ফিরে দেখা অপারেশন জ্যাকপট: দাউদকান্দি ফেরিঘাট আক্রমণ

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

বাশার খান, জ্যেষ্ঠ গবেষক, পিআইবি | 2023-09-01 09:28:51

অপারেশন জ্যাকপট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের টার্নিং পয়েন্ট। এই অপারেশনের আওতায় অতি অল্পসময়ে বিভিন্ন অভিযানের মাধ্যমে বাঙালি নৌ-কমান্ডো মুক্তিযোদ্ধারা তাদের শক্তিশালী প্রতিরোধের কথা বিশ্বকে জানান দেয়। ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট পরিচালিত মুক্তিযোদ্ধাদের নৌ-কমান্ডো দলের এই অভিযান ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামে পরিচিত। এদিন রাতে নৌ-কমান্ডোরা একযোগে মংলা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ বন্দর আক্রমণ করে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর ২৬টি পণ্য ও সমরাস্ত্রবাহী জাহাজ ও গানবোট ডুবিয়ে দেয়। পরদিন রাতে আক্রমণ করা হয় কুমিল্লার দাউদকান্দি ফেরিঘাটে। সেখানে ফেরি, বাজ ও পন্টুন ডুবিয়ে দেয় নৌ-কমান্ডোরা।

১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে ১৪৮ জন নৌ-কমান্ডোকে চারটি দলে ভাগ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হয়। তার আগে তাদেরকে পলাশীতে ৩ মাসব্যাপী কঠোর প্রশিক্ষণে অত্যন্ত দক্ষ করে গড়ে তোলা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য ৬০ জন কমান্ডো গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী (বীরউত্তম)। তবে চট্টগ্রামে নৌ-কমান্ডো অপারেশন পরিচালিত হয় ওই অঞ্চলের সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে। ১৫ আগস্ট রাত ১২টায় অপারেশন জ্যাকপট অভিযান শুরু হয়। কমান্ডোরা সতর্কতার সাথে জাহাজে মাইন সংযোজন করে ফেরত আসেন। কিছু মাইন নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বিস্ফোরিত হয়। ১৫ আগস্ট রাত ১- ১.৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম বন্দর প্রকম্পিত হয়। বন্দরে ‘এম.ভি হরমুজ’ এবং ‘এম.ভি আল-আব্বাস’ নামে দুটি পাকিস্তানি জাহাজসহ বেশ কয়েকটি বার্জ ও জাহাজ ধ্বংস হয়। এম.ভি হরমুজে ৯৯১০ টন এবং এম.ভি আল-আব্বাসে ১০,৪১৮ টন সমর সরঞ্জাম ছিল। সাবমেরিনার আহসানউল্লাহ’র (বীরপ্রতীক) নেতৃত্বে ৪৮ জন নৌ-কমান্ডো মংলা বন্দরে অভিযান করেন। বন্দরের ৬টি জাহাজ মাইনের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়। চাঁদপুর নদীবন্দর অভিযানে সাবমেরিনার বদিউল আলমের (বীরউত্তম) নেতৃত্বে ২০ জন নৌ-কমান্ডো সফল অপারেশন চালান। তাঁরা ১৫ আগস্ট রাতে একই সময়ে চাঁদপুর বন্দরে মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কয়েকটি জাহাজ ধ্বংস করেন। সাবমেরিনার আবদুর রহমান (বীরবিক্রম) ও শাহজাহান সিদ্দিকের (বীরবিক্রম) নেতৃত্বে কমান্ডো দল যথাক্রমে নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর ও দাউদকান্দি ফেরিঘাটে সফল অভিযান পরিচালনা করেন।

এই অপারেশনের ফল ছিল সুদূর প্রসারী। বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে পাকিস্তানিদের এমন প্রচার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এরপর থেকে কোনো বিদেশি জাহাজ তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে আসতে রাজি হয়নি।

দাউদকান্দি ফেরিঘাটের গুরুত্ব ও অপারেশন

সামরিক দিক বিবেচনায় দাউদকান্দি ফেরিঘাট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আনা শত্রুপক্ষের যুদ্ধের সরাঞ্জমাদি, গোলাবারুদ, অস্ত্র ও রসদ ঢাকাসহ সারা দেশে যেত এই ফেরিঘাট হয়ে। এ জন্য এই ফেরিঘাটটি ধ্বংস করা জরুরি হয়ে পড়ে। ভারতীয় নৌ-বাহিনীর লেফটেন্যান্ট দাস দাউদকান্দি ফেরিঘাটের গুরুত্ব সম্পর্কে ঐ অপারেশনের নেতৃত্বদানকারী শাহজাহান সিদ্দিকী বীর বিক্রমকে ৭১’র আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে কোনো এক সময় ডেকে বলেন, ‘সামরিক দিক থেকে দাউদকান্দি ফেরিঘাট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই ফেরিঘাটের মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তানের রাজধানীর ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের যোগাযোগ রক্ষা করাসহ চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আনীত অস্ত্র ও গোলাবারুদ পারাপার করা হয়। তাই পাকিস্তানি আর্মির গুরুত্বপূর্ণ এই যোগাযোগ স্থল দাউদকান্দি ফেরিঘাটটি অচল করে দেওয়া সামরিক দিকে থেকে অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।’

ভারতীয় নৌ-বাহিনীর লেফটেন্যান্ট দাস নৌ-কমান্ডোর প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা শাহজাহান সিদ্দিকী (পরে বীর বিক্রম) কে প্রধান করে ৯ সদস্যের একটি কমান্ডো দল গঠন করেন। দলটিকে পাঠিয়ে দেন দাউদকান্দি ফেরিঘাটের ৭/৮ মাইল দূরে নদীর পাড়ে অবস্থিত গ্রাম বন্দরামপুরে।

নৌ-কমান্ডো দলের দাউদকান্দির উদ্দেশে রওয়ানা

শাহজাহান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ৯ সদস্যের কমান্ডো দলকে দাউদকান্দি ফেরিঘাট আক্রমণের জন্য ১১ আগস্ট বাংলাদেশে পাঠানো হয়। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শাহজাহান সিদ্দিকী বলেন, ‘সেদিন সন্ধ্যার পর আমি আমার কমান্ডো গ্রুপকে নিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বকসনগর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের প্রবেশ করি। চাঁদপুর গ্রুপটিও আমার সাথেই বাংলাদেশে প্রবেশ করে। চাঁদপুর গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন সাবমেরিনের আমিন উল্লাহ, বীরবিক্রম (পরে নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট)। আমাদেরকে ২জন করে গাইড দেওয়া হয়। প্রত্যেক গ্রুপের জন্যই ২ জন করে গাইড ছিল। চাঁদনী রাতের আকাশ। তাই পথ চলতে কোনো অসুবিধা হয়নি। পথঘাট ভালই দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার সঙ্গে থাকা অস্ত্রের মধ্যে ছিল ১টি ম্যাগজিন ও পর্যাপ্ত গুলিসহ ১টি অটোমেটিক মেশিনগান। প্রত্যেক কমান্ডোর জন্য একজোড়া সাঁতার কাটার ফিনস, ১টি লিমপেড মাইন ও কমান্ডো নাইফ।

