উন্নয়ন প্রযোজনায় জনগণ আউট অফ ফোকাস

, যুক্তিতর্ক

তুষার আবদুল্লাহ | 2023-08-22 04:00:30

নাগরিক হিসেবে আমরা সকলেই উন্নয়ন চলচ্চিত্রের দর্শক। যিনি মোটেও চলচ্চিত্র দেখতে আগ্রহী নন, তিনিও বাধ্য হন উন্নয়নের সিনেমা দেখতে। এই সিনেমার প্রদর্শনী চলে শহর নগর গ্রামে। রাজনীতি উন্নয়ন চলচ্চিত্রের প্রযোজক। যখন যে দল সরকারে থাকে সেই দলের প্রযোজনায় চলে উন্নয়ন যজ্ঞ। তাই যে সরকারের সময়ে যে উন্নয়ন, যেমন উন্নয়ন—তাতে সরকারের দূরকে দেখার চোখ, জনগণকে বোঝার মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে আঁচ পাওয়া যায়।

উন্নয়নের নকশায় সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলের রুচির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। স্বাধীনতার পর থেকে সরকারে আসা রাজনৈতিক দলগুলোর উন্নয়ন দর্শন দেখে আসছে বাংলাদেশ। দেখে আসছে বলার মধ্যদিয়েই আসলে বলে ফেলা যাচ্ছে—দৃশ্যমান উন্নয়নই রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মুখ্য বিষয় ছিল এবং আছে। নদী বা খালের ওপর ছোট সেতু, কালভার্ট তৈরি, কারো বাড়ির উঠোনের পাশে মাটির সড়ক বাঁধা, স্কুল-মাদ্রাসার দালান তৈরি থেকে শুরু করে যমুনা-পদ্মার বুকে সেতু তৈরি, চারলেনের সড়ক, উড়াল সেতু সকলই—উন্নয়নের টালি খাতায় লেখা আছে। এই সকল উন্নয়নই দৃশ্যমান উন্নয়ন। কী প্রক্রিয়ায় এই কর্ম সম্পাদিত হচ্ছে, তা থেকে জনমানুষ কী উপকার পাচ্ছে তা পর্যবেক্ষণও কিন্তু এক প্রকার সিনেমাই। যার পরিচালক আমাদের জনপ্রতিনিধিরা।

গ্রাম- গঞ্জের পরিচিত সিকোয়েন্স নদী বা খালের মাঝখানে কালভার্ট বা নাতিদীর্ঘ সেতু দাঁড়িয়ে আছে। তার দুই পাশের সড়ক তৈরি হয়নি। কোথাও কোথাও জমির আইলের ওপর দিয়ে সরু রাস্তা আধা কিলো তৈরি হয়ে আটকে আছে দশকের কাছাকাছি। কোথাও কোথাও যুগের অধিক পাওয়াটাও বিরল নয়। বিদ্যুতের খুঁটি গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে কিন্তু সেই খুঁটি দিয়ে তার বহমান হয়নি। উড়াল সেতু উড়াল দিয়েছে শহরে নগরে, কিন্তু সেই সেতু কেবলই দোতলা সড়ক ছাড়া আর কিছু হয়নি। যানজট কমেনি বরং আরো ঘন ও দীর্ঘ হয়েছে। কোথাও রেললাইন খাটো করা হয়েছে, উপড়ে ফেলা হয়েছে প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও। আবার বেহুদাই কোথাও কোথাও রেললাইন বসানো হয়েছে। উন্নয়নের নামে জলপথ বন্ধ করা হয়েছে নদী দখল করে। একথা কী করে আমাদের উন্নয়ন চলচ্চিত্রের পরিচালকরা অস্বীকার করবেন—সু এর চেয়ে কু-পরিকল্পনা দিয়েই অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা উন্নয়নের গল্প সাজিয়েছেন।

ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা, জেলা এবং রাজধানীতে যে উন্নয়ন দৃশ্যমান সেখানে কতটা জনমতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে? ইউনিয়ন-উপজেলা, পৌরসভায় উন্নয়ন প্রকল্পের কাহিনীকার সংসদ সদস্য। আইনত এই কাহিনী তার রচনা করার কথা নয়। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা থেকে প্রকল্প আসবে, কিন্তু এই রীতি মানা হয় না। যতটুকু সুযোগ পান ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং পৌর-সিটি মেয়ররা, সেইটুকুতে নিজেরাই একক কাহিনীকার বা পরিচালক হয়ে যান। সহপরিচালক হিসেবে ইউনিয়ন, উপজেলা ও পৌরপরিষদের অন্যান্য সদস্য এবং কাউন্সিলরদের কোনো সুযোগ থাকে না সেই উন্নয়ন নির্মাণে। ফলে নির্মাণ প্রক্রিয়াতেই বাহ্যিকভাবে জনগণের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়ে যায়। নির্বাচনের আগে ভোটারের বাড়িতে কড়া নেড়ে যে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি বা মহাপরিকল্পনার কথা বলা হয়, সেই উন্নয়ন পরবর্তীতে ভোট-স্বার্থ অনুসারে বাস্তবায়িত হতে থাকে। ফলে কোনো এলাকার সার্বিক জনগোষ্ঠী একযোগে সেই উন্নয়নের স্বাদ পান না। ভোটের সুবিধাজনক এলাকামতো সেই উন্নয়নের বিলি বণ্টন হয়।

স্থানীয় সরকার বা তৃণমূলের উন্নয়নের বাইরে কেন্দ্র থেকে সরকার সরাসরি অনেক উন্নয়ন পরিচালনা করে। পদ্মা সেতু, ঢাকা চট্টগ্রাম চারলেনের মহাসড়ক, পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা সমুদ্রবন্দর, রামপাল-মাতারবাড়ী কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল—এধরনের প্রকল্পগুলোও দৃশ্যমান। ভোটারদের, নাগরিকদের চমকে দেয় যেমন তেমনি দেশের মজবুত অর্থনীতির বিষয়ে আস্থাশীলও করে তোলে। তবে রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের রকমারি দুষ্টচক্রে এই উন্নয়নগুলোর পথচিত্র ও নকশায় জনস্বপ্ন কখনো কখনো উপেক্ষিত থাকে। ফলে নাগরিক তার অধিকার নিয়ে সংশয়ে পড়ে যায়। রাষ্ট্রের দৃশ্যমান উন্নয়নের সঙ্গে নাগরিকেরা তার অধিকারের উন্নয়নের ভারসাম্যটাও পরিমাপ করে নিতে চায়। যদি দুইয়ের মাঝে দূরত্ব বড় হয় তবে দৃশ্যমান উন্নয়ন উপভোগে জনগণ স্বাচ্ছন্দবোধ করে না। নাগরিক বা জনমানুষকে উন্নয়ন উপভোগে স্বাচ্ছন্দ দেওয়াও উন্নয়নের অংশ। রাষ্ট্রকে একথা উপলব্ধি করতে হবে।

তুষার আবদুল্লাহ
বার্তা প্রধান, সময় টেলিভিশন

এ সম্পর্কিত আরও খবর