চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য সুচিকিৎসা

, যুক্তিতর্ক

মো. জাকির হোসেন | 2023-08-28 10:16:51

আমাদের সমাজে যেসব মানুষ আর প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থার পারদ ক্রমাগতই নিম্নগামী তার মধ্যে ডাক্তার, হাসপাতাল, ক্লিনিক অন্যতম। মৃত্যু অমোঘ, চিরন্তন। সৃষ্টিকর্তা নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন, “প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।” মৃত্যুর হাত থেকে চিকিৎসক কেন, কেউই বাঁচাতে পারবেন না। চিকিৎসক শুধু রোগ নিরাময় আর রোগীকে রোগের উপশম দেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। রোগীর পরিবার-স্বজনেরা তা স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করছেন। কিন্তু চিকিৎসারত অবস্থায় কিছু মৃত্যু, রোগী বা স্বজনের প্রতি ডাক্তার ও চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট লোকজনের আচরণ, রোগীর প্রতি অবহেলা, প্রাণঘাতী ভুল চিকিৎসা স্বজন ও সাধারণ মানুষকে ব্যথিত, মর্মাহত, ক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী করে তোলে। অনেক সময় রোগীদের প্রতি ভুল চিকিৎসা ও অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ল্যাবরেটরি ভাঙচুরের ঘটনাসহ ডাক্তার, নার্স এবং কর্মচারীদের ওপর আক্রমণের ঘটনাও ঘটছে।

অন্যদিকে ভাংচুরের প্রতিবাদে কিংবা ভুল বা অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে রোগীর স্বজনেরা চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা করলে চিকিৎসকগণ দলবদ্ধভাবে লাগাতার কর্মবিরতি বা ধর্মঘটের ডাক দিচ্ছেন। চিকিৎসকের অবহেলা বা ভুল চিকিৎসায় ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হয়ে ক্লিনিকে ভাংচুর চালানো, ডাক্তার, নার্স এবং কর্মচারীদের ওপর আক্রমণ কিছুতেই সমর্থনযোগ্য নয়। বরং এটি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। আদৌ অবহেলা বা ভুল চিকিৎসা হয়েছে কিনা, তা হাসপাতালের বাইরে অপেক্ষমাণ আত্মীয়স্বজন বুঝে না-বুঝে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ভাংচুর চালাতে শুরু করবেন, এটা খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত। তেমনি চিকিৎসকের ভুল বা অবহেলার শিকার হয়ে মুত্যুবরণকারী কিংবা অপূরণীয় ক্ষতির শিকার রোগীর শোকার্ত স্বজন আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন না—এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

আইনের শাসনের ক্ষেত্রে একটি প্রতিষ্ঠিত নীতি হলো ‘Nobody is above law and God’। চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে বাংলাদেশের ডাক্তারদের অবস্থান হলো চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে যথেষ্ট ধারণা না থাকলে তাঁর এ বিষয়ে মত বা রায় দেওয়ার এখতিয়ার নেই। বিএমএ বিভিন্ন সময়ে দাবি করে আসছে, কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে আগে চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি বিষয়টির তদন্ত করবে। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মিললে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।’ এ সংক্রান্ত আইন করতেও সরকারের কাছে দাবি করে আসছেন তাঁরা। ভারতের সুপ্রিমকোর্ট ২০০৯ সালে এ বিষয়ে একটি রায়ে বলেন, কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ তোলা হলে, তার প্রাথমিক সত্যতা ছাড়া ওই চিকিৎসককে গ্রেফতার করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে প্রথমে কোনো যোগ্য বিশেষজ্ঞ বা বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মতামত নিতে হবে। এরপরই শুধু সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে নোটিস জারি করা যাবে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতে চিকিৎসা পেশা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের আওতাভুক্ত। তাই আদালত রায়ে উল্লেখ করেন, চিকিৎসা পেশাকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করায় অত্যন্ত তুচ্ছ ঘটনায়ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই তদন্ত প্রক্রিয়ায় যারা শেষ পর্যন্ত দোষী সাব্যস্ত হবেন না, তারা যেন অযথা হয়রানির শিকার না হন, তা নিশ্চিত করা দরকার বলে আদালত মত প্রকাশ করেন। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক করে বলা হয়, আনীত অভিযোগ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসকদের যেন গ্রেফতার বা হয়রানি না করা হয়, অন্যথায় তাদেরও আইনগত ব্যবস্থা মোকাবিলা করতে হবে।

ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের ওই রায়ে আরো উল্লেখ করা হয়, প্রকৃত অর্থে যেসব চিকিৎসক চিকিৎসায় অবহেলার সঙ্গে জড়িত, তাদের প্রতি আদালতের কোনো সহানুভূতি নেই। প্রাথমিক সত্যতা ছাড়া অবহেলা বা ভুল চিকিৎসাজনিত কারণে চিকিৎসককে গ্রেফতার করা উচিত নয় আমিও এ মতকে সমর্থন করি। চিকিৎসকবৃন্দের এ দাবিটি সর্বাবস্থায় আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়।

আইনে একটি বিধান আছে যাকে বলে রেস ইপসা লকুইটার অর্থাৎ ‘ঘটনা নিজেই কথা বলে’। এ জন্য সমর্থনযোগ্য প্রমাণের দরকার হয় না। উদাহরণস্বরূপ, ছাদের ওপর ইট রেখে কেউ নির্মাণ কাজ করছে। হঠাৎ ছাদ থেকে একটি ইট একজন পথচারীর ওপর পড়ে সে আহত বা নিহত হলো। এ ক্ষেত্রে বাড়ির মালিক দায়ী হবেন। তিনি সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন কিনা কিংবা তার অবহেলা ছিল কিনা তা প্রমাণের প্রয়োজন নেই। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমাদের চিকিৎসকগণ আইনের এ প্রতিষ্ঠিত বিধানকেও মানতে নারাজ।

হার্নিয়ার অপারেশনের পরে রোগীর পেটে গজ-ব্যান্ডেজ রেখে দেওয়ার অভিযোগে মামলা দায়েরের কারণে খেপে গেলেন চিকিৎসকেরা। তাঁরা প্রাইভেট চিকিৎসা ও চেম্বার বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়ে দিলেন। এটি কত বড় অন্যায্য ব্যাপার চিকিৎসকেরা চিন্তা করে দেখেছেন কি কখনো? কুমিল্লায় একজন প্রসূতির প্রসবব্যথা উঠলে গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর একটি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই দিনই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার একটি মেয়ে জন্ম হয়। তখন তার স্বজনরা ডাক্তারকে রোগীর পেটে যমজ বাচ্চা আছে জানালে ডাক্তার স্বজনদের জানান, খাদিজার পেটে বাচ্চা একটিই। অন্যটি টিউমার। ৪ দিন ভর্তি রাখার পর তাকে ক্লিনিক থেকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। ক্লিনিক থেকে রোগীকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। এর কয়েক দিন পর থেকে তার আবার সমস্যা দেখা দেয়। ১৫ দিন পর আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তারা জানতে পারেন তার পেটে আরেকটি বাচ্চা আছে। এরপর ২২ অক্টোবর রাত ৮টায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৫ অক্টোবর সকালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার পেট থেকে একটি মৃত ছেলে বের করা হয়। যমজ সন্তানের একটি বের করার পর আরেকটিকে ভেতরে রেখেই নারীর পেট সেলাই করে দেওয়ার মতো অমানবিক ঘটনার বিচারে কেন তদন্ত কমিটি গঠন না করে মামলা করা যাবে না?

চুয়াডাঙ্গা ইম্প্যাক্ট মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারে চক্ষু শিবিরে চিকিৎসা নিতে আসা চোখ হারানো ২০ জনের ক্ষতিপূরণের রুল শুনানিতে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ যথার্থই বলেছেন, ‘বিপদে পড়লে মানুষ তিনজনের কাছে যায়। পুলিশ, আইনজীবী ও ডাক্তার। এই তিনটা পেশা যদি ধ্বংস হয় তাহলে মানুষ কোথায় যাবে? ডাক্তার দেব-দেবী নন। আমাদের ভুল হবে সেটা স্বাভাবিক। আমাদের ভুল হলে উচ্চ আদালত আছে। ভুলটা অন্যায় নয়। কিন্তু ভুলটা জাস্টিফায়েড করার জন্য হরতাল ডাকা হলে সেটা অন্যায়।’

ডাক্তারি একটি মহান পেশা। এই পেশাটি কতিপয় দুর্বৃত্তের কাছে বন্দি হওয়া কাম্য নয়। দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর পাবলিক পারসেপশন ভালো না এবং ডাক্তারদের ব্যবহারও ভালো না। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। আমাদেরও ভুল হয়। আমাদের ভুলের বিচারের জন্য সর্বোচ্চ আদালত আছে। কিন্তু ডাক্তাররা ভুল করলে এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে তার প্রতিবাদ হিসেবে হরতাল ডাকা অনৈতিক। ’আদালত আরো বলেছেন, ‘দেশে অনেক স্বনামধন্য চিকিৎসক এবং ভালো মানের চিকিৎসা সেবার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কতিপয় ভুল চিকিৎসার ভয়ে রোগীরা পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যাচ্ছে। এতে দেশীয় মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে।’

ভারতের বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিদেশিদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে দেশটি যে ৮৮ কোটি ৯৩ লাখ ডলার আয় করেছে তার মধ্যে বাংলাদেশি রোগীদের কাছ থেকেই আয় করেছে ৩৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার অর্থাৎ প্রায় ২,৮০০ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে প্রকাশ, গত অর্থবছরে ৪ লাখ ৬০ হাজার বিদেশি রোগী ভারতে চিকিৎসা নিয়েছেন, যাদের মধ্যে ১ লাখ ৬৫ হাজার বাংলাদেশি যার মানে চিকিৎসা নেওয়া বিদেশিদের প্রতি তিনজনের একজনই ছিলেন বাংলাদেশি।

চিকিৎসা নিতে ব্যাপকহারে বাংলাদেশিদের দেশের বাইরে চলে যাওয়া, সিংগাপুর, থাইল্যান্ড ও ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালের অসংখ্য ইনফরমেশন সেন্টার বাংলাদেশে স্থাপন এ ইঙ্গিত দেয় যে, অমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থারই চিকিৎসা দরকার। মোটা দাগে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা ও ডাক্তারদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠছে তা হলো চিকিৎসার নামে বাণিজ্য, প্রতারণা, রোগ নির্ণয়ে যথেষ্ট সময় দিয়ে ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করায় ভুল চিকিৎসার সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাওয়া, রোগীর প্রতি অবহেলা, ডাক্তারের ফি নিয়ে যথেচ্ছাচার, সেবার চেয়ে অর্থপ্রাপ্তি মুখ্য হয়ে ওঠা, রোগী ও তাদের স্বজনের প্রতি দুর্ব্যবহার, অপ্রয়োজনীয় প্যাথলজিক্যাল ও ডায়াগনস্টিক টেস্ট দেওয়া, প্রাইভেট ক্লিনিক থেকে নানা পরীক্ষার জন্য ডাক্তারদের ১৫-৩০% পর্যন্ত কমিশন নেওয়ায় ও বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি থেকে নানা উপহার-উপঢৌকন নেওয়ায় চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি ইত্যাদি।

আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় যে অসুখ বাসা বেধেছে তার জন্য ডাক্তাররা এককভাবে দায়ী নয়। স্বাস্থ্য খাতে অর্থ বরাদ্দে অপ্রতুলতা, অবকাঠামো, সরঞ্জাম ও জনবলের ঘাটতি সমস্যাকে প্রকট করে তুলছে। আমাদের স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে কমছে। স্বাস্থ্যখাতে গত অর্থবছরের মোট বরাদ্দের ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশের তুলনায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৫ শতাংশে।

আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী স্বাস্থ্যখাতে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির বরাদ্দ কমপক্ষে ৫ শতাংশ থাকা প্রয়োজন হলেও, বাংলাদেশে তা শূন্য দশমিক ৯২ শতাংশ মাত্র। আমাদের দেশে রোগীর সংখ্যা বেশি, চিকিৎসার সরঞ্জামাদি ও ওষুধপত্র সীমিত, ডাক্তারসহ অন্যান্য লোকবলও সীমিত। ফলে সত্যিকারের সেবাদান আসলেই সম্ভব হচ্ছে না।

বাংলাদেশে প্রতি ২০৩৯ জনের জন্য মাত্র একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক আছেন। সীমিত লোকবলের মধ্যে স্বাস্থ্যখাতে ৪৩ হাজার পদ খালি রয়েছে বলে জাতীয় সংসদকে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি জানান, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগে ৩৪ হাজার ৯২৩টি, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে ৮ হাজার ৫৭টি শূন্যপদ রয়েছে।

আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হলে দেশে মানসম্মত ডাক্তার তৈরির যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। তার জন্য ভালো শিক্ষক ও শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ডাক্তারদের মেডিকেল শিক্ষার বাইরে রোগী এবং স্বজনের সঙ্গে আচারণবিধি শিক্ষার ব্যবস্থাও করতে হবে। ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র মেডিকেল কলেজ খোলার ব্যাপারে আরো সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যত্রতত্র প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ গড়ে ওঠায় চিকিৎসা শিক্ষার মান নিম্নমুখী। চিকিৎসা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা আবশ্যক। আর এ জন্য দরকার সমন্বিত স্বাস্থ্য আইন।

সুখের কথা হলো, নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবার সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে আইন কমিশন ‘স্বাস্থ্যসেবা আইন এর খসড়া প্রস্তুত করেছে। এ আইনের গুরুত্বপূর্ণ বিধানগুলো হলো : এক. খসড়ায় চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ফি নির্ধারণের বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘সরকার চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা, যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুসারে রোগী প্রতি ফি নির্ধারণ করবে।’

এ ছাড়া ‘সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন প্রকার প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা, আল্ট্রাসনোগ্রাম, ইসিজি, ইটিটি, এমআরআই ইত্যাদি পরীক্ষার সর্বোচ্চ মূল্য সরকার নির্ধারিত হইবে। নির্ধারিত ফি-র অতিরিক্ত গ্রহণ করলে তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।’

দুই. চিকিৎসক, চিকিৎসা সহায়ক কর্মচারী ও চিকিৎসা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রকারের অবহেলা ও এর ফলে সৃষ্ট ক্ষতিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এ আইনে। এতে অবহেলা বলতে বোঝানো হয়েছে ‘চিকিৎসক কর্তৃক যথাযথ দায়িত্ব পালনে অবহেলা, অর্থাৎ ভুল চিকিৎসা করা, রোগ নির্ণয়ে ভুল করা, ভুল ওষুধ প্রদান, ভুল অঙ্গ অপসারণ, ভুল বা অতিরঞ্জিত রিপোর্ট প্রদান, একাধিক রোগীকে একত্রে পরীক্ষা করা, মাদকাসক্ত বা অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় চিকিৎসা দেওয়া, জরুরি ক্ষেত্রে চিকিৎসা প্রদানে অহেতুক বিলম্ব করা, অপ্রয়োজনীয় প্যাথলজিক্যাল ও ডায়াগনস্টিক টেস্ট দেওয়া, ব্যবস্থাপত্রে অপ্রয়োজনীয় এবং বিভিন্ন কোম্পানির একই ওষুধ বারবার দেওয়া, প্রয়োজন ছাড়া এখতিয়ারের বাইরে চিকিৎসা দেওয়া, কর্মস্থলে বিলম্বে আসা এবং কর্মঘণ্টা পূর্ণ হওয়ার আগে কর্মস্থল ত্যাগ করা বা বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিত থাকা, চিকিৎসার নির্ধারিত প্রটোকল অনুসরণ না করা, চিকিৎসকের কাজ নিজে না করে নার্স, আয়া, ওয়ার্ড বয় বা অন্য কাউকে দিয়ে করানো, প্রয়োজনের তুলনায় কম বা মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ প্রদান, ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিকে সাক্ষাৎ দেওয়া। চিকিৎসা সহায়ক কর্মচারীদের অবহেলাও এ আইনে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। আইনে উল্লেখিত কোনো অবহেলা সংঘটিত হলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।

তিন. প্রস্তাবিত আইনে চিকিৎসায় অবহেলা ও অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে এবং পুরো বিষয়টি তদারকির জন্য ‘জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন’ গঠনের কথা বলা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের নির্ধারিত পদ্ধতিতে কমিশনে অভিযোগ দায়েরের ব্যবস্থা আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই আইনে চিকিৎসায় অবহেলা এবং তার ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ, ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ ও আদায়ের লক্ষ্যে দেশে এক বা একাধিক ‘স্বাস্থ্যসেবা বিরোধ নিষ্পত্তি ট্রাইব্যুনাল’গঠনের কথা বলা হয়েছে।

মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবা প্রদান রাষ্ট্রের মৌলিক সাংবিধানিক দায়িত্ব। রাষ্ট্রের উন্নতি ও অগ্রগতির সাথে স্বাস্থ্যসেবা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চিকিৎসক ও রোগী প্রতিপক্ষ নন। রোগী ও তার স্বজনকে ভুলে গেলে চলবে না, শত শত ডাক্তার রোগীর শুশ্রূষা করার জন্য কত নির্ঘুম রাত কাটান, অকাতরে নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো বিলিয়ে দেন রোগীর সেবায়। তেমনি আমাদের চিকিৎসকদেরও আরো সচেতন ও সচেষ্ট হতে হবে যাতে চিকিৎসা সেবা কিছু দুর্বৃত্তের হাতে বন্দি হয়ে এ মহান পেশাকে আর কলংকিত করতে না পারে।

মো. জাকির হোসেন
অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এ সম্পর্কিত আরও খবর