে সক্ষম হবেন। ভারত ও চীনে এখন বড় বড় গাড়ি উৎপাদকরা কারখানা খুলেছে। বছরে ২০ লক্ষ গাড়ি এই দুই দেশে তারা উৎপাদন ও বিক্রি করছে। এসব গাড়ির টায়ার, প্লাস্টিক পার্টস আমরা বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করতে পারি। আমাদের পাটতন্তু দিয়ে গাড়ির বডির একাংশ তৈরি করা সম্ভব। এসব ক্ষেত্রে চাই নীতি সক্রিয়তা। তাছাড়া, আমরা কৌশলগতভাবে এমন এক স্থানে অবস্থিত যে আমাদের ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের হার হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। ইউরোপের এয়ারলাইন্সগুলোকে বিনিয়োগের সুযোগ দিলে তারাই এসব বিমানবন্দর গড়ে তুলবে। ভারত ও চীনের পর্যটন বাজারে প্রবেশের জন্যেও তারা তা করবে। সেজন্যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্যে ব্যবসা-বাণিজ্য করা নিয়মনীতি সহজ করা, নিরাপত্তা জোরদার করা, বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন সহজতর করার মতো নিয়মনীতি আরো ব্যবসা-বান্ধব করার প্রচুর সুযোগ আমাদের হাতে রয়েছে। পাশাপাশি অনেক কষ্টে গড়ে ওঠা আমাদের ম্যাক্রো অর্থনীতির স্থিতিশীলতা যে কোনো মূল্যে ধরে রাখতে হবে। একমাত্র স্থিতিশীল পরিবেশেই উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে উৎসাহিত হয়। আগামী দিনের উন্নত বাংলাদেশকে নির্মাণের লক্ষ্য মাথায় রেখে এখন থেকে আমাদের আরো সম্মুখমুখী দূরদর্শী নীতিসংস্কার ও নীতি সমর্থন দিয়ে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় সদা সক্রিয় অংশীজন করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

আতিউর রহমান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

এ সম্পর্কিত আরও খবর