সে রাতে আমরা কখনো ধান খেতের আইল, আবার কখনো মেঠো পথ হয়ে এগুতে থাকি। কিছুদূর যাবার পর চাঁদপুর গ্রুপ আলাদা হয়ে চাঁদপুরের দিকে যায়। আমরা যাই দাউদকান্দির দিকে। এরপর যাই ময়নামতির উত্তরে অবস্থিত কংশনগর বাজারের দিকে। এই বাজারের পূর্ব দিক দিয়ে গোমতী নদী প্রবাহিত। গোমতীর পূর্ব পাড়ে উঁচু বেড়িবাঁধ। ভোর নাগাদ আমরা বেড়িবাঁধ হেঁটে নদীর পূর্বপাড়ের নৌকাঘাটে যাই। ২ জন ২জন করে নৌকা পার হই। এরপর কুমিল্লা বি-বাড়িয়া- সিলেট সড়ক পার হয়ে পশ্চিম দিকের একটি গ্রামে ঢুকি। এই সড়কে পাকি সেনাবাহিনীর সদস্যদের টহল থাকত- এজন্যই সড়কটি খুব সাবধানে পার হই। এরপর গাইডের সহযোগিতায় গ্রামটির দক্ষিণ পাশ দিয়ে গিয়ে সবাই আবার একত্রিত হই। হাঁটি আরও ২ মাইল। এখানে একটি ঘাটে বড় একটি নৌকা আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ ছিল। নৌকাটি আমাদেরকে নিয়ে কখনো বর্ষার ধানখেত আবার কখনো খালের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে। মাঝিরা জানায়, বর্ষার পানি থাকায় এ এলাকায় পাকি সেনাবাহিনীর তেমন কোনো আনাগোনা নাই। এমনি করেই দাউদকান্দির গৌরীপুর বাজারের ৩ মাইল উত্তরে অবস্থিত আমাদের জন্য পূর্ব নির্ধারিত বন্দরামপুর গ্রামের পীর শাহ কামালের বাড়িতে পৌঁছি। বন্দরামপুর গ্রামে আমাদের নিরাপদ অবস্থানের ব্যবস্থা করেন তখনকার ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দার। ওখানে পৌঁছানোর পর লম্বা কোর্তা পরা পীর শাহ কামাল আমাদেরকে স্নেহভরে অভ্যর্থনা জানান।

রেকি

তৎকালীন দাউদকান্দির (বর্তমান তিতাস উপজেলা) বন্দরামপুর গ্রামের পীর শাহ কামালের বাড়িতে গোপন আশ্রয় নেন শাহজাহান সিদ্দিকীর বীরবিক্রমের নেতৃত্বে নয় সদস্যের কমান্ডো দল। সেখান থেকে ১৪ আগস্ট সকালে শাহজাহান সিদ্দিকী ও এই অভিযানের ডেপুটি কমান্ডার মতিউর রহমান বীর উত্তম নৌকায় করে দাউদকান্দি ফেরিঘাটের কাছাকাছি যান অপারেশনস্থল রেকি করতে। শাহজাহান সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি ও মতি লুঙ্গি ও হাফ শার্ট পরে ভাড়া করা একটি ছইওয়ালা নৌকায় ১৪ আগস্ট সকাল আনুমানিক নয়টার দিকে দাউদকান্দি ফেরিঘাটের উদ্দেশে রওনা হই। আমাদের সঙ্গে চটের ব্যাগে ফোল্ডিং করে লুকিয়ে রাখা স্টেনগানটি ছাড়া অন্য কোনো অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। দাউদকান্দি ফেরিঘাটের উত্তর-পশ্চিমে মেঘনা নদী, আর দক্ষিণে গোমতী নদী। তখন ফেরিঘাটের উত্তর-পশ্চিম দিকে মেঘনা নদীর মাঝখানে একটি ছোট্ট চর ছিল। চর থেকে ফেরিঘাটের সবকিছু দেখা যেত। চরের পাশে কিছুক্ষণের জন্য নৌকা রেখে আমরা লক্ষ করলাম যে ফেরিঘাটের পন্টুন থেকে একটু দূরে পশ্চিম দিকে নদীতে দুটি ভাসমান ফেরি নোঙর করা অবস্থায় আছে। এ দুটি ফেরি আর পন্টুনই হলো আমাদের টার্গেট। অপারেশন এলাকা ও টার্গেট ঠিক করার সময় আমাদের নৌকাটি চলছিল। একপর্যায়ে নৌকার গতি কমিয়ে আমি একটি গামছা পরে নদীতে নেমে পড়ি। ভাবটা এমন যে- যেন নদীর পানিতে গোসল করতে নেমেছি। নামার উদ্দেশ্য নদীর পানির স্রোতের বেগ ও গতিধারা সম্পর্কে বাস্তব ধারণা লাভ। তখন বর্ষাকাল ছিল। ফেরিঘাটটি মেঘনা ও গোমতী নদীর সঙ্গমস্থলে। আরও লক্ষ করলাম বর্ষাকালের ভরা নদীতে স্রোত তেমন নেই। উজানে এবং ভাটিতে সহজেই সাঁতার কেটে যাওয়া যায়। তবে নদীর তীরবর্তী ফসলের জমিতেও অথই পানি থাকায় কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা নেই।’

শাহজাহান সিদ্দিকী, বীর বিক্রম ও মতিউর রহমান, বীরউত্তম সেখানে গোসল করার ভান করে রেকি করায় দূরে পাকিস্তানি ফেরিতে পাহারারত সৈন্যরা সন্দেহ করেনি সেদিন। সফলভাবেই রেকি করে দুজন ফিরে যান বন্দরামপুর গ্রামে।

গানের মাধ্যমে অতি গোপন নির্দেশনা এবং অপারেশনের প্রথম অভিযানের প্রতিবন্ধকতা

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ধাপে ধাপে প্রচারিত কয়েকটি গানের মাধ্যমে নৌ-কমান্ডোদের আক্রমণের সাংকেতিক নির্দেশনা দেয়া হয়। গানের মাধ্যমে নির্দেশনার বিষয়টি অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে করা হয়। নৌ-কমান্ডোদের টিম লিডার ছাড়া কৌশলগত কারণে এ বিষয়টি অন্য কাউকে জানানো হয়নি। অপারেশন জ্যাকপটের আওতায় গানে গানে সিগনাল দেয়ার বিষয়ে শাহজাহান সিদ্দিকী বীরবিক্রম জানান, ‘বাঙালি মাত্রই গান ভালোবাসেন। এর বাণী হৃদয়কে করে পুলকিত ও বিকশিত। আবার এ গানই যে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিতে পারে বা রণাঙ্গনে হামলার সিগন্যাল হতে পারে, সে কথা কি কেউ ভেবেছে কোনো দিন? বিস্ময়কর ব্যাপার হলেও সত্যি যে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে দুটি গান শত্রু পাকিস্তান বাহিনীর ওপর হামলা পরিচালনার সংকেত বা সিগন্যাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। ... ১৩ আগস্ট, ১৯৭১ আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে কাঙ্ক্ষিত সেই গানটি প্রচারিত হয়। আমার অন্য সঙ্গী কমান্ডোরাও আমার সঙ্গে ট্রানজিস্টারে গান শুনছিল। এ গানের মর্মার্থ তারা না বুঝলেও আমি বুঝে গেলাম। ৪৮ ঘণ্টা পর আমাদের অপারেশনে যেতে হবে। গানটি শুনে আমি কিছুটা আবেগতাড়িত হয়ে পড়ি। নিজেকে সামলে নেই দ্রুতই। অপারেশনের প্রাথমিক সিগন্যাল পেয়ে গেছি, এটা কাউকেই বুঝতে দিইনি। ১৪ আগস্ট সন্ধ্যার পর আকাশবাণীর নিয়মিত অনুষ্ঠানে হঠাৎ ‘আমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুরবাড়ি, ও রে! তোরা সব উলুধ্বনি কর’ গানটি শুনতে পেলাম। তার অর্থ তখন থেকে ঠিক ২৪ ঘণ্টা পর টার্গেটে আঘাত হানতে হবে। আমি মনে মনে হিসাব করে দেখলাম, ১৫ আগস্ট দিবাগত রাতে অর্থাৎ ১৫-১৬ আগস্ট মধ্যবর্তী রাত আমাদের জন্য জিরো আওয়ার। ওই সময় এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে আমাদের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে হবে। সেই রাতে সঙ্গী কমান্ডোদের কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ থাকলাম। ১৫ আগস্ট সকালে সবাইকে ডেকে বললাম, আজ রাতেই আমাদের অপারেশনে যেতে হবে। সন্ধ্যার পর খাওয়া-দাওয়া করে, গায়ে সরিষার তেল মেখে, সুইমিং কস্টিউমসহ যার যার লিমপেট মাইন ও ফিন্স নিয়ে একটি খোলা নৌকাযোগে অপারেশনে বের হয়ে পড়লাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পথিমধ্যে প্রচণ্ড ঝড়-তুফানে পড়ে আমরা রাস্তা হারিয়ে ফেলি। তার ওপর গাইড ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে শীতে কাঁপতে থাকে। অসুস্থ বোধ করায় সে আমাদের সঙ্গে যেতে অপারগতা প্রকাশ করে। আমরা তাকে কোনোমতেই যেতে রাজি করাতে পারছিলাম না। গাইড আবুল কাশেম প্রচণ্ড শীতে কাঁপতে কাঁপতে নেমে যেতে চাইল। আমরা তো নৌ-কমান্ডো। প্রশিক্ষণে ৩ মাস পানিতেই ছিলাম। ঝড়-বৃষ্টিতে আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি। গাইড আবুল কাশেম অসুস্থ হয়ে পড়ায় নৌকা থেকে নেমে যেতে চাচ্ছে। কিন্তু সামরিক কৌশল অনুযায়ী তো তাকে নামানো যাবেই না। তাহলে আমাদের বিপদ হবে। আমরা মাইনসহ ধরা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চারদিক জানাজানি হয়ে যাবে। এটা অত্যন্ত গোপনীয় অপারেশন ছিল।

এই অপারেশনের কথা বাঙালিদের মধ্যে শুধু অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, জেনারেল ওসমানী ও বিমানবাহিনীর এ কে খন্দকার সাহেব জানতেন। এর বাইরে কেউ জানত না। কাশেমকে ছাড়া যাচ্ছিল না যে আমাদের আরও টিম একই সময়ে চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মংলায় গেছে। একটা ধরা পড়লে স্বাভাবিক কারণে অন্য কমান্ডো দলগুলোও ধরা পড়ে যাবে। তো কমান্ডার হিসেবে আমার কাছে একটাই পথ খোলা আছে- যে গাইড কাশেমকে আমাদের কমান্ডো নাইফ দিয়ে হত্যা করে ফেলে অপারেশনে যাওয়া। যদিও আমার সাথে ফল্ডিং করা স্টেনগান ছিল। সেটা দিয়ে গুলি করলে তো শব্দ হবে। এমন করতে করতে রাত অনেক গড়িয়ে গেছে। পূবাকাশে সুবেহ সাদেক উঁকি দিচ্ছে মনে হচ্ছে। আমার সঙ্গে থাকা ডেপুটি কমান্ডো লিডার মতি ওরফে মতিউর রহমান বলল, স্যার, আজকে অপারেশন না করলেই ভাল হয়। মতি কিন্তু দাউদকান্দিরই লোক। অত্যন্ত সাহসী ছিল সে। সে বেবি টেক্সির ড্রাইভার থেকে নৌ-কমান্ডো হয়। তাঁর পরামর্শ বিস্তারিত বিবেচনা করে সেদিন অপারেশন করা থেকে আমরা বিরত থাকি।

ফাইনাল অপারেশন

পরদিন ১৬ আগস্ট দিবাগত রাত ১টার দিকে দাউদকান্দি ফেরিঘাটে আক্রমণ করেন শাহজাহান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কমান্ডো দল। মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ডুবিয়ে দেন ঘাটে থাকা দুটি ফেরি এবং একমাত্র পন্টুন। এতে, ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে চট্টগ্রামসহ দেশের পূর্ব-দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থান করা হানাদার বাহিনী। সেদিনের স্মৃতিচারণে শাহজাহান সিদ্দিকী বলেন, ‘পরদিন রাতে আমরা দুটি নৌকা করে বের হই। বড় নৌকাটি দূরে রেখে ছোটো আরেকটি নৌকায় এগিয়ে আসি। ফেরিঘাটের কাছাকাছি সুবিধাজনক জায়গায় এসে ৩জন ৩জন করে পানিতে নামি। ফেরিতে থাকা হানাদার বাহিনীর পাহারাদাররা যখন টর্চ ঘুরাতো- আমরা তখন পানিতে নিঃশব্দে ডুব দিতাম। নদীতে স্রোত ও ঢেউ ছিল। গার্ডরা বুঝতেই পারেনি যে পানিতে ডুবে কেউ আসছে।

আরেকটি বিষয় যে, আমাদের সাঁতার তো সাধারণ মানুষের মত না। নৌ-কমান্ডোদের সাঁতার হাতে নয়- পায়ে। হাত দুটো থাকবে ফ্রি। শুধু নাকটি পানির উপর থাকবে। এখন টেলিভিশনে দেখানো হয়- ডুবুরীরা এক ধরণের লম্বা জুতার মত পরে পানিতে নামে। পায়ে যে পরে- ওটাকে বলে ফিনস। ওটা পায়ে দিলে স্বাভাবিক সাঁতারের চেয়ে ৩ গুন বেশি স্পিডে সাঁতরানো যায়। ব্যাকস্ট্রোকে সাঁতার কাটতাম। অর্থাৎ উল্টা পিছনের দিকে সাঁতার। পলাশীতে আমাদের কঠোর প্রশিক্ষণ হওয়ায় ৭/৮ কিলোমিটার এভাবে সাঁতার কাটা আামাদের জন্য কোনো ব্যাপারই ছিল না। সেই অপারেশনে ব্যবহৃত আমার ফিনস দুটো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দিয়ে দিয়েছি।

সে রাতে প্রচুর স্রোত ছিল। প্রায়ই কচুরিপানা ভেসে যাচ্ছিল। তো আমরা নাকটা জাগিয়ে কচুরিপানা মাথায় দিয়ে ভেসে যাওয়ার মতই যাচ্ছিলাম। রাতের অন্ধকারে শত্রু পাহারদাররা বুঝতেই পারেনি যে- কচুরিপানার নিচে মানুষ আছে। এমনি করে টার্গেট পয়েন্টে পৌঁছে যাই। ২০ গজ দূরত্বে এসে ডুব সাঁতার দিয়ে ফেরির কাছে আসি। যেন পাহারাদার বুঝতে না পারে। পানির নিচে ফেরির বডিতে যখন আমরা চলে আসি- তখন আমরা নিরাপদ। ফেরির উপরের লোকজন আমাদের আর দেখছিল না। স্বাভাবিক কারণেই তাদের দৃষ্টি ছিল খানিক দূরে।

এরপর শুরু হল মাইন ফিট করার কাজ। ফেরি বা জাহাজের লোহার বডিতে মাইন সহজে ফিট করার জন্য মাইনের উপর চুম্বক ছিল। কিন্তু সমস্যা ছিল যে, ফেরি দীর্ঘদিন পানিতে থাকায় নিচে শেওলার আস্তরণ জমে ছিল। শেওলা পরিষ্কারের জন্য আগে থেকেই আমাদের কমান্ডো নাইফ দিয়ে দেওয়া হয়। লম্বা করে শ্বাস নিয়ে ডুব দিয়ে আমরা শেওলা পরিষ্কার করতে থাকি। কয়েকবারে শেওলা পরিষ্কার সম্পন্ন হয়। পাঁচ কেজি ওজনের লিম্পপেড মাইন তো বুকের সঙ্গে বাধা। ডুব দিয়ে গিয়ে খুব সতর্কতার সাথে মাইন ফিট করি। মাইন ফিট করতে গিয়ে শব্দ না করার কৌশল আমাদের আগেই রপ্ত ছিল। মাইনের ভিতরে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক। এর উপর ফুটবল পাম্প করে যে- এরকম একটা জিনিস থাকে। এখানে একটা ডেটোনেটর। তারপর একটা স্ট্রাইকার। স্ট্রাইকারটা ভিতরে ডেটোনেটরকে আঘাত করলেই বিস্ফোরিত হয়। পানিতে এটা কি করে সম্ভব ? স্ট্রাইকারের উপরে পরিমাণ মতো কেমিকেল সল্ট ছিল। এটা পানিতে আস্তে আস্তে গলতে থাকে। অনেকটা মোম গলার মত। উপরে একটা রাউন্ড ক্যাপ লাগানো।

কমান্ডোদের জন্য নির্দেশ হচ্ছে- মাইন লাগিয়ে ক্যাপটা খুলে এনে আমাকে দিবা। যাতে বুঝতে পারি যে- মাইন ঠিকমত লাগানো হয়েছে। তো ক্যামিকেল সল্টটা গলে গিয়ে একটা স্পিরিং গিয়ে ডেটোনেটরকে আঘাত করে। তখন মাইন বিস্ফোরিত হয়। মোমের মত কেমিকেলটা গলতে ৪০-৪৫ মিনিট লাগে। এরপর মাইন বিস্ফোরিত হয়। এই সিস্টেমটা এ জন্য যে- কমান্ডোরা মাইন ফিট করে যাতে নির্ধারিত নিরাপদ জায়গায় যেতে পারে। যুদ্ধের নিয়ম হচ্ছে- নিজেদের হতাহতের সংখ্যা যথাসম্ভব কমিয়ে যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া। তুমি শত্রুকে ধ্বংস করবা এবং নিজেও বাঁচার চেষ্টা করবা- এটাই কৌশল। এ জন্যই এই ক্যামিকেল। তো দাউদকান্দির ব্যাপারটা ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। অন্যান্য নৌ-কমান্ডোরা ছিল সরাসরি নৌবাহিনীর লোক। তারা পাকিস্তান নৌজাহাজ ফ্রান্স থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। আমি একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলাম- বেসামরিক নৌ-কমান্ডো।

অপারেশন জ্যাকপটের এক অকুতোভয় সৈনিক শাহজাহান সিদ্দিকী, বীর প্রতীক  

আমাদেরকে বলা হয়েছিল- অপারেশনে নামবা। মাইন ফিট করে স্রোতে অনুকূলে ভাটির দিকে গিয়ে আশ্রয় নিবা। দাউকান্দিতে এসে আমাকে স্পট সিদ্ধান্ত নিতে হয়। স্রোতের অনুকূলে দক্ষিণ দিকে তো দাউদকান্দি ফেরিঘাট। সেখানে পাকবাহিনী থাকতে পারে। তারপর এতো রাতে একই বয়সের ৮ যুবক সুইমিং কসটিউম পরে হেঁটে যাবো। সুইমিং কস্টিউম পরা কমান্ডোকে উলঙ্গের মতই দেখায়। আমাদেরকে উলঙ্গ দেখে স্থানীয় লোকজন বুঝে বা না বুঝে হইচই করতে পারে। তাতে তো আমরা ধরা পড়ে যেতে পারি। এ জন্য আমি সিদ্ধান্ত নেই- স্রোতের উল্টা দিক- অর্থাৎ চরের দিকেই আমরা আশ্রয়ে যাবো। এটাকে সামরিক ভাষায় রেসকিউ পয়েন্ট বলে। আমরা সে রাতে মাইন ফিট করে উল্টো সাঁতার কেটে রেসকিউ পয়েন্টে যাই। এর ৬/৭ মিনিট পর ৯টি মাইন এক এক করে বিস্ফোরিত হতে থাকে। পুরো দাউদকান্দি কেঁপে উঠে। লোকজন জেগে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে। পাকিস্তান বাহিনী তখন সমানে মেশিন দিয়ে গুলি করতে থাকে। গুলি করে দক্ষিণ ও পশ্চিম দিককে টার্গেট করে। তারা মনে করেছে- কেউ পশ্চিম বা দক্ষিণ দিক থেকে এসে আক্রমণ করেছে। উত্তর দিকে তো নদী আর চর। কেউ নেই। তারা এদিকে গুলি করেনি। ঐদিকে ওরা সমানে গুলি ছুঁড়ছে। মর্টারের গোলা মারছে। নদীর পানি ছেঁড়াবেড়া করে ফেলতেছে।

আমাদের চোখে তৃপ্তি আর আনন্দের হাসি। যুদ্ধে জয়ের আনন্দে বলতে থাকি, মার শালারা মার। আমরা পার হয়ে গেছি। ধরতে পারবি না। মাঝিরা নৌকা বাইতেছিল। আমরা ৮ জন নৌকার তক্তা তুলে দিয়ে বৈঠা বাইতে থাকি। খুব দ্রুতই নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে যেতে থাকি। দ্রুতই আরও দুই কিলোমিটার দূরে চলে গেলাম। আমরা যেহেতু যোদ্ধা- তাই জানি কতটুকু দূরে গেলে সম্পূর্ণ নিরাপদ হওয়া যায়। তো আমরা সে জায়গায় গিয়ে আল্লাহর শুকরিয়া জানাই। তখন কি যে শান্তি-আনন্দ লাগছিল- বুঝাতে পারবো না। পাকবাহিনী বুঝতেই পারল না- কোন দিকে দিয়ে তাদেরকে আক্রমণ করা হয়েছে। এরপর দেখতে পেলাম যে, ঢাক-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে আর্মির জিপ, লড়ি হেড লাইট জ্বালিয়ে দাউদকান্দি ঘাটের দিকে আসছে। তাদের ধারণা হয়েছে- মুক্তিরা ফেরিঘাট আক্রমণ করেছে। সমানে সৈন্য যাচ্ছে। এরা মনে করেছে ঘাটে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আর এদিকে আমরা যুদ্ধ শেষ করে দিয়ে আসছি। ওরা যাচ্ছে যুদ্ধ করতে। তাদের তৎপরতা দেখে হাসছিলাম আমরা।’

দাউদকান্দি ফেরিঘাটে সফল অপারেশন করে পরদিনই শাহজাহান সিদ্দিকী ও তাঁর দল ভারতে ফিরে যান। বেবিট্যাক্সি চালক মতিউর রহমান এরপর অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে নারায়ণগঞ্জে কয়েকটি নৌ অপারেশনে অংশ নেন। দেশ স্বাধীন হলে নৌ-যুদ্ধে দুঃসাহসিক অবদানের জন্য মতিউর রহমানকে বীর উত্তম এবং শাহজাহান সিদ্দিকীকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করা হয়।

 

বাশার খান : জ্যেষ্ঠ গবেষক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)

তথ্যসূত্র:

১। সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত, বাংলাপিডিয়া, খ--১, ভুক্তি- অপারেশন জ্যাকপট, ঢাকা, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০১১।

২। মো. আল আমিন ও বাশার খান, মুক্তিযুদ্ধে দাউদকান্দি, ঢাকা, দ্যু প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি ২০১৯।

৩। শাহজাহান সিদ্দিকী বীর বিক্রমের সাক্ষাৎকার, গ্রহণ: ৭ অক্টোবর ২০১৫।

এ সম্পর্কিত আরও খবর