মিয়ানমারের অপরাধ, গাম্বিয়ার মামলা ও আমাদের করণীয়

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স | 2023-09-01 19:04:18

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) মামলা করেছে গাম্বিয়া। ওআইসি’র পক্ষে গাম্বিয়া এ মামলাটি করে। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ এগিয়ে আসেনি। মুসলিম দেশের সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি মুসলিম দেশকেই মামলা করতে হলো। অন্য কোনো অমুসলিম দেশ এখন পর্যন্ত এগিয়ে আসেনি। বিশ্বব্যাপী নানা ঘটনা সভ্যতার সংঘাতের পক্ষেই সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু তারপরও রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়টিকে আমরা একটি জনগোষ্ঠীর ওপর একটি রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের নির্যাতন হিসেবেই দেখছি মিয়ানমারের ভাষায় যা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।

এখানে একটি প্রশ্ন অনেকের মনেই এসেছে তা হলো বাংলাদেশ কেন মামলাটি করলো না। সংক্ষুব্ধ দেশ হিসেবে বাংলাদেশও মামলাটি করতে পারতো এতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ শুধু সংক্ষুব্ধ পার্টিই না, মিয়ানমারতো রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি বলেই দাবি করে আসছে। আর নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে তো তারা বাংলাদেশেই পালিয়ে এসেছে। সেদিক দিয়েতো সরাসরি সংক্ষুব্ধ পার্টি বাংলাদেশই।

বাংলাদেশ অবশ্য মামলা না করাকে তাদের কৌশল হিসেবেই দেখছে। মামলা করলে হয়তো দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার পথ রুদ্ধ হয়ে যেতো, তাই বাংলাদেশ মামলা করেনি।

মামলা করলে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার পথ রুদ্ধ হতো এটি নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে, বাংলাদেশ নিজে মামলা না করার ফলেও এ মামলার মেরিট ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এখানে বিবেচ্য হলো মামলার বিষয়বস্তু, পক্ষদ্বয়ের ভূমিকা ও আদালতে তাদের এখতিয়ার, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন ও বিচার করার জন্য আদালতের এখতিয়ার। এ বিষয়গুলো প্রমাণ করতে পারলে মামলা কে করলো সেটি বড় বিষয় নয়। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র যারা আন্তর্জাতিক আদালতের স্টাটুট সাক্ষর করেছে তাদের যে কেউ মামলা করতে পারে। মিয়ানমার অবশ্য আইসিজেতে বলেই যাচ্ছে যে বাংলাদেশতো মামলা করেনি। কিন্তু মিয়ানমারের এ যুক্তি বাংলাদেশের নিঃস্পৃহতা প্রমাণ করলেও মিয়ানমারের অপরাধ লঘু করে না।

আরেকটি প্রশ্ন হলো, না হয় বাংলাদেশ মামলা করলো না, কিন্তু এখনওতো গাম্বিয়ার সঙ্গে মামলায় পক্ষভুক্ত হওয়া যায়। এখানে দেখতে হবে পক্ষভুক্ত হলে কোনো বিশেষ ফায়দা আছে কি না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে পক্ষভুক্ত হয়ে কোনো লাভ নেই, কোনো প্রয়োজনও নেই। তবে এখনও শুধু বাংলাদেশ নয়, অন্য যেকোনো দেশই চাইলে মামলার পক্ষভুক্ত হতে পারে। বাংলাদেশ এখন পক্ষভুক্ত হলে আইনগত কোনো বিশেষ ফায়দা না থাকলেও সরাসরি সংক্ষুব্ধ পক্ষ হিসেবে পক্ষ হলে একটি কৌশলগত ফায়দাতো আছেই। অন্তত সু চিতো একথা বলতে পারবে না যে বাংলাদেশকে তো দেখছি না। গাম্বিয়া একটি মুসলিম দেশ। ওআইসির পক্ষ থেকেই তারা মামলাটি করেছে। মুসলিম প্রধান নয় এ রকম কোনো একটি রাষ্ট্র যদি এখন এর পক্ষভুক্ত হতো তবে সেটি আমাদের জন্য ভালো হবে। এ বিষয়টি সার্বজনীনতা পেতো। এবং সেটি মিয়ানমারের ওপর একটি কার্যকর চাপ প্রয়োগ করতে সক্ষম হতো। সে সুযোগ এখনও আছে। বাংলাদেশ অন্তত অন্য কোনো একটি বন্ধুরাষ্ট্র না হোক শুভাকাঙ্ক্ষী রাষ্ট্রকে অন্তত এ মামলার পক্ষ হতে অনুরোধ করতে ও কূটনীতি চালাতে পারে।

