মুখোমুখি ইরান-যুক্তরাষ্ট্র

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ফরিদুল আলম | 2023-08-31 14:30:39

দুই দেশের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ে ২০১৮ সালের ৮ মে, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরান এবং ৬ জাতির মধ্যকার ২০১৫ সালে সম্পাদিত পরমাণু চুক্তি থেকে এককভাবে সরে আসে। এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসার পেছনে সঠিক যুক্তি না থাকায় চুক্তি স্বাক্ষরকারী অপরাপর দেশগুলো (চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও জার্মানি) যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে এবং এর ফলে মধ্যপ্রাচ্য সংকট আরও ঘনীভূত হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করে। চুক্তি থেকে সরে আসার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর থেকে উঠিয়ে নেয়া অবরোধ নতুন করে আরোপ করে। ফলে ইরানও এই চুক্তির আওতা থেকে নিজেকে সরিয়ে আনার ঘোষণা দেয়।

দেড় বছরের বেশি সময় ধরে দুই দেশের মধ্যে চলতে থাকা অস্থিরতার কঠিনতম পর্যায় আসে গত ৩ ডিসেম্বর। মার্কিন গোয়েন্দা দফতর পেন্টাগন ঘোষণা দেয় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশে ইরানের রেভ্যুলেশনারী গার্ডের আল কুদস ফোর্সের কমান্ডার কাসিম সোলাইমানীকে তারা হত্যা করেছে। এই হত্যার পেছনে পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের তরফে জানানো হয় যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত ইরানের রেভ্যুলেশনারী গার্ডের আল কুদস ফোর্স পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে মার্কিন স্বার্থের পরিপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে মদদ দিয়ে আসছিল এবং একই সাথে মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘকালীন অস্থিরতা রোধকল্পে এটি একটি জুতসই পদক্ষেপ।

এদিকে জেনারেল কাসিম সোলাইমানী হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে স্বাভাবিকভাবেই অস্থির হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্য। শিয়াপন্থী এই জেনারেলের মৃত্যুতে সিয়া সংগঠনগুলোর পাশাপাশি ইরাকের শিয়াবিরোধিরাও সামিল হয়েছে এই প্রতিবাদে। গত ৪ জানুয়ারি বাগদাদে জেনারেল সোলাইমানীর জানাজায় শরীক হয়েছে সর্বস্তরের হাজারো মুসল্লি। সেখানে ছিলেন ইরাকের প্রধানমন্ত্রী আদেল আবদেল মাহদি। ইরাকের সরকার এবং সাধারণ মানুষ এই হত্যাকাণ্ডকে দেখছে ইরাকের সার্বভৌমত্বের ওপর মার্কিনীদের নতুন হস্তক্ষেপ হিসেবে।

কেবল মধ্যপ্রাচ্যে নয়, খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণেতারাও এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছেন। কংগ্রেসে সংখ্যাগরিষ্ঠ ডেমোক্র্যাটিকরা কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে এধরনের সিদ্ধান্তে ট্রাম্পকে যুদ্ধ ঠেকানোর পরিবর্তে নতুন করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণ সৃষ্টির দায়ে অভিযুক্ত করছেন। একই সাথে রিপাবলিকানরা সরাসরি সমালোচনা না করলেও আশংকা করছেন যে এর ফলে ইরানের তরফ থেকে যে প্রতি উত্তর আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে সেটা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য ভাল হবে না। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর কথা থেকে বোঝা যাচ্ছে তারাও এই মুহূর্তে এটা নিয়ে বেশ চিন্তিত। বিশেষ করে তারা সোলাইমানী হত্যাকাণ্ড নিয়ে তাদের ইউরোপীয় মিত্রদের যেভাবে পাশে পাবেন বলে ধারণা করেছিলেন সেভাবে না পেয়ে হতাশ হয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য এবং জার্মানি এই মর্মে তাদের আশংকা ব্যক্ত করেছে যে মধ্যপ্রাচ্য অস্থিরতার এক নতুন মাত্রা যুক্ত হতে যাচ্ছে এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে।

আসলে এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কি বার্তা দিতে চেয়েছিল সেটা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। গেল বছর দেড়েকের বেশি সময় ধরে দুই দেশের মধ্যে অস্থির সম্পর্কের দায় কার কতটুকু এটা নিয়ে এখন নতুন করে প্রশ্ন উঠবে সঙ্গত কারণেই। আর সব প্রশ্নকে ছাপিয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা আসবে যেখানে ইরানের সাথে সম্পাদিত চুক্তি থেকে অপর ৫টি দেশ সরে আসার কোনো প্রয়োজন মনে করেনি তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একতরফাভাবে সেখান থেকে সরে আসার মধ্য দিয়েই সংকটের আজকের এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হল।

একই সাথে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে জেনারেল কাসিম সোলাইমানীকে হত্যার কারণ সৃষ্টি করল সেটা কি যথার্থ কি না এবং এর ফলে ইরান, এর সহযোগী এবং কাসিম সোলাইমানী কর্তৃক সৃষ্ট মধ্যপ্রাচ্যের চারপাশে তার মতাবলম্বীদের কর্তৃক সম্ভাব্য প্রতিহিংসামূলক তৎপরতা দমনে যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে কতটুকু সক্ষম সেটা এখন নতুন ভাবনার বিষয়।

আগেই বলা হয়েছে এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্র এবং চীন এবং রাশিয়া এটিকে দেখছে নেতিবাচক একটি পদক্ষেপ হিসেবে। ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তি থেকে সরে আসার পর যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক অবরোধ আরোপের মাধ্যমে ইরানকে পর্যুদস্ত করার যে ছক এঁটেছিল, সেখানে তাদের সবচেয়ে বড় বাঁধা ছিলেন জেনারেল সোলাইমানী। বলা হয়ে থাকে যে তিনি বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী একজন জেনারেল এবং ইরানের বর্তমান সামরিক কৌশলের তিনিই মূল প্রবক্তা।

এসব কিছু মাথায় নিয়ে গত বছরের ৮ এপ্রিল ইরানের রেভ্যুলেশনারী গার্ডকে কালো তালিকাভুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র। একই বছরের ৫ মে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন উপসাগরীয় অঞ্চলে ইরানের তৎপরতা রোধকল্পে মার্কিন বিমানবাহী রণতরী পাঠানোর ঘোষণা দেন। চুক্তি থেকে প্রত্যাহারের ঠিক একবছর পর ৮ মে নতুন করে ইরানের খনি এবং ইস্পাতের ওপর অবরোধ আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এর ৪ দিনের মাথায় উপসাগরীয় এলাকায় ১২ মে তিনটি তেলবাহী ট্যাংকারসহ ৪টি জাহাজের ওপর আক্রমণ হলে যুক্তরাষ্ট্র এর জন্য ইরানকে দায়ী করে। ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় এলাকায় আরও ১ হাজার ৫শ মার্কিন সেনা পাঠানোর ঘোষণা দেয়। ১৩ জুন নরওয়ে এবং জাপানের দুটি ট্যাংকার হামলার শিকার হলে যুক্তরাষ্ট্র আবারও ইরানকে এর জন্য দায়ী করে। ২০ জুন ইরানের রেভ্যুলেশনারী গার্ড দাবী করে হরমুজ প্রণালীর কাছে ইরানের আকাশসীমা লঙ্ঘনের দায়ে তারা একটি মার্কিন ড্রোনকে ভূপাতিত করে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই ঘটনায় প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও পরে সরে আসেন। ২৪ জুন ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেন যে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি এবং শীর্ষ সেনাদের বিরুদ্ধে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

পরবর্তীতে ১৮ জুলাই হরমুজ প্রণালীর কাছে মার্কিন নৌবাহিনীর বেসের কাছে তারা একটি ইরানী ড্রোনকে ভূপাতিত করে। এর আগে ইরান জানায় যে তারা চুক্তি না মেনে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচী চালিয়ে যাবে। ১৪ সেপ্টেম্বর সৌদি আরব কর্তৃক ইরান সমর্থিত ইয়েমেনের হুতিদের ওপর হামলার প্রতিশোধ হিসেবে সৌদি আরবের দুটি তেল শোধনাগারে হামলা চালানো হয়।

গত ২৭ ডিসেম্বর ইরাকে একটি রকেট হামলায় একজন মার্কিন ঠিকাদার নিহত হওয়ার জেরে ২৯ ডিসেম্বর ইরানপন্থী একটি গ্রুপের ওপর মার্কিন বিমান হামলায় ২৫ জন নিহত হয়। এর প্রতিবাদে ৩১ ডিসেম্বর ইরানপন্থী একটি গ্রুপ বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসের সামনে বিস্ফোরণ ঘটালে যুক্তরাষ্ট্র এর সমুচিত জবাব দেয়ার ঘোষণা দেয়। আর এর ফলেই ঘটে কাসিম সোলাইমানী হত্যাকাণ্ড।

এইসব ঘটনাক্রমে থেকে খুব সহজেই অনুমান করা যায় যে সামনের দিনগুলোতে ইরানের তরফ থেকে নিশ্চিতভাবেই এর জবাব আসবে এবং যুক্তরাষ্ট্র সম্ভাব্য কী ধরনের জবাব আসে সেটা অনুমান করে নিজেও তার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করে রেখেছে। ইতোমধ্যে সোলাইমানীর মৃত্যুর পরদিন বাগদাদে মার্কিন দূতাবাস এবং বিমানঘাঁটির অদূরে হামলা পরিচালিত হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন তারা যদি আবারও মার্কিন লক্ষবস্তুতে হামলার চেষ্টা করে তবে ইরানের ৫২টি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা পরিচালনার লক্ষ্য রয়েছে তাদের। সবকিছু মিলে আরও মুখোমুখি এখন ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্র।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর