বিশ্ব বিবেককে গ্লানিমুক্ত করলো গাম্বিয়া

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-27 22:13:26

নাম জানলেও পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতাম না। গুগল আর্থে সার্চ দিয়ে দেখলাম আটলান্টিক মহাসাগরের তীর থেকে সেনেগালের পেটের ভেতর ঢুকে যাওয়া গাম্বিয়াকে একটা স্ট্রিপের মত লাগে। লম্বায় ৩২০ কিলোমিটার হলেও প্রস্থে সর্বোচ্চ মাত্র ৫০ কিলোমিটার। ১০ হাজার ৬৮৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের গাম্বিয়ার জনসংখ্যা মাত্র ১৮ লাখ ৫৭ হাজার ১৮১ জন। উইকিপিডিয়া বলছে, এটি আফ্রিকা মহাদেশের মূল ভূখণ্ডের ক্ষুদ্রতম দেশ। গাম্বিয়া উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে সেনেগাল দ্বারা পরিবেষ্টিত। পশ্চিমে রয়েছে আটলান্টিক মহাসাগর। গাম্বিয়া নদী দেশটির মধ্যভাগ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে পড়েছে। বন্দর শহর বাঞ্জুল দেশটির রাজধানী। গাম্বিয়া একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এখানকার বেশির ভাগ মানুষ দরিদ্র। চীনাবাদাম এখানকার প্রধান উৎপাদিত শস্য এবং প্রধান রপ্তানি দ্রব্য। পর্যটন শিল্প থেকেও আয় হয়। আটলান্টিক সাগরের উপকূলের সমুদ্রসৈকতগুলিতে ঘুরতে এবং গাম্বিয়া নদীর বিচিত্র পাখপাখালি দেখতে পর্যটকেরা গাম্বিয়াতে আসেন। গাম্বিয়া উনবিংশ শতকে একটি ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়। ১৯৬৫ সালে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর দেশটি একটি স্থিতিশীল গণতন্ত্র হিসেবে গণ্য হয়। হঠাৎ করে গাম্বিয়া নিয়ে এই কৌতূহলের কারণ না দেখা এই দেশটি আমার হৃদয়ের খুব কোমল একটি জায়গা চিরদিনের জন্য দখল করে নিয়েছে। পশ্চিম আফ্রিকার এই ছোট্ট দেশটি বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১১ হাজার মাইল দূরে। কিন্তু আমি ঘোষণা করছি, গাম্বিয়া আমার হৃদয়ের খুব কাছেই আছে, চিরদিন থাকবে।

ছোট্ট এই দেশটি গোটা বিশ্বকে একটা বড় গ্লানি থেকে মুক্তি দিয়েছে। গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) নিতে পেরেছে। ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যা করছে, তা সুস্পষ্টতই গণহত্যা। মিয়ানমারের মূল লক্ষ্য রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। মিয়ানমার কাগজে-কলমে রোহিঙ্গাদের অস্তিত্বহীন করেছে অনেক আগেই। এখন তাদের চাওয়া মিয়ানমারকে রোহিঙ্গামুক্ত করা। হত্যা-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ-লুটপাট চালিয়ে রোহিঙ্গাদের বাস্তচ্যুত করেছে মিয়ানমার। একাত্তর সালে ইয়াহিয়া খান তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের শুধু মাটি চেয়েছিল, মানুষ চায়নি। মিয়ানমারের শাসকরাও আরাকান রাজ্যের মাটি চায়, মানুষ চায় না। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচারে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের আগে-পরে মিলিয়ে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বাংলাদেশের চেয়ে কম রোহিঙ্গা এখন আছে মিয়ানমারে। তারা সেখানে আছে আতঙ্কে আর প্রায় বন্দী অবস্থায়। সুযোগ পেলে তাদেরকেও তাড়িয়ে দেবে মিয়ানমার। ২০১৭ সালের আগস্টে চালানো গণহত্যার সময় আন্তর্জাতিক কোনো মিডিয়া বা পক্ষকেই রাখাইন যিওয়ার অনুমতি দেয়নি মিয়ানমার। তবু স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি আর কোনো রকমে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সাক্ষ্যে উঠে আসে হত্যাযজ্ঞ আর নির্যাতনের ভয়াবহতা আর নির্মমতা। রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিয়ে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে মিয়ানমার। এই যে এখন প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। রোহিঙ্গারা যদি ফিরে যায়ও, তারা কখনোই তাদের পৈতৃক ভিটায় ফিরতে পারবে না। কারণ সে ভিটার আর কোনো অস্তিত্ব নেই। এত কিছু করেও মিয়ানমার বারবার তাদের অপরাধ অস্বীকার করে আসছে।

২০১৭ সালের আগস্টের পর থেকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু প্রশংসায় তো আর পেট ভরবে না বাংলাদেশের। মিয়ানমার থেকে আসা ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে রাখাই শুধু নয়, তাদের অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা সব মৌলিক চাহিদাই মেটাতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের এক কোটি মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল ভারতে। মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করা বাংলাদেশ তাই বিপন্ন রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে উদারভাবেই। কিন্তু একাত্তরে বিজয়ের পর বাংলাদেশ থেকে যাওয়া শরণার্থীরা ফিরে এসেছিল। কিন্তু সমস্যা হলো, রোহিঙ্গারা কবে ফিরে যাবে? মিয়ানমার তো তাদের স্বীকারই করে না। অধিকাংশ রাষ্ট্র বাংলাদেশের পক্ষে থাকলেও আরাকানে নির্যাতন বন্ধ এবং বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কার্যকর কোনো উদ্যোগ কেউ নেয়নি। মিয়ানমারের ওপর কার্যকর চাপ দিতে পারে চীন। কিন্তু সেই চীন তো বরাবরই মিয়ানমারের পক্ষে। এমনকি ভারত, রাশিয়া, জাপানও স্বার্থ বিবেচনায় মিয়ানমারের পক্ষে দাড়ায়। এদের সমর্থনে মিয়ানমার দুর্বীণিত হয়ে ওঠে। তখন থেকে আমার একটা প্রশ্ন ছিল, স্বার্থটাই কি সব; ন্যায্যতা, মানবতা, নৈতিকতা বলে কি কিছু নেই? থাকলে চীন, ভারত, রাশিয়ার মত রাষ্ট্র কীভাবে মিয়ানমারের মত গণহত্যাকারীর পক্ষে দাড়ায়। এই প্রশ্ন আমি ডিপ্লোম্যাট, আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের করেছি। তারা বলছেন, এখনকার বিশ্বে স্বার্থটাই আগে; মানবতা, ন্যায্যতা পরে। তাতে সভ্যতার ওপরই আমার বিশ্বাস কমে যাচ্ছিল। বিশ্বের সবার চোখের সামনে মিয়ানমার দিনের পর দিন একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে; আর তাদের কেউ থামাতে পারবে না; এই যদি হয় বাস্তবতা, তাহলে আর এত বড় বড় কথা বলে লাভ কি। সভ্যতার এত বড়াই করে লাভ কি। মানবতার ওপর, সভ্যতার ওপর হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাস আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে গাম্বিয়া। গত ১১ নভেম্বর গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে হেগের আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে মামলা করা হয়েছে। সেই মামলার শুনানি হচ্ছে এখন। শুনানি শেষে কী রায় আসবে আমরা জানি না। কিন্তু গাম্বিয়া প্রমাণ করেছে, এই বিশ্বে অপরাধ করে, গণহত্যা চালিয়ে পার পাওয়া যাবে না। বড় বড় দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মত নৈতিক শক্তি আছে গাম্বিয়ার মত ছোট দেশেরও।

মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের পর ওআইসি নানাভাবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করে। প্রথমে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাইয়ে কাজে লাগানোর চেষ্টা হলেও তারা এগিয়ে না আসায় সেটা হয়নি। পরে ওআইসি গাম্বিয়াকে সমর্থন দেয়। মামলাটি গাম্বিয়ারই, অন্যরা তাদের সহায়তা করবে মাত্র।

গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে প্রথম দিনের শুনানিতে দার্শনিক এডমন্ড বার্কের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, দুষ্টের জয়ী হওয়ার জন্য একমাত্র যা প্রয়োজন, তা হলো ভালো মানুষদের নীরব থাকা। 'মিয়ানমারে গণহত্যা প্রসঙ্গে গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী বলেছেন, বিশ্ব দীর্ঘদিন নীরব থাকায় এমনটা ঘটেছে। কিন্তু বিশ্ব বিবেকের কালিমা মোচনে আর দেরি করা চলে না।'

বিশ্ব মানবতা, সভ্যতার ওপর আমার বিশ্বাস ফিরিয়ে দেয়ায় গাম্বিয়াকে অভিবাদন। এই লড়াই গাম্বিয়ার একার লড়াই নয়। এটা মানবতার লড়াই। এই লড়াইয়ে মানবতাকেই জিততে হবে।

 

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

এ সম্পর্কিত আরও খবর