আইসিজের আদেশ: সুবিচারের শুভসূচনা

, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স | 2023-08-27 16:48:35

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলায় রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)।

আদালত জানান, গণহত্যা সনদের ধারা ২ এর আলোকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী একটি বিশেষ সুরক্ষার অধিকারী (প্রোটেক্টেড) গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচ্য।

এটি কোনো চূড়ান্ত রায় নয়। তবে এ রায়ের ফলে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিচারের একটি শুভসূচনা হলো বলেই মনে হয়। জাতিসংঘ তথ্যানুসন্ধানী দলের উদ্ধৃতি দিয়ে রায়ে বলা হয়, মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতায় গণহত্যার উদ্দেশ্য ছিল। প্রাথমিক আদেশের এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, গাম্বিয়ার মামলার মূল অভিযোগই ছিল মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ। আদালত বলছে, গণহত্যার উদ্দেশ্য ছিল। এখন আসলেই গণহত্যা হয়েছে কি হয়নি, সেটি মামলার পরবর্তী স্তরেই প্রমাণিত হবে।

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে গাম্বিয়া মামলাটি করে। রোহিঙ্গাদের গণহত্যা করে মিয়ানমার গণহত্যা কনভেনশনের লঙ্ঘন করেছে। কাজেই গণহত্যা কনভেনশন অনুযায়ী মিয়ানমার অপরাধী এটাই এ মামলার মূল প্রতিপাদ্য।

মামলায় গাম্বিয়া কিছু অন্তর্বর্তী আদেশ আদালতের কাছে প্রার্থনা করেছে। এগুলো মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণের জন্য বেশ জরুরি ছিল। এছাড়া প্রাথমিক শুনানির আরেকটি মূল বিষয় হচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যুটি বিচার্য কিনা ও সেই সাথে আদালতের এখতিয়ার আছে কি না ও এ অভিযোগে মিয়ানমারের বিচার হতে পারে কি না। আদালতের প্রাথমিক রায়ে সব বিষয়গুলোতেই এক ধরনের ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

সাধারণত যে কোনো মামলাতেই প্রাথমিকভাবে এ বিষয়গুলো নিয়েই বিতর্ক হয়। এ বিষয়গুলোর সুরাহা হওয়ার মাধ্যমে মামলার পরবর্তী ধাপে গাম্বিয়ার অভিযোগগুলোর শুনানি হবে। তবে প্রাথমিক শুনানির আজকের এ রায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গারা চেয়ে আছে আদালতের দিকে। এখানে রোহিঙ্গারা ফেরত যাবে কি যাবে না, রোহিঙ্গারা কোন দেশের নাগরিক, তার চেয়েও বড় বিষয় একটি জনগোষ্ঠী বিশ্ব দরবারে ন্যায়বিচার পাবে কি পাবে না। নাকি সামরিক জান্তা-শান্তিমাতার যৌথ প্রযোজনার গণহত্যা আইনের মারপ্যাচে ধামাচাপা পড়ে যