দৃশ্য-শ্রাব্য-লেখ্য-কথ্য’র নতুন ধারার সাংবাদিকতা

, যুক্তিতর্ক

রাজীব নন্দী, কনসাল্টিং এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-08-31 19:26:51

কথায় আছে, ভালো সাংবাদিকরা নীতিমালার জন্য অপেক্ষা করে না, দুষ্টু সাংবাদিকরা নীতিমালার তোয়াক্কা করে না। রম্য কথাসাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী ব্যঙ্গার্থে বলেছেন—“না ভাবিয়া লিখিলে জার্নালিজম, ভাবিয়া লিখিলে সাহিত্য।” (সূত্র: প্রমথনাথ বিশী, বাঙালী ও বাংলা সাহিত্য, বেঙ্গল পাবলিশার্স, কলকাতা-১২, ২০০৮)। সাংবাদিকের সংজ্ঞায় বাংলাদেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ড. আকবর আলি খান লিখেছেন—“সাংবাদিক হচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি নিজে যা বোঝেন না তা সবাইকে বুঝিয়ে বেড়ান।” (আকবর আলি খান; পরার্থপরতার অর্থনীতি, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড-ইউপিএল, ঢাকা, ২০০০)। সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের নিয়ে দুই বাংলার দুই বুদ্ধিজীবীর ব্যঙ্গার্থ ‘অযথা’ নয়। নৈতিকতার চর্চায় পথভ্রষ্ট সাংবাদিকতাকে এভাবেই ফালাফালা করা হয়েছে। জনকল্যাণের জন্য যে সাংবাদিকতা, তা যখন নৈতিকতা-পরিপন্থী হয়ে ওঠে, তখন এইভাবে সমালোচনা না করে পারা যায় না। 

অনলাইন মাধ্যমের সংজ্ঞায় বলা হচ্ছে—“Digital media, which includes photos, video and music, distributed over the Internet, which are either non-copyrighted or copyrighted materials provided either freely or for a fee.”

অনলাইন ভিত্তিক সাংবাদিকতার মূল উপজীব্য ডিজিটাল মিডিয়া। অনলাইন মাধ্যমকে আশ্রয় করে অনলাইন গণমাধ্যম গড়ে ওঠে। ১৯৯৬-এর মাঝামাঝি বাংলাদেশ যখন ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় তখন থেকে ঢাকার দু একটি জাতীয় দৈনিক এই ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করে। ১৯৯৭ সালের শেষদিকে কয়েকটি পত্রিকা তাদের ওয়েবসাইট সংস্করণের প্রচলন ঘটায়। বাংলাদেশের অনলাইন সাংবাদিকতার জনক, বিডিনিউজের প্রাক্তন এডিটর ইন-চিফ আলমগীর হোসেন বাংলাদেশে প্রথম অনলাইন গণমাধ্যম ‘বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর.কম’ প্রতিষ্ঠার কথা তুলে ধরে এক নিবন্ধে বলেন—“চলুন ২০০৪ সালে ফিরি। সাড়ে তিন দশকের প্রিন্ট মিডিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছিল অনলাইনই হয়ে উঠবে সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়া। ভাবনা গাঢ় হতে থাকল। বাংলাদেশে এমন একটি মিডিয়ার নাম কী হতে পারে? একটি নামও মনে এলো—বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর.কম। জয়েন্ট স্টক কোম্পানির আদলে প্রতিষ্ঠা করে ফেলি একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল। ‍পুরো নাম বাংলাদেশ নিউজ টোয়েন্টিফোর আওয়ারস লিমিটেড।” (সূত্র: সকালের খবর দুপুরে, বিকেলেরটা রাতে বাসি হয়ে যায়, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর ডটকম/ ২০১৭-০৯-১৬) সেই ২০০৪ থেকে যাত্রা শুরু। পেরিয়ে গেল ১৫টি বছর।

“পৃথিবীর অনেক দেশে নামকরা অনেক সংবাদপত্রের ছাপা সংস্করণ বন্ধ হয়ে গেছে, তারা শুধু অনলাইন সংস্করণ প্রকাশ করছে। টেলিভিশনের দর্শকও ভীষণভাবে কমে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে সাংবাদিকতা এখন একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। রাজনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও ব্যবসায়িক—তিন দিক থেকেই একটা ক্রান্তিকাল।” (সূত্র: সাংবাদিকতা এখন বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি: মাহ্ফুজ আনাম, প্রথম আলো/ ০৩-১১-২০১৯) এর একটি বড় উদাহারণ বাংলাদেশের অভিজাত ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা দ্য ডেইলি স্টারের বিশেষ সাময়িকী দ্য স্টার উইকেন্ড ম্যাগাজিন হিসাবে প্রকাশিত হতো, তা ছাপা বন্ধ করা। ২৯ নভেম্বর ম্যাগাজিনটির শেষ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়—“23 years and three avatars later, the Star Weekend magazine arrives upon its last ever edition. Being your Friday companion has been an education in hard work and creativity. As we face the curtain call, we offer to you one last critical look at something we care passionately about, and offer in the process an explanation as to what catalysed the last chapter of Star Weekend. This week, as we end, we talk about the future of journalism.”

স্টার উইকেন্ড ম্যাগাজিনের শেষ সংখ্যা

ফলে দেখা যাচ্ছে, পদ্ধতিগতভাবে বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় একটি নীরব পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। কাগজ এবং টেলিভিশন দুই ধারার সাংবাদিকতাই এখন অনলাইনে হাজিরা দিতে বাধ্য হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, সাংবাদিকতার প্রযুক্তিগত, প্রথাগত সকল ধারণা নবায়নের সময় এসেছে। শুধু নবায়ন নয়, বাতিলও করে দিতে হবে বহুকিছু। এমন একটি দিন আসছে সামনে, একজন সাংবাদিককে দৃশ্য-শ্রাব্য-কথ্য-লেখ্য—চার মাধ্যমেই সচল থাকতে হবে। যার নাম বহুমাধ্যম সাংবাদিকতা বা ‘মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম’। একে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, কারণ এটি আপনার জীবনের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকবে।

দেশের সব অনলাইন গণমাধ্যমকে অনলাইন নীতিমালার আওতায় নিবন্ধিত হতে হবে উল্লেখ করে জাতীয় সংসদে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, “২ হাজার ২১৭টি অনলাইন মিডিয়া রয়েছে। যার মধ্যে অনলাইন পত্রিকা ১ হাজার ৮৭৪টি ও ইন্টারনেট টেলিভিশন ২৫৭টি, অনলাইন রেডিও ৪৫টি ও ই-পেপার ৪১টি।” (সূত্র: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, প্রথম আলো অনলাইন, সব অনলাইন নিবন্ধিত হবে: তথ্যমন্ত্রী) এদিকে নিবন্ধনের জন্য সরকারের কাছে আট হাজারের বেশি অনলাইন নিউজ পোর্টালের আবেদন জমা পড়েছে বলে জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। (সূত্র: বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর.কম, ‘নিবন্ধন চায় ৮০০০ অনলাইন নিউজ পোর্টাল’, ১৫ জুলাই ২০১৯)।

বাংলাদেশের যখন অনলাইন সাংবাদিকতার এই হাল, তখন চোখ ফেরাই বৈশ্বিক চেহারার দিকে। বিশ্বের ৬২ শতাংশ মানুষ এখন মনে করছে, ডিজিটাল মিডিয়া তাদেরকে চলমান ঘটনাবলি সম্পর্কে খুব ভালো করেই আপডেটেড রাখতে পারছে। আর নিউজ মিডিয়াগুলো ব্রেকিং নিউজ সরবরাহেও ভালো করছে। খবরের ব্যাখ্যার চেয়ে খবরটি জানিয়ে দিতে তারা আস্থার সাথে কাজ করতে পারছে (সূত্র: রয়টার্স ইনস্টিটিউট ডিজিটাল নিউজ রিপোর্ট ২০১৯)।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সব প্রচার-প্রচারণায় পক্ষকালব্যাপী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, জোট ও ব্যক্তি স্ব-স্ব বক্তব্য নিয়ে অনলাইনে সরব থেকেছেন। ভোটের মাঠে শুধু ডিজিটাল প্রচারণাই নয়, যোগাযোগবিদ্যার ভাষায় আমরা দেখেছি—বহুমাধ্যমাশ্রিত বৈদ্যুতিন জনপ্রিয় রাজনৈতিক যোগাযোগ। বাংলাদেশ যেহেতু সনাতনী সমাজ থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে প্রাযুক্তিক সমাজে পা দিয়েছে, ফলে একে বলা যেতে পারে মাল্টিমিডিয়া পলিটিক্যাল কমিউনেকশন ইন ডিজিটাল ইলেকশন। বাংলাদেশের মাল্টিমিডিয়ার বিকাশ বা অনলাইন সাংবাদিকতার বিকাশের ব্যাপারে কথা বলেছি বাংলাদেশের মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজমের অন্যতম প্রবক্তা আলমগীর হোসেনের সঙ্গে। যিনি বর্তমানে বার্তা২৪.কমের সম্পাদক। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে আজ থেকে এক যুগ আগে আমরা অনলাইন সাংবাদিকতার যাত্রা শুরু করেছিলাম। আজ দৃশ্যপট অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অনলাইন সাংবাদিকতা ভার্চুয়াল টেক্সট নির্ভরই নয় কেবল, মাল্টিমিডিয়াই এখন সাংবাদিকতার প্রাণ। ডিজিটাল সাংবাদিকতার প্রসারের কারণে এখন নির্বাচনের মতো বড় বড় ইভেন্ট জনপ্রিয় হয়ে যাচ্ছে। মাল্টিমিডিয়ার প্রসারের কারণে সংবাদ পরিবেশন, সংবাদের পাঠকপ্রিয়তা এবং আলোচিত সংবাদ ভাইরাল হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে গেছে বহুগুণ।”

“সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন কদিন আগেই আমরা ভোলায় দেখলাম; তার আগে দেখেছি রামুতে। এভাবে আমরা দেখছি এক সম্প্রদায়ের মানুষ আরেক সম্প্রদায়ের মানুষকে বিপদে ফেলার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করছে।” (সূত্র: সাংবাদিকতা এখন বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি: মাহ্ফুজ আনাম, প্রথম আলো/ ০৩-১১-২০১৯) তবুও অনলাইন গণমাধ্যম একটি সামাজিক মাধ্যম হিসেবে যে অনন্য বৈশিষ্ট্য আমাদের সামনে বিরাজমান, তার শক্তি ও সৌন্দর্যের দিকটি উপলব্ধি করতে হবে। অনলাইন গণমাধ্যম সারা বিশ্বের কোটি মানুষের মধ্যে মুহূর্তেই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার শক্তিশালী মাধ্যম। এই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মানে অনলাইনে মিথ্যা তথ্য, গুজব, ভুয়া ভিডিও, ম্যানুপোলেটেড ছবি পরিবেশন নয়, বরং দায়িত্বশীলতার সাথে দ্রুততার মিশেলে সংবাদ পরিবেশন। অনলাইন গণমাধ্যম সারা দুনিয়াজুড়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার একটি পাটাতন।

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ তার ইউকিলিক্স-কাণ্ডে দেখিয়ে দিয়েছেন অনলাইন সাংবাদিকতা চাইলে কী করতে পারে! এডওয়ার্ড স্নোডেন তার গুপ্তচরবৃত্তির পরিসর ভেঙে অনলাইন দুনিয়ার নতুন চেহারা হাজির করেছেন। অনলাইন সাংবাদিকতা তাই আজ মোবাইল জার্নালিজম (মোজো), ডাটা জার্নালিজম, সাংবাদিকতায় প্রোগ্রামিংয়ের ব্যবহারসহ নানা মাত্রায় নতুন নতুন রূপ হয়ে আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে। সাংবাদিকতার এই একটি মহা চ্যালেঞ্জ। ফলে এই আধুনিকতার সঙ্গে যুক্ত হতে না পারলে বা নিজেকে প্রশিক্ষিত না করলে গ্লোবাল চ্যালেঞ্জে টিকে থাকা অসম্ভব। কারণ, সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন উড়ে গিয়েছে, বিদায় নিয়েছে রেডিও, পত্রিকাও যাই যাই করছে। সব মিডিয়া ঘরে আসবে—সব টিভি—ফুরাবে সব লেনদেন; থাকবে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার মাল্টিমিডিয়া মোবাইল ফোন।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এ সম্পর্কিত আরও খবর