বড়দিনের শিক্ষা ও সতর্কতা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ,অ্যাসোসিয়েট এডিটর,বার্তা২৪.কম | 2023-08-28 16:11:50

২৫ ডিসেম্বর খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান ধর্মীয় উৎসব বড়দিন বা ক্রিসমাস। বিশ্বের সকল দেশের মতো বাংলাদেশেও দিনটি পালিত হবে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও উৎসবমুখরতায়।

খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিস্ট বা হযরত ঈসা (আ.) নবীর জন্মোৎসব উপলক্ষে পালিত বড়দিনের আবেদন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে অপরিসীম। কয়েকদিন আগে থেকেই শুরু হয় 'ক্রিসমাস ঈভ' বা বড়দিন আয়োজনের উদ্যোগ। উপহার বিতরণ, ক্রিসমাস ট্রি সাজানো, আলোকসজ্জা, গির্জায় প্রার্থনা, পারিবারিক ও সামাজিক পুনর্মিলন, পানাহার ইত্যাদিতে মুখরিত হয় খ্রিস্টান জনপদ ও জনজীবন। বুড়ো সান্তাক্লজ আসেন ঝোলা ভর্তি চকলেট, কেক, খাবার নিয়ে। শিশুদের মধ্যে স্বর্গীয় ভালোবাসায় বিলানো হয় এসব সামগ্রী।

ক্রিসমাসের উৎসবে প্রেম, ত্যাগ ও ক্ষমার প্রতিমূর্তি যিশুর অম্লান বাণীসমূহ পুনরুচ্চারিত হয় মানুষের নৈতিক জীবনকে আলোকিত করার প্রত্যয়ে। হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, স্বার্থপরতার অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আহ্বান করা হয় মানুষকে। অবক্ষয়ে আকীর্ণ মানবতার মুক্তির জন্য ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় সেই চিরায়ত উক্তি, 'লেট দেয়ার বি লাইট'।

ক্রিসমাসের এই মহৎ ধর্মতাত্ত্বিক দিকের শিক্ষায় আনন্দ-উৎসবমুখরতায় বড়দিন পালনের সময় কয়েকটি বিষয়ে সতর্ক থাকার দরকার পড়ে। বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় এই সতর্কতা আগেভাগে নেওয়া ভালো।

প্রথম সতর্কতা নিরাপত্তা প্রসঙ্গে। প্রায়ই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাদের উৎসবের সময় বা অন্য সময় আক্রান্ত হয়, যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও নিন্দার যোগ্য। বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিস্টানদের উপাসনালয়, বসত-ভিটা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। বরং প্রশাসনিক ও সামাজিক প্রতিরোধের মাধ্যমে এসব অপকর্ম ও সাম্প্রদায়িক হিংসা প্রতিরোধ করাই কর্তব্য।

আসছে বড়দিনে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম ইত্যাদি বড় বড় শহর ছাড়াও প্রত্যন্ত এলাকার খ্রিস্টানপল্লীতে আয়োজিত হবে নানা অনুষ্ঠান। ঢাকার দক্ষিণে কলাকোপা-বান্দুরা, উত্তরে নাগরী, বরিশাল, দিনাজপুর, চট্টগ্রামের দেয়াং ইত্যাদি পুরনো খ্রিস্টান জনপদে বড়দিন পালিত হবে বিস্তারিত অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে।

বাংলাদেশের সমতলে বসবাসকারী আদিবাসী গারো, হাজং, সাঁওতাল এবং পাহাড়ে বসবাসকারী চাক, বোম, খুমিদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার, সেসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যেও ব্যাপক আয়োজনের মাধ্যমে পালিত হবে বড়দিন।

দেশের প্রত্যন্তে বসবাসকারী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার সমস্যা এমনিতেই প্রকট। উৎসবের সময় তা আরও বৃদ্ধি পায়। ফলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পূর্ণ সতর্কতা ও সজাগ মনোভাব বজায় রাখতে হবে, যাতে নাগরিকরা নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে বসবাস এবং ধর্ম ও উৎসব পালন করতে পারেন।

শুধু প্রশাসনই নয়, সমাজের অপরাপর সম্প্রদায়কেও ঐক্যবদ্ধভাবে সহনাগরিকদের কল্যাণ ও নিরাপত্তা বিধানে এগিয়ে আসতে হবে। সবাই মিলে সুখে-শান্তিতে বসবাসের যে সম্প্রীতির ঐতিহ্য বাংলাদেশের রয়েছে, তাকে যে কোনো মূল্যে সমুন্নত রাখতে হবে।

কোনও হীন ও স্বার্থান্ধ গোষ্ঠীর দ্বারা সামাজিক, নাগরিক ও ধর্মীয় শান্তি বিনষ্ট করা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার অপচেষ্টা রুখতে হবে। শান্তি, সম্প্রীতি ও সহযোগিতার মাধ্যমে সবাই মিলে থাকার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

আরেকটি বিষয়েও সতর্ক হতে হবে। তা হলো উৎসবের নামে সীমালঙ্ঘন ও তাণ্ডব না চালানো। একবার বড়দিনে কলকাতায় তেমন পরিস্থিতি চাক্ষুষ করে যথেষ্ট আতঙ্কিত হতে হয়েছিল। বড়দিনের রাতে কলকাতার মধ্যস্থলে অবস্থিত নগর-প্রাণকেন্দ্রের পার্ক-স্ট্রিট, চৌরঙ্গী, এসপ্ল্যানেড ইত্যাদি সংযুক্ত এলাকায় তরুণ-তরুণীদের হুল্লোড়ের কারণে জননিরাপত্তা চরমভাবে নস্যাৎ হতে দেখেছি। গাড়ি তো দুরস্ত, আশেপাশের হোটেল ও আবাসিক এলাকার বাসিন্দাদের চলাচল বন্ধ হয়ে প্রায়-বন্দি অবস্থার সৃষ্টি হয়। নাচ, গান, শব্দসন্ত্রাস, মদ্যপানের বল্গাহীন মচ্ছবে উৎসবের নান্দনিক দিকের অপমৃত্যু হয়ে সৃষ্টি হয়েছিল চরম বিভীষিকা।

অধুনা রাজধানী ঢাকার অভিজাত গুলশান, বনানী এলাকায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার খবর পাওয়া যায়। বিশেষত বড়দিন এবং ৩১ ডিসেম্বর রাতে ইংরেজি নববর্ষ বরণের নামে সীমাহীন হৈচৈ ও উন্মত্ততা প্রদর্শন করা হয়। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা বিধান করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে হিমশিম খেতে হয়। পরের দিন রাস্তা উপচানো মদের বোতল, কোক, বিয়ারের ক্যান পরিষ্কার করতে গলদঘর্ম হতে নগরের পরিচ্ছন্নতা বিধায়ক সংস্থার কর্মীবাহিনীকে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এহেন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ধর্মের মতাদর্শিক কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এসব বেলেল্লাপনা ধর্মের সুকুমার দিকটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের যে ভাবগাম্ভীর্য, পবিত্রতা ও শুচিশুভ্রতা, তা এই অবিবেচকদের হঠকারিতায় কলুষিত হয়। এ ব্যাপারেও সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

অতএব, বড়দিনের মানবিক ও নৈতিক শিক্ষাকে সমুন্নত করার মাধ্যমে মৈত্রী ও কল্যাণের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে এবং নিরাপত্তাহীনতা ও সীমা লঙ্ঘনের বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

 ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম, প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। 

এ সম্পর্কিত আরও খবর