উৎসবের শুরু। বাড়িতে গোছগাছ শুরু হয়ে গেছে। পর্দার রং বদলে গেল। ঘরে নতুন আসবাব ঢুকলো কিছু। পুরনোগুলোকেও এদিক সেদিক সরিয়ে চোখে নতুন লাগানোর চেষ্টা। খাবার-দাবার তৈরি নিয়েও শুরু হয়ে গেছে হৈ চৈ। কে কোন খাবার পছন্দ করে। কার জন্য কে কোন খাবার তৈরি করবে। সঙ্গে দৃশ্য আলাপনে দেখানো হচ্ছে ওদের পছন্দ মতো সব কিছু হচ্ছে কিনা। ওদের জন্য তৈরি হচ্ছে নতুন পোশাক। সঙ্গে সবাই মিলে ঘুরে বেড়ানোর একটা ফর্দও তৈরি হয়ে গেছে।
এতো আনন্দ, এতো আয়োজনের মধ্যেও আমার মন ভালো নেই। জানি, মন খারাপের দিন আসছে। অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যাবো। যারা আসছে বিদেশ বিভুঁই থেকে, তারা নিয়ম করে বছর দুই-তিন পর একযোগে আসে। আজকাল বিভুঁই বলার সুযোগ কই। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা, লন্ডনতো পাশের পাড়াই। নিজের দ্বিতীয় বাড়ি ভেবে বাসা বদল করে চলে গেছেন পরিবারের অনেকে। কারো কারো গোছগাছ চলছে বাড়ি বদলের। যারা বাড়ি বদল করে যাচ্ছেন, গেছেন, তাদের অনেকেই রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মহল্লার কর্মী বা নেতৃত্বে ছিলেন। কারো কারো অনুসারী ছিল। যারা তাকে বা তাদের অনুসরণ করতেন, তারা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যান এদের বাড়ি বদল দেখে। যারা জনগনকে বাংলা ও বাংলাদেশ নিয়ে সদা জাগ্রত রাখার বয়ান দিতেন, তারাই উড়াল দিলো অন্য ডালে? শুধু কি উড়াল ? নতুন বাড়িতে গিয়ে আচারও ভুলে বসলো বাংলাদেশ। উদার মানুষটির মৌলবাদী রূপান্তর ঘটলো। বাঙালি সংস্কৃতিমনা স্কুল ছিল যার আরাধ্য, তিনি নয়া বাড়িতে গিয়ে পুত্র কন্যাকে পাঠালেন মাদ্রাসায়। এমন মানুষ সদৃশ্যরাই আসছেন। তাদের পুত্র কন্যারা বাংলায় কথা বলতে পারে না। যদিও তাদের জন্ম হয়েছিল ঢাকাতেই। বলতে পারে না যখন তখন বাংলা পড়তে। না পারাটাই স্বাভাবিক। বাবা মায়েরা তাদের সন্তানদের কাছে অদ্ভুত, নষ্ট ও আতঙ্কিত যে দেশটির গল্প বলে রাত দিন, সেই শহরের নাম নাকি বাংলাদেশ। ভূতের ছবি দেখতে যাবার মতোই শখ করে কি ওরা আসছে বাংলাদেশে? ওদের আগের সফরগুলো দেখে তেমনই মনে হয়েছে। তাই ভয় পাচ্ছি পুরনো ছবি দেখে ওরা মজা পাবে তো?
এলোমেলো মন নিয়ে ভোরের বাজারে যাই। হেমন্তের বিদায় লগ্ন। ভোরে শীতের ছায়া। বাজারেও তাই। শীতের সবজির রং দেখে মনটাও সবুজ হয়ে যাবার কথা। এখন আর হয় না। কারণ এই সবুজ রং-ও নাকি আরোপিত। কীটনাশক আর কৃত্রিম রঙে রাঙা করে তাদের বাজারে আনা হয়। তাদের বাইরের সবুজ দেখে আমার পুলকিত হওয়া মানে প্রতারিত হওয়া।
বাড়ি বদলে ফেলা মানুষদের মতোই সবজির চরিত্র এখন। তারপরও জীবনের প্রয়োজনে থলেতে তুলে নিতে হয়। যেমন করে বুকে নিতে হয় ছেড়ে যাওয়া মানুষগুলোকে। নতুন সবজির সঙ্গে পানিফল, শালুক তুলে নেই। গ্রামের খাল-বিল হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শালুক, পানিফলও হারিয়ে যাচ্ছে। জলপাইও নিলাম। বাজার ভরে আছে জলপাইতে।
বাড়ি ফিরে ছেলেমেয়েদের আহ্লাদের সঙ্গে ডেকে হাতে পানিফল তুলে দেই। ওদের চোখে বিস্ময় ও সংশয়—এটা কী? বললাম—পানিফল । আর ওটা? বললাম –শালুক। ওরা পানিফল ও শালুক রেখে জলপাই তুলে নিয়ে বলে—এতো তাড়াতাড়ি বাজারে বড়ই চলে এলো। বিস্মিত আমি, ওরা এখনো জলপাই চেনে না ? শালুক, পানিফল তো আরো বিরল। আমি মাথা নিচু করে উঠে আসি ছাদে। দেখলাম ছাদে অগ্রহায়ণের হাওয়ায় বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। বিজয় মাসের প্রথম দিন বলে পতাকা উড়ানো হয়েছে। পতাকার দিকে তাকিয়ে ভাবি—কী লাভ এই দৃশ্যমান পতাকা উড়িয়ে? যখন সন্তানকে জলপাই চেনাতে পারলাম না তার কুড়ি বছরেও।
তুষার আবদুল্লাহ: বার্তা প্রধান, সময় টেলিভিশন।