আন্তর্জাতিক গণহত্যা কনভেনশন লঙ্ঘনের অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়া মামলা করেছে। অর্থাৎ মিয়ানমার গণহত্যা ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপরাধ করেছে। কাজেই আন্তর্জাতিক গণহত্যা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী যে কোনো রাষ্ট্রই মামলা করতে পারে, পক্ষভুক্ত হতে পারে। তবে নতুন করে পক্ষভুক্ত রাষ্ট্রগুলো কেবল কনভেনশনের আইনি ব্যাখ্যা নিয়েই কথা বলতে পারে। তাদের এখতিয়ার হচ্ছে ‘কোয়েশ্চন অব ল’ নিয়ে কথা বলা ‘কোয়েশ্চন অব ফ্যাক্ট’ নিয়ে নয়। ফ্যাক্ট নিয়ে কথা বলবে মিয়ানমার। কাজেই বাংলাদেশকে লক্ষ্য রাখতে হবে ওই মামলার যে কোনো পর্যায়েই আইনের ব্যাখ্যার কোনো ব্যত্যয় ঘটছে কিনা যা বাংলাদেশের পক্ষে না যায় বা মিয়ানমারের পক্ষে যায়। সে জন্য অতীতের বিভিন্ন মামলার রেফারেন্স নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। পুরো একটি এক্সপার্ট টিম যেনো এ বিষয়ে সার্বক্ষণিক কাজ করে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলার মতো অতীতে আরো অন্তত দুটি মামলা আদালতের কাছে রেফারেন্স হিসেবে বিবেচিত হতে পারে-বসনিয়া বনাম সার্বিয়া ও ক্রোয়েশিয়া বনাম সার্বিয়া। ‍দুটি মামলাই আন্তর্জাতিক গণহত্যা কনভেনশন লঙ্ঘনের অভিযোগে দায়েরকৃত। গণহত্যা মামলার মূল সমস্যা হয় এর অভিপ্রায় প্রমাণ করা। কারণ অপরাধী রাষ্ট্র বলার চেষ্টা করে যে যদি নৃশংসতা হয়েও থাকে তবে তা অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার জন্য বা সন্ত্রাসের জবাবে সংঘটিত নৃশংসতা। মিয়ানমার ইতোমধ্যে আদালতে একথা বলেছে। কাজেই গাম্বিয়াকে মিয়ানমারে সংঘটিত নৃশংসতার তথ্যচিত্র ও বাস্তবতা ব্যাপকভাবে তুলে ধরতে হবে। মিয়ানমার প্রথম থেকে রাখাইন রাজ্যে নৃশংসতার চিহ্ন মুছে ফেলায় তৎপর ছিল। তারা সেখানে অপরাধের চিহ্ন মুছে দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। তারপরও যে প্রমাণ পাওয়া যাবে তা তুলে ধরতে গাম্বিয়াকে সহায়তা করতে হবে বাংলাদেশকে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কাছে প্রাপ্য তথ্যও তুলে ধরার ক্ষেত্রে গাম্বিয়াকে সহায়তা করতে হবে। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারেরই নাগরিক সেই ঐতিহাসিক তথ্যও তুলে ধরতে হবে আদালতে।

গাম্বিয়ার মামলাটি নিষ্পত্তি হতে যথেষ্ট সময় লাগবে। অন্তত তিন বছরের আগে এর ফায়সালা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ আদালত গাম্বিয়ার প্রাথমিক বক্তব্য শুনেছে। গাম্বিয়া কিছু অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপের জন্য আদালতের কাছে আবেদন করেছে। আদালত এখন ওই পদক্ষেপগুলোর ব্যাপারে তার সিদ্ধান্ত নেবে। এটি নিতে আদালতের সময় লাগবে। সেই সাথে গাম্বিয়ার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ খণ্ডনের জন্য মিয়ানমারকে যথেষ্ট সময় দেয়া হবে। সাধারণত বছর খানেক সময় দেয়া হয়। এর মধ্যে মিয়ানমার যদি আদালতের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন করে তবে সে প্রশ্নের সুরাহা করতে আদালত আরও সময় নেবে। মিয়ানমারের জবাবের পাল্টা জবাব দেয়ার জন্যও গাম্বিয়াকে সময় দেয়া হবে। এর পর প্রকাশ্য আদালতে শুনানির পর আদালত বিভিন্ন বিষয়ে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করবে। এর পর মামলার রায় লিখতে আদালত সময় নেবে। ফলে অন্তত তিন চার বছরের আগে এর সুরাহা হচ্ছে না।

কিন্তু সময় যা-ই লাগুক, এ মামলা বাংলাদেশের জন্য অন্তত গুরুত্বপূর্ণ। নিজে মামলা না করার এক ধরনের অজুহাত দাঁড় করিয়েছি যে এতে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার কোনো নমুনা আজও দৃশ্যমান না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা কার্যকর করতে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপতে অনেক পরে কথা, বিশ্ব মোড়লদের কারো কাছ থেকে মিয়ানমারকে একটা ধমকও খাওয়াতে পারলাম না। যাই হোক, এখন গাম্বিয়ার এ মামলাটি হয়তো আমাদের জন্য একটি শেষ সুযোগ। আদালতের রায় কার্যকর করানোটা একটি চ্যালেঞ্জ। কিন্তু অন্তত মিয়ানমারের অপরাধ প্রমাণ করতে পারলে সেটিও অনেক বড় প্রাপ্তি। নোবেল কন্যার নৃশংসতা প্রমাণ করতে পারলে, মিয়ানমারের গণহত্যা ও সংশ্লিষ্ট অপরাধ প্রমাণ করতে পারলে তখন হয়তো মিয়ানমার সমঝোতার পথে নমনীয় হতে পারে। তাই গাম্বিয়াকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হবে। নিজে পক্ষভুক্ত না হলেও অন্য কেউ যাতে পক্ষভুক্ত হয় সে চেষ্টাও করতে হবে। আদালতের প্রতিটি পদক্ষেপের দিকে নজর রাখতে হবে ও সেখানে নিজেদের যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর