কৌতুক, দুই আইনের খসড়া এবং নতুন বছর

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

শুভ কিবরিয়া | 2023-08-26 12:58:55

নতুন খ্রিস্টীয় বছর উদযাপন তো শেষ। তবুও আছে তার রেশ। ভাবছি নতুন বছরের নতুন দিনগুলোতে কি নিয়ে লেখা যায়? মুরব্বিরা বলেন, যাত্রা শুরুর সময় নেতিবাচক কথা বলতে হয় না। তাই ঠিক করলাম লেখাটা শুরু করি কতগুলো কৌতুক দিয়ে। হাল আমলে তো কৌতুক খুব একটা তৈরি হয় না! তাই পুরনো আমলের কৌতুকেই ভরসা। সোভিয়েত আমলের কম্যুনিস্ট শাসন নিয়ে কতগুলো কৌতুক চোখে পড়ল। বোঝা যায়, কৌতুকগুলো পশ্চিমা মনন দ্বারা তৈরি। সোভিয়েত কম্যুনিস্ট শাসনকে কর্তৃত্বপরায়ণ আর একনায়কি শাসন দেখানোর মানস নিয়েই এসব কৌতুকের সৃষ্টি।

কৌতুক-১:

একজন ইহুদিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে কেজিবি অফিসে।
-আমাদের কাছে খবর এসেছে, আপনি হিব্রু ভাষা শিখছেন। তার মানে ইসরাইল যাবার প্ল্যান আছে আপনার?
- মোটেও না। আমি ধর্মগ্রন্থে পড়েছি, স্বর্গে হিব্রু ভাষায় কথা বলতে হবে। তাই হিব্রু শিখে রাখছি।
- মৃত্যুর পরে আপনি স্বর্গে যাবেন, এ ধারণা আপনার হলো কোথা থেকে?
- তা নিশ্চিত করে বলতে পারি না ঠিকই, তবে নরকে যদি যেতেই হয়, তার জন্য তো রুশ ভাষা শেখাই আছে।

কৌতুক-২:

রাজনৈতিক সমাবেশে দেশের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের বিবরণ দিচ্ছেন এক ডাকসাইটে মন্ত্রী। বলছেন, ‘ক’ শহরে কদিন আগেই ইলেকট্রিক স্টেশন খোলা হয়েছে।
সমাবেশে উপস্থিত শ্রোতাদের একজন চিৎকার করে বললেন, আমি আজই ওই শহর থেকে এসেছি। কোনো ইলেকট্রিক স্টেশন নেই সেখানে।
মন্ত্রী তবুও বক্তৃতা চালিয়ে যেতে লাগলেন। বললেন, ‘খ’ শহরে একটি রাসায়নিক কারখানা স্থাপন করা হয়েছে।
শ্রোতাদের মধ্যে একজন দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন, বাজে কথা। আমি গতকালই ছিলাম ওই শহরে। ওখানে কোনো কারখানাই নেই।
মন্ত্রী এবার থামলেন। দম নিয়ে বললেন-
-প্রিয় কমরেডরা, শহরে শহরে অত না ঘুরে আপনাদের উচিত নিয়মিত পত্রিকা পড়া, টেলিভিশন দেখা। তাহলে দেশের উন্নতি সম্পর্কে আপনাদের সম্যক ধারণা হবে।

কৌতুক-৩:

নিউজ স্টলে এক লোক প্রতিদিন প্রাভদার প্রথম পৃষ্ঠা দেখে রেখে দেয়।
কৌতুহল দমন করতে না পেরে বিক্রেতা একদিন জিজ্ঞেস করে বসলেন:
- প্রতিদিন আপনি কী খোঁজেন প্রথম পৃষ্ঠায়?
- মৃত্যু সংবাদ।
- কিন্তু মৃত্যু সংবাদ তো শেষ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়।
- আমি যার মৃত্যুর অপেক্ষায় আছি, তার মৃত্যু সংবাদ ছাপা হবে প্রথম পৃষ্ঠায়।

০২.

কৌতুক ছেড়ে এবার বাস্তবে আসি। গত বছর পেঁয়াজের দাম ছিল আকাশ ছোঁয়া। এখন পেঁয়াজের ভরা মৌসুম। এখনও দেশি পেঁয়াজের কেজি শ’য়ের নিচে আসেনি। ভরা মৌসুমেও এবার সবজির দাম মাত্রা ছাড়া। ভোজ্য তেলসহ সব পণ্যের দাম বেড়েছেই কেবল। গত বছরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর শুনানি হয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ার অপেক্ষা মাত্র। যে কোনো সময় সেই সংবাদ আসবে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের আইন অনুসারে, আগে বছরে একবারের বেশি বিদ্যুৎ বা গ্যাস বা অন্য কোনো জ্বালানির দাম বাড়ানোর শুনানি করা যেত না। এবার সেই আইন বদলানোর সব আয়োজন প্রায় শেষ। এখন বছরে একাধিকবার পরিবর্তন করা যাবে বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম।

মিডিয়ার বরাতে জানা যাচ্ছে, বছরে শুধু একবার নয়, একাধিকবার বিদ্যুৎ-জ্বালানির দামে পরিবর্তন (কমানো বা বাড়ানো) আনতে পারবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এ বিধান রেখেই মন্ত্রিসভা ‘বিইআরসি (সংশোধন) আইন, ২০১৯’ এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে।

