দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও হুজুগে বাঙালি

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মুত্তাকিন হাসান | 2023-09-01 13:10:48

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। সারাজীবন দেখে এলাম, ঈদ বা রমজানের আগে অথবা কোনো পণ্যের ঘাটতি থাকলে, দাম বেড়ে যায়। এখন দেশের অবস্থা দেখলে মনে হয়, সারা বছরই আমাদের রোজা বা ঈদ।

পেঁয়াজের ঘাটতি থাকায় তার দাম বাড়তে পারে-এটি অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এরসুযোগ নিয়ে সিন্ডিকেট করে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার চেষ্টা করাটাই অস্বাভাবিক। ঘাটতি থাকলেও দামের এতো হেরফের হয় কীভাবে, তা ভাবতে অবাক লাগে।

পেঁয়াজ কাহিনীর পর শুরু হলো লবণ কাহিনী। নিত্য পণ্য নিয়ে যত কাহিনী হোক না কেন, আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষের কাহিনী শোনার কেউ নেই। শুধু ক্ষোভ আর মনে মনে গালি দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই। কোনোকিছুর দাম বাড়লেই মিডিয়ায় মজুতকারীদের বিভিন্ন অজুহাত শুনতে পাই। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো যেন এখন একটা ট্রেডিশন হয়ে গেছে।

আবার অনেক ক্রেতা আছে, যারা দামের ঊর্ধ্বগতি দেখে নিজেরাও যেন ব্যবসায়ী হয়ে যায়। এইতো গত সপ্তাহে এক মুদি দোকানে রসুন কিনতে গিয়ে দেখলাম, মধ্য বয়সী এক নারী দোকানদারকে বলছেন, পেঁয়াজের দাম কি আরও বাড়বে? দোকানদার উত্তর দিলেন, ঠিক বলতে পারব না। দোকানদারের উত্তর শুনে তৃপ্তির হাসি দিয়ে তিনি বলে উঠলেন, আমি তো দেড়শ’ টাকা কেজি করে ২০ কেজি পেঁয়াজ কিনে রেখেছি। দেখে মনে হলো তিনি শিক্ষিত। কিন্তু তিনিও একটু সুযোগ খুঁজছেন কিছু লাভের আশায়।

লবণের সংকটের কথা শুনে অনেকেই ১০-২০ কেজি লবণ কিনে ঘরে রেখেছে, মনে হয়, ভাত বাদ দিয়ে তারা লবণ খেয়ে থাকবে। পরে যখন জানা গেল, এ সংকট কৃত্রিম, তখন তাদের অবস্থাটা কেমন হয়েছিল জানতে ইচ্ছা করে। অবশ্য প্রশাসনের কড়া হস্তক্ষেপে লবণ নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতাদের ‘ধান্দাবাজি’ আর পাখা মেলতে পারেনি।

সবাই যদি এভাবে ধান্দা খোঁজে, তাহলে সাধারণ মানুষের মন্দা কখনো শেষ হবে না। দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে জীবন যাত্রার সম্পর্ক অতন্তনিবিড়। অথচ বর্তমান যুগে ন্যায্য মূল্যেকোনো পণ্যই আর পাওয়া যায় না।

হুজুগে বাঙালি কথাটা আমাদের রক্তে মিশে আছে, যতই আধুনিক হই না কেন এর ব্যতিক্রম দেখা যায় না। তবে বাঙালিকে এ হুজুগেপনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, তা না হলে গুজব ঠেকানো কঠিন হবে। গুজবে কান না দিয়ে বিচক্ষণতার টুপিতে কান ঢেকে দেওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

একটি পরিবার কীভাবে তাদের দৈনন্দিনজীবন নির্বাহ করবে, তা নির্ভর করে তাদের আয়, চাহিদা এবং দ্রব্যমূল্যের ওপর।নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যখন সাধারণমানুষের আর্থিক সংগতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায়, তখন পরিবারেও আসে অশান্তি। সংসারের এক দিক টানলে,আরেক দিক ছোট হয়ে যায়। বেঁচে থাকার তাগিদেই অনেক নিরপরাধ মানুষ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এক দিকে জনজীবনে নেমে আসে কষ্টের কালো ছায়া, অন্যদিকে মুনাফাখোর, কালোবাজারীদের কারণে দেশে বিরাজ করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই ক্রমবর্ধমান চাপ দ্রুত রোধ করা প্রয়োজন। তা না হলে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন ধারণ কঠিন হবে। এর জন্য সরকারকে দুষলে হবে না, আমাদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। দেশের অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট রোধ করতে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধে সামাজিকভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। অসৎ ও মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। নিয়ম বহির্ভূতভাবে কেউ কেনাবেচা করলে, তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। টিসিবিকে (Trading Corporation of Bangladesh) আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। প্রতি সপ্তাহে প্রয়োজনীয় পণ্যের খুচরা ও পাইকারি মূল্যের তালিকা মনিটর করতে হবে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে আরও জোরালোভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালতপরিচালনা করে অসাধু ব্যবসায়ীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

মুত্তাকিন হাসান: কবি, প্রাবন্ধিক ও মানব সম্পদ পেশাজীবী

এ সম্পর্কিত আরও খবর