কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: দারুণ অথবা ভয়ঙ্কর পরিবর্তন

, যুক্তিতর্ক

মুত্তাকিন হাসান | 2023-08-30 21:05:32

আমরা যখন ছোট ছিলাম, মনে অনেক কৌতূহল নিজের অজান্তেই ঘোরাফেরা করত। কীভাবে রেডিওতে মানুষ কথা বলে এবং গান বা নাটক হয়- বড়ই কৌতূহলী প্রশ্ন ছিল। বড়দের বলতাম, রেডিওতে ছোট ছোট মানুষরা কত সুন্দর কথা বলে। বুদ্ধি হওয়ার পর বুঝতে পারলাম এতো মামুলি ব্যাপার।

কম্পিউটার, মোবাইল ফোনসহ কত কিছুর আবিষ্কার। শুধু তাই নয়, এখন কঠিন থেকে কঠিনতর আবিষ্কার। তা হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অনেক ব্যবহার থাকলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ট্রেনিং সেন্টার, করপোরেট অফিস বা প্রফেশনাল সংগঠন, যেখানেই যাই না কেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন একটি বিশেষ আলোচ্য বিষয়। কি হবে আগামী দিনগুলো, কেমন হবে জব মার্কেট– তরুণদের মনে অনেক প্রশ্ন। যারা বুঝছে না, তারা বিষয়টিতে ঘাবড়ে যাচ্ছে। বুদ্ধি হচ্ছে জ্ঞান আহরণ করা এবং তা প্রয়োগ করার ক্ষমতা। প্রাণী ছাড়াও এখন মানুষদ্বারা মেশিন বা প্রোগ্রাম এমনভাবে তৈরি করা হয়, যেন নিজে নিজে কিছু শিখে নিতে পারে, যাকে বলা হয় বুদ্ধিমান প্রোগ্রাম বা বুদ্ধিমান মেশিন। গুগল সার্চ প্রোগ্রাম এর অন্যতম উদাহরণ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হচ্ছে কম্পিউটার বিজ্ঞানের একটি শাখা, যেখানে মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশক্তিকে কম্পিউটারের মাধ্যমে অনুকৃত করার চেষ্টা করা হয়। মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশক্তিকে কৃত্রিমভাবে প্রযুক্তি নির্ভর করে যন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এর সামগ্রিক গবেষণার লক্ষ্য হচ্ছে প্রযুক্তি তৈরি করা যার মাধ্যমে কম্পিউটার এবং মেশিনগুলি বুদ্ধিমান পদ্ধতিতে কাজ করতে সক্ষম হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার লক্ষ্য হচ্ছে কম্পিউটার বা মেশিনকে মানুষের মত জ্ঞান দান করা। মানুষের মত চিন্তা করার ক্ষমতা দান করা। আজ আমরা যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে ভাবছি, তার ভাবনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেই শুরু হয়েছিল আর এনিয়ে ভাবনায় এগিয়ে আসেন টুরিং। ১৯৫০ সালে তার লেখা ‘কম্পিউটিং মেশিনারি অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স’ পেপারে এই নিয়ে আলোচনা করেন। একটি যন্ত্রকে মানুষের সমান বুদ্ধি দেওয়া সম্ভব বলে মনে করতেন তিনি।

এ উন্নতি হলে এটি হবে সবচেয়ে দারুণ অথবা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পরিবর্তন। এজন্য দরকার হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার কীভাবে করছি। গুগলের প্রধান নির্বাহী সুন্দর পিচাই তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশাল প্রভাব দেখতে পান। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ‘মানুষের জন্য আগুন বা বিদ্যুতের চেয়েও বেশি প্রভাব রাখতে সক্ষম হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ’। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফলে মানুষের কাছে যা অসাধ্য ছিল, তা সাধিত হওয়ার সুযোগ থাকবে। এখন পর্যন্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে বেশি সুবিধা নিতে পেরেছে প্রযুক্তি খাত। এখনকার শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পশ্চিমাদের গুগল ও আমাজন আর চীনের আলীবাবা ও বাইদুর কথা বলাই যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে সফল হয়েছে তারা। যেমন আমাজনের ক্ষেত্রে রোবটকে নির্দেশ দেওয়া, ভুয়া পণ্য শনাক্ত করা এবং ডিজিটাল সহকারী সফটওয়্যার অ্যালেক্সাতে যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আলী বাবাতেও আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার দেখা যায়।

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, কর্মক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এর প্রয়োগে ব্যবস্থাপকেরা প্রতিষ্ঠানের কর্মীর ওপরে অকল্পনীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। কর্মীদের হাতে পড়ার উপযোগী একটি ব্যান্ডের পেটেন্ট করিয়েছে মার্কিন প্রতিষ্ঠান আমাজন। ব্যান্ডটি ওয়্যারহাউজের কর্মীদের হাতের নড়াচড়া শনাক্ত করতে সক্ষম। কর্মীরা যখন বসে থাকবে, তখন এটি ভাইব্রেশন দেওয়া শুরু করবে।

‘ওয়ার্ক ডে’ নামের আরেকটি সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কথা বলা যাক। প্রতিষ্ঠানের কোন কর্মীর কী মনোভাব তা জানা দরকার? কে কখন চাকরি ছাড়বে, সেটি ধারণা করা লাগবে? নানা তথ্য বিশ্লেষণ করে সফটওয়্যারটি সে সুবিধা দেয়। ৬০টি বিষয় বিবেচনা করে কৃত্রিম বুদ্ধির প্রয়োগে পূর্বাভাস দিতে পারে ওয়ার্কডে সফটওয়্যার।

এছাড়া ‘হিউম্যানজি’ নামের একটি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান স্মার্ট আইডি ব্যাজ তৈরি করেন। এ ব্যাজ কর্মীদের আচরণ শনাক্ত করতে পারে। সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলার ধরন বা আচরণের ধরনসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে ওই ব্যাজ। পরে তার ফল জানিয়ে দিতে পারে।

অবশ্য কর্মক্ষেত্রে নজরদারির বিষয়টি একেবারে নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরেই কর্মীদের ওপর নজরদারি করে আসছে অনেক প্রতিষ্ঠান। কর্মীরা কখন কী করেন, কখন অফিসে আসেন বা কখন বাইরে যান, বিভিন্ন উপায়ে প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতনেরা তা জানার চেষ্টা করেন। এ ছাড়া কর্মীরা কম্পিউটারের বসে কী কাজ করেন, সেটাও তাঁদের অজানা নয়। প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে দিতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ করে।

তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে। ফ্যাক্টরি, ব্যাংক ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যন্ত্র ব্যবহৃত হলে হাজার হাজার লোক বেকার হয়ে পড়বে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে যন্ত্রে খরচ বৃদ্ধি পেতে পারে। তার প্রভাব বিশেষ করে স্বল্প আয়ের দেশগুলো মারাত্মক সমস্যায় পরবে। ব্যাংক, এটিএম বুথ, ফ্যাক্টরি, হাসপাতাল ইত্যাদিতে এই যন্ত্রপাতি স্থাপনের জন্য প্রচুর খরচ পড়বে। এছাড়াও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফলে মানুষের সৃজনশীলতা হ্রাস পাবে। কারণ মানুষ তখন নিজে চিন্তা-ভাবনা না করে যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়বে। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আর মানুষ তার মতো আরেকটি যন্ত্র ব্যবহার করবেন। তবে মানুষ কখনই তার থেকে বুদ্ধিমান কোন যন্ত্র আবিষ্কার করতে পারবে না যা মানুষকে পরিচালিত করবে। আর এমনটা যদি হয়ে থাকে তাহলে পৃথিবীর কোন ইকো সিস্টেম ঠিক থাকতে পারে না এবং পৃথিবীর ধ্বংস সে ক্ষেত্রে অনিবার্য। এছাড়া এ যন্ত্রে নিজস্ব অনুভূতি প্রবেশ করানো হলে তখন নিজে নিজে বিপজ্জনক অস্ত্র নির্মাণ করতে সক্ষম হবে এবং সেই অস্ত্র দিয়ে মানবজাতিকে শাসন ও শোষণ করতে পারে।

এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা নিজেদের কতটুকু প্রস্তত করতে পেরেছি। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় শিল্প কারখানার ধরন অনুযায়ী আমাদের কি ধরনের দক্ষতা বা জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, তা নিয়ে সমন্বয় প্রয়োজন। দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি যদি মানব সম্পদ নিয়ে ভাবা না হয়, তাহলে থমকে যাবে অনেক কিছু। প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কারণে অন্য যাই হোক না কেন, নতুন নতুন কর্মক্ষেত্রের পাশাপাশি আগামী ১০ বছরের মধ্যে অনেক পেশা হারিয়ে যেতে পারে। এখনই আমাদের এর বিকল্প ভাবার সময়। তা না হলে আমাদের মতো দেশ কঠিন বিপদের সম্মুখীন হবে।

স্কুল পর্যায় থেকেই আমাদের পাঠদান প্রযুক্তি নির্ভর হওয়া দরকার। দেশজুড়ে কারিগরি শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। এমন একটি তথ্যপ্রযুক্তির দক্ষ প্রজন্ম তৈরি করতে হবে, যাতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাব মোকাবিলা করতে পারে। সনদধারী নয়, দক্ষতা সম্পন্ন কর্মীর দ্বারা এ যজ্ঞ সম্পন্ন করতে হবে। দক্ষ মানব সম্পদ সৃষ্টি করতে পারলেই প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে আমরা সঠিকভাবে চলতে পারব। তখনই সম্ভব হবে অতিরিক্ত কর্মক্ষম জনমানবকে কাজে লাগানো আর মোকাবিলা করা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ।

 

মুত্তাকিন হাসান: কবি,প্রাবন্ধিক ও মানব সম্পদ পেশাজীবী

এ সম্পর্কিত আরও খবর