গত ৩০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এ অনুমোদন দেয়া হয়।

বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আগের আইনটি ছিল ২০০৩ সালের। তাতে যে প্রভিশন ছিল, সেটাতে কমিশনের নির্ধারিত ট্যারিফ কোনো অর্থবছরে একবারের বেশি পরিবর্তন করা যাবে না, যদি না জ্বালানি মূল্যের পরিবর্তনসহ অন্য কোনো পরিবর্তন ঘটে। সংশোধিত আইনে এটাকে পরিবর্তন করে করা হয়েছে, কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত ট্যারিফ কোনো অর্থবছরে কমিশনের একক বা পৃথক পৃথক আদেশ দ্বারা, প্রয়োজন অনুসারে এক বা একাধিকবার পরিবর্তন করা যাবে।

তাহলে বোঝাই যাচ্ছে ২০২০ আমজনতার জন্য কি নিদারুন সংবাদ নিয়ে আসছে!

০৩.

ব্যাংক খাতের সুশাসন নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। খেলাপি ঋণের সংখ্যা ও পরিমাণ বাড়ছে। বলা হচ্ছে অর্থ ও নীতি দু’টোই আছে সংকটের মধ্যে। চলতি অর্থ বছরে যে সময় আমরা পার করে এসেছি, সেই সময়ে রাজস্ব আয় হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার অনেক কম। বৈদেশিক উৎসে রপ্তানি কমতির দিকে। অন্যদিকে সরকার ব্যাংক থেকে বিপুল ঋণ নিচ্ছে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক থেকে সরকারের ধার করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। অথচ ছয় মাস না পেরুতেই সরকার ধার নিয়েছে ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। সরকার সেখানেই ক্ষান্ত থাকেনি। দেশের নানা প্রতিষ্ঠানে যে টাকা জমা আছে তা সরকারি কোষাগারে নেবার জন্য নতুন আইন অনেকটাই চূড়ান্ত করেছে।

প্রস্তাবিত আইনটির নাম ‘স্বায়ত্তশাসিত, আধা–স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইন্যান্সিয়াল করপোরেশনসহ স্ব-শাসিত সংস্থাগুলোর তহবিলের উদ্বৃত্ত টাকা সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান আইন, ২০১৯’।

সংবাদ মাধ্যম খবর দিচ্ছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের খসড়া তৈরি, মন্ত্রিসভার অনুমোদন, আইন মন্ত্রণালয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা (ভেটিং) ও রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের অনুমোদন শেষ। অর্থ মন্ত্রণালয় এখন বিল আকারে তা জাতীয় সংসদে পাঠাবে। সংসদ অনুমোদন দিলে আইনটি হয়ে যাবে।

গত ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ মন্ত্রিসভা এ আইনের খসড়া অনুমোদন করেছে। এ জন্য সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, আইনটি প্রণয়ন করা হলে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ ও সুদ পরিশোধ ব্যয় কমবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, গত জুন ২০১৯ পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্থার সাতটি খাতের ২ লাখ ১৮ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা ব্যাংকে জমা পড়ে আছে। এর মধ্যে সরকারি অ-আর্থিক যেমন বিপিসি, পেট্রোবাংলা, পানি উন্নয়ন বোর্ড-এ ধরনের ৭১টি সংস্থার জমা আছে ১ লাখ ৩৩ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। ১২৮টি স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার জমা আছে ৪১ হাজার ৫২৯ কোটি টাকা। আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, খাদ্য অধিদপ্তর, সঞ্চয় অধিদপ্তর ইত্যাদি ৫১টি সরকারি দপ্তরের জমা আছে ২৪ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি ২১ হাজার ৬১১ কোটি টাকা জমা আছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি)।

এভাবে আইন করে সংস্থার তহবিলের অংশ সরকারি কোষাগারে নেওয়া নানা উদ্বেগের জন্ম দিতে পারে। এ আইন কার্যকর হলে ব্যাংক খাতে সংকট বাড়তে পারে। অর্থ বিভাগ যেসব সংস্থার টাকা নেওয়ার পরিকল্পনা করছে, সেগুলোর মধ্যে কিছু লিমিটেড কোম্পানিও রয়েছে। অনেক সংস্থার টাকা কিছু দুর্বল ব্যাংকে আছে। ফলে এভাবে সরকারি কোষাগারে টাকা টান দিলে কিছু ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। আইনটি পাস হলে ব্যাংক খাত থেকে টাকা চলে যাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। ফলে ব্যাংক খাতের তারল্যসংকট বাড়বে। স্থানীয় সরকার বিশেষ করে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ইত্যাদি দপ্তরের ক্ষেত্রে আইনটি প্রয়োগ করতে গেলে সাংবিধানিক জটিলতাও দেখা দিতে পারে। এটা গোটা আর্থিক খাতকেই আরও অস্থির করে তুলতে পারে। ব্যাংক খাত তারল্যসংকটে ভুগলে তার প্রভাব পড়বে পুঁজিবাজারে। বলা বাহুল্য আমাদের পুঁজিবাজার এমনিতেই নাজুক অবস্থা কাটাতে পারেনি।

০৪.

বোঝা যাচ্ছে সম্ভাব্য নতুন দুই আইন আমাদের অর্থনীতিকে ভোগাবে। নতুন বছরে আমজনতার ওপর অর্থনৈতিক চাপ আরও বাড়তে পারে। বাজারের চলমান আগুন তাতে কমবে বই বাড়বে না!!

শুভ কিবরিয়া: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর