সু চির ঠাঁই কোথায়

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স | 2023-08-25 03:51:44

নির্যাতন-নিপীড়ন ও প্রোপাগান্ডা একই সূত্রে গাঁথা। যারা অন্যায় করে, তারাই প্রোপাগান্ডা করে। প্রোপাগান্ডা অন্যায়কারীদের প্রধান রক্ষাকবচ। যুগে যুগে দেশে দেশে যেখানেই মানবতার বিরুদ্ধে হত্যা ও অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেখানেই নির্যাতিত মানুষের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছে। ক্ষমতা, উগ্র জাতীয়তাবাদ অথবা কায়েমি স্বার্থ রক্ষার অন্যতম অনুষঙ্গ প্রোপাগান্ডা।

কিন্তু ইতিহাসের একটি নিজস্ব ধারা রয়েছে। মানবতার বিরুদ্ধে অথবা সত্যের বিরুদ্ধে যারা প্রোপাগান্ডা চালিয়েছে, ইতিহাস তাদের ক্ষমা করেনি। ভারতবর্ষ লর্ড ক্লাইভকে হয়তো ভুলে যেতে পারে, কিন্তু মীর জাফরকে তারা কোনোদিন ভুলতে পারবে কি? যতদিন রাজনীতি ও কূটনীতিতে মিথ্যা ও অপপ্রচার থাকবে ততদিন বিশ্ববাসী ভুলে যাবে না গোয়েবলসকেও।

প্রোপাগান্ডা পরিচালনার জন্য হিটলার আলাদা লোকই নিয়োগ করেছিলেন। গোয়েবলসের কাজই ছিল মিথ্যাকে সত্য বলে বারবার প্রচার করা। মিথ্যা প্রচারের জন্য হিটলার একটি আলাদা মন্ত্রণালয়ও চালু করেছিলেন, যার নাম ছিল মিনিস্ট্রি অব পাবলিক এনলাইটেনমেন্ট অ্যান্ড প্রোপাগান্ডা-মানে প্রচার মন্ত্রণালয়। গোয়েবলস ছিলেন ওই প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রধান।

গোয়েবলসের কাজ ছিল, ইহুদিদের বিরুদ্ধে প্রচার প্রোপাগান্ডা চালানো, যাতে হিটলার তার কার্যসিদ্ধি করতে পারেন। প্রচার প্রোপাগান্ডার আড়ালে হিটলার ইহুদি নিধন চালিয়েছেন। ব্যাপক গোয়েবলসীয় প্রোপাগান্ডার জন্যই হিটলারের পক্ষে ব্যাপক ইহুদি হত্যাযজ্ঞ চালানো সহজ হয়েছিল। গোয়েবলসকে বলা হতো দ্য লিটল ডক্টর।

এই বিগ কিলার (হিটলার) ও লিটল ডক্টর দু’জনই বিশ্বাস করতেন, শব্দ ও ছবি যে কোনো আদর্শ প্রচারের জন্য সবচেয়ে উত্তম মাধ্যম। ফলে তারা সে সময়ের গণমাধ্যমকে তাদের প্রোপাগান্ডা চালানোর কাজে ব্যবহার করতেন। জানা যায়, রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র রেডিওতেও চালানো হতো নানা রকম প্রোপাগান্ডা। তার মানে, সাহেব-বিবির বাক্স অথবা বোকা বাক্সের রাষ্ট্রীয় ব্যবহার সেদিনও ছিল, দেশে দেশে আজও আছে।

গোয়েবলস কিন্তু সাধারণ কোনো রাজনীতিক ছিলেন না। ছিলেন একজন সম্ভ্রান্ত ক্যাথলিক পরিবারের সন্তান। পরে এই সম্ভান্ত ক্যাথলিক মানব সন্তানই বিভ্রান্ত হয়ে মানব হত্যার নীল নকশা প্রণয়নে সাহায্য করেন। ১৯২১ সালে গোয়েবলস হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি সাংবাদিক হিসেবেও কাজ করেন। কাজ করেছেন ব্যাংকের করণিক পদেও। পিএইচডি অর্জনের তিন বছর পরে তিনি রাজনীতিতে আসেন। ভালো লেখার হাত ছিল গোয়েবলসের। হিটলারের বক্তব্য, বিবৃতির বেশির ভাগেরই রচনাকারী ছিলেন গোয়েবলস। নিজের লেখা বক্তব্য বহুবার অনুশীলন করে অসাধারণ বাচনভঙ্গি প্রয়োগে মানুষের কাছে পেশ করতেন গোয়েবলস। ফলে তার কথা অবিশ্বাস করা সহজ কিছু ছিল না।

২.

গত ১৫ নভেম্বর নেপিডতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলরের দপ্তরের মুখপাত্র এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে অভিযোগ করেন, বাংলাদেশের অসহযোগিতার কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হচ্ছে না। মিয়ানমারের এ রকম অভিযোগ নতুন কিছু নয়। এটি তাদের প্রোপাগান্ডারই অংশ।

বিশ্ববাসী জানে, রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার কী নিধনযজ্ঞটাই না চালিয়েছে। বিশ্ববাসী আরও জানে, একটি জাতিগোষ্ঠীকে কীভাবে তারা ভিটেমাটি ছাড়া করে দেশত্যাগে বাধ্য করেছে। শুধু তা-ই নয়, সেই ভিটেমাটিতে আগুন দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই ঘুঘু চড়িয়েছে। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে প্রায় ৮ লাখ নাগরিককে দেশ ছাড়া করে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য করেছে সামরিক জান্তা ও তাদের মদদপুষ্ট সু চি। বিশ্বগণমাধ্যমকে নিষিদ্ধ করে তারা ওই নিধনযজ্ঞ চালিয়েছে। কিন্তু তারপরও সীমিত পরিসরে বিশ্বগণমাধ্যমে যে চিত্র বেরিয়ে এসেছে, তা মানবেতিহাসে নজিরবিহীন। আন্তর্জাতিক আইন তথা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধগুলোর মধ্যে জঘন্যতম অপরাধের সঙ্গেই শুধু এর তুলনা চলে। কিন্তু কথায় বলে, চোরের মায়ের বড় গলা। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের শুধু মেরে কেটে ঘর ছাড়াই করেনি, তাদের জাতিগত পরিচয় নিয়েও মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দিচ্ছে বিশ্ববাসীকে। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের যে দেশ মানবিক কারণে আশ্রয় দিলো উল্টো সেই বাংলাদেশকেই দুষছে মিয়ানমার। মিথ্যা শুধু মিথ্যারই জন্ম দেয়-Lie Propagates Lies।

মিয়ানমার যে অন্যায় অপরাধ করেছে, মিথ্যা প্রচার ছাড়া আসলে তাদের আর কোনো উপায়ও নেই। কাজেই প্রোপাগান্ডাই তাদের কূটনীতি। কূটনীতি মূলত শক্তি বা প্রেশার গেমের এক ভারসাম্য রক্ষার খেলা। সবাই নিজ নিজ শক্তিকে কাজে লাগাতে চায়-এটাই কূটনীতি। মিয়ানমারের শক্তি প্রোপাগান্ডা। হিটলার, মীর জাফর, ইয়াহিয়া-সবারই শক্তি ছিল ওই প্রোপাগান্ডা।

প্রোপাগান্ডা শিরোমণি গোয়েবলসের কয়েকটি বাণী এখানে স্মর্তব্য। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি যদি একটি মিথ্যা মানুষের সামনে বারবার বলতে থাকেন, তাহলে মানুষ এক সময় সেটি বিশ্বাস করতে শুরু করবে।’ কিন্তু এর পরের কথাটি আমরা অনেকেই জানি না। সেটি হচ্ছে, ‘এমনকি আপনিও একদিন সেটা বিশ্বাস করে ফেলবেন।’ মিয়ানমার বিশ্ববাসীর কাছে প্রোপাগান্ডা চালাতে চালাতে নিজেরাও হয়তো সেটি এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। কারণ প্রোপাগান্ডাকারীরা ‘সংবাদ মাধ্যমকে নিজের কী বোর্ড বানায়, যেমন খুশি তেমন সুর বাজায় (এটাও গোয়েবলসই বলেছিলেন)।’ কাজেই মিয়ানমার গোয়েবলসের পুরোপুরি অনুসরণ করে যাচ্ছে। নিজের মতো কী বোড (গণমাধ্যম) বাজিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিয়ানমার নিজেদের সৃষ্ট প্রোপাগান্ডা নিজেরা বিশ্বাস করলেও বিশ্ববাসী মোটেও তা বিশ্বাস করে না। কিন্তু তারপরও প্রোপাগান্ডার একটি নিজস্ব কূটনৈতিক শক্তি আছে। মিয়ানমার সেই শক্তিকেই কাজে লাগাচ্ছে এবং তার ফলও পাচ্ছে। এর ফলেই, প্রায় দুই বছর হয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত দুইশ' জন রোহিঙ্গাকেও তারা নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়নি বা আমরা নিতে বাধ্য করতে পারিনি।

কিন্তু এই প্রোপাগান্ডা বা কূটনীতির লড়াই চালিয়ে রোহিঙ্গা গণহত্যা বা নিধনযজ্ঞের রাষ্ট্রীয় বা আইনি দায় থেকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ শেষমেশ রেহাই পাবে কিনা সেটি বলা মুশকিল। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো, এই জঘন্য অপরাধের ঐতিহাসিক ও নৈতিক দায় থেকে কি মিয়ানমার কোনো দিন মুক্ত হতে পারবে?

তবে আমাদের উদ্বিগ্নতার কারণ নানাবিধ। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলরের ১৫ নভেম্বরের বক্তব্যের প্রতিবাদ করতে বাংলাদেশ ৯ দিন লাগিয়েছে (২৩ নভেম্বর প্রতিবাদ করেছে)। এমনিতেই অন্যায়কারীদের কার্যসূচিতে প্রোপাগান্ডা একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হিসেবে বিবেচিত। যেখানে বাংলাদেশ যদি একটি বক্তব্যের প্রতিবাদ করতে ৯ দিন লাগায়, সেখানে প্রোপাগান্ডাই জয়ী হবে-এটাই স্বাভাবিক। রোহিঙ্গা গণহত্যা তথা বাংলাদেশের শরণার্থী বিষয়টি বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের যেভাবে প্রচার করা প্রয়োজন ছিল, তার সিকিভাগও আমরা করতে পারিনি। আমাদের একাত্তরে অভিজ্ঞতাটাও আমরা কাজে লাগাতে পারিনি।

বিভিন্ন ফোরামে আমরা আমাদের উদ্বিগ্নতার কথা বলেছি এ কথা সত্য। কিন্তু তা বিশ্ববাসীকে কোনো শক্ত বার্তা দিতে পারেনি, পারেনি মিয়ানমারের ওপর কোনো কার্যকর চাপ সৃষ্টি করতে। পক্ষান্তরে মিয়ানমার উপর্যুপরি তার কাজটি ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ প্রচার চালানোর কথা আমাদের, মিয়ানমার যদি পারে তার প্রতিবাদ করবে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিবাদ করতেই সময় পার।

৩.

গোয়েবলসের মতো সু চিও উচ্চশিক্ষিত। অক্সফোর্ড এলামনাই এই রাজনীতিক শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন। বিশ্বে এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর নাই। কিন্তু সেই পুরস্কার তাকে শান্তি দিতে পারেনি। তিনি রাষ্ট্র ক্ষমতার মাঝেই শান্তি খুঁজে পেয়েছেন। তা পেতেই পারেন। কিন্তু এর বিনিময় মূল্য অনেক বেশি। এ প্রসঙ্গে আরেক শান্তি দূত ডেসমন্ড টুটু সু চিকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘হে আমার বোন, মিয়ানমারের রাজনৈতিক ক্ষমতার শিখরে পৌঁছানোই যদি তোমার নীরবতার কারণ হয়ে থাকে, তার জন্য সত্যিই বড় বেশি দাম দিতে হচ্ছে ... ন্যায়পরায়ণতার প্রতীক হয়ে ওঠা একজনের জন্য এমন একটি দেশের নেতৃত্ব দেওয়া বেমানান।’

সু চি বা মিয়ানমারের জন্য ‘ন্যায়পরায়ণতা’র প্রশ্নটির চেয়েও আমাদের জন্য ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ দূর করা বেশি জরুরি। বাংলাদেশকে সে চেষ্টা চালিয়েই যেতে হবে। আমাদের জন্য প্রোপাগান্ডা নয়, প্রচারই যথেষ্ট। নয়তো ভাগ্যের হাতে নিজেকে সপে দিয়ে বসে থাকতে হবে।

তবে, শেষ পর্যন্ত এই গোয়েবলসীয় প্রোপাগান্ডা মিয়ানমারকে দায়মুক্ত করতে পারবে কিনা, সেটি সময়ই বলে দেবে। বাকিটা আমাদের বিধিলিপি।

আমরা শুধু ইতিহাসের কিছু পুন:পাঠ করতে পারি। আমরা জানি, গোয়েবলস ও তাদের গুরুদের শেষটা কিন্তু ভালো যায়নি। অপমানের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন ক্লাইভ। নিজেই নিজের গলায় ছুরি চালান। মীর জাফরের পরিণতি 'বিশ্বাসঘাতক' খেতাব ও কুষ্ঠরোগে মৃত্যু। সস্ত্রীক আত্মহত্যা করেছেন হিটলার। শিষ্য গোয়েবলসও স্ত্রী, ছয় সন্তানসহ আত্মহত্যাকেই বেছে নিয়েছেন জীবনের শেষ পরিণতি হিসেবে। কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে আমরা কারো শেষ পরিণতির জন্য অপেক্ষা করতে পারি না। আমাদের কাজ আমাদের করতেই হবে। মিথ্যার বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

সবশেষে গোয়েবলসের আরেকটি বাণী বলে যেতে চাই। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা ইতিহাসে ঠাঁই পাব হয় সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র অধিনায়ক অথবা সর্বশ্রেষ্ঠ অপরাধী হিসেবে।’ হিটলার-গোয়েবলস গংরা কোথায় ঠাঁই পেয়েছেন তা আজ আমরা জানি। কিন্তু সু চি-মিং অন হ্লাইং গংদের ঠাঁই কোথায় হবে, ইতিহাসের সে পাঠটি এখনও বাকি আছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর