জাতি রাষ্ট্রের উত্থান ও মহান বিজয় দিবসে আমাদের প্রত্যাশা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মো. হাবিবুর রহমান | 2023-09-01 06:33:35

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে রাষ্ট্রের গঠন ও উৎপত্তি এক যুগান্তকারী ঘটনা। রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রাষ্ট্রের ইতিহাস নিয়ে সমাজবিজ্ঞান ও রাজনৈতিক দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপক বিশ্লেষণ ও পার্থক্য রয়েছে। রাষ্ট্রের রাজনৈতিক তত্ত্ব ও সামাজিক-বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নিয়ে দার্শনিকরা তাদের মতামত বিভিন্ন সময় তুলে ধরেছেন।

মানব সমাজের ইতিহাস এক শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। জ্য জ্যাক রুশো বলেছেন, মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্ম গ্রহণ করলেও সর্বত্র সে শৃঙ্খলার কবলে আবদ্ধ। কোনো মানুষ চিরকাল শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়ে থাকতে চায় না। সব মানুষই নিজের স্বকীয়তা বজায় রেখে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে চায়।

ইতিমধ্যে পৃথিবীর অনেক দেশই স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আবার অনেক মুক্তিকামী মানুষ এখনও স্বাধীন হওয়ার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র থেকে মুক্তি পেতে সব রাষ্ট্রকে বাংলাদেশের মতো স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা ও আত্মত্যাগ করতে হয়নি। যদিও কেউ কেউ বিনা যুদ্ধে স্বাধীনতা লাভ করেছে। আবার কোনো রাষ্ট্র আমাদের মতো সংগ্রাম ও স্বাধীনতা আন্দোলনকে চূড়ান্ত বিজয়ে রূপদান করেছে।

স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস স্থান কাল পাত্র ভেদে ভিন্ন হয়। জাতি হিসেবে আমরা খুবই সৌভাগ্যবান যে আমরা অল্প সময়ের মধ্যে স্বাধীনতা লাভ করেছি। ভিয়েতনামসহ অন্যান্য জাতির যেখানে আরো বেশি সময় লেগেছে। আবার অনেকে আমাদের চেয়ে অল্প সময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে।

পৃথিবীর দুটি রাষ্ট্র-যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা অর্জন করতে ১৭৭৫ থেকে ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময় লেগেছে সেখানে বাংলাদেশের লেগেছে দীর্ঘ ৯ মাস। মূলত পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। ধর্ম ও ভ্রাতৃত্বের দোহাই দিয়ে পাকিস্তান ভাঙন ঠেকাতে চেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর এ দূরভিসন্ধি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান ও বাঙালি জাতি বুঝতে পেরেছিল। কারণ তারা জানে, ধর্ম ও ভ্রাতৃত্বের দোহাই দিয়ে মানব হত্যা মহাপাপ। একটি নির্দিষ্ট জাতিকে শোষণ ও বঞ্চনার শিকার করা কোনো জাতির জন্য কল্যাণকর নয়।

পৃথিবীতে কোনো জাতি চিরকাল ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকতে চায় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসও তার ব্যতিক্রম নয়। মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, প্রতিরক্ষা এবং শিক্ষা বৈষম্য থেকে মুক্তি পেতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বাংলাদেশকে স্বাধীন করে। এ স্বপ্নকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার জন্য প্রথমত অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। পরবর্তীতে তা স্বাধীনতা আন্দোলনে পরিণত হয়। ফলত, স্বাধীন দেশ হিসেবে আমরা বিশ্বের মানচিত্রে একটি লাল সবুজের পতাকা উড়াতে সক্ষম হই।

মহান বিজয় দিবস আমাদের জন্য সর্বোচ্চ গৌরব ও ঐতিহ্যের দিন। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মাগফেরাত ও সালাম জানানোর পাশাপাশি তাদের লালিত স্বপ্ন ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য আমাদের কাজ করে যাওয়া উচিত। মূলত এর মাধ্যমে তাঁদের প্রতি আমাদের সম্মান ও ভালবাসার প্রকৃত রূপ পরিস্ফুটিত হবে। প্রতিটি নাগরিক তার নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার মাধ্যমে এ দেশটিকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধশীল জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।

একটি দেশের স্বাধীনতা ও সংগ্রামের ইতিহাসে অনেক মনীষী ও মুক্তিযোদ্ধার অবদান জড়িত থাকে। তবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর অবদান অপরিসীম ও চির স্মরণীয়। তিনি মূলত তাঁর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জাতির কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করেছেন। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের প্রতি বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ও দৃঢ় পদক্ষেপ, বিভিন্ন সময় কারাভোগ, রাজনৈতিক দল গঠন ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন, ছয় দফার ঘোষণা (১৯৬৬), ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন, ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা, ঐতিহাসিক ৭ মার্চ-এর ভাষণ, এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তিনি চির স্মরণীয় হয়ে আছেন। এছাড়াও মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীসভা, এ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ, মুক্তিযুদ্ধের সামরিক প্রশাসন, বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের কূটনৈতিক উদ্যোগ, বিশ্বের মুক্তিকামী দেশের সমর্থন, ত্রিশ লাখ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ, দুই লাখের বেশি মা-বোনদের আত্মত্যাগ ও সম্ভ্রমহানি, সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া)-এর ইতিবাচক পদক্ষেপ ইত্যাদি বিষয় ও ব্যক্তিবর্গ মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপক অবদান রেখেছে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর ৯১,৬৩৪ (একানব্বই হাজার ছয়শত চৌত্রিশ) জন সৈন্য আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।

স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। আমাদের স্বাধীনতা রক্ষা ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। মানবিক সমাজ গঠনই পারে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে। এ বছর আমরা মহান বিজয়ের ৪৮ বছর অতিক্রম করছি। জাতি হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির পার্থক্য দূর করতে হবে। সবার জন্য কল্যাণকর ও টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। তবে এ কার্যক্রম শুধু কোনো নির্দিষ্ট দিনকে আবর্তিত না করে সব সময় পালন করার মাধ্যমেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমাদের অকৃত্রিম ভালবাসা ও শ্রদ্ধার প্রকাশ ঘটবে।

১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল তারিখে মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করা উচিত। যেখানে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করা যাবে। সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান ও আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী- সংবিধানের এ অনুচ্ছেদের ব্যত্যয় যেখানে হবে না। মহান বিজয় দিবসে স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের সেই লক্ষ্যে কাজ ও কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা উচিত। জাতীয় মূল্যবোধের বিকাশের মাধ্যমে আমাদের আরও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। জাতীয় অগ্রগতি ও কল্যাণ সাধনে সবাইকে সদা জাগ্রত থাকতে হবে। তাহলেই মহান বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা অর্জন পরিপূর্ণতা লাভ করবে।

মো. হাবিবুর রহমান: লেখক, গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী

এ সম্পর্কিত আরও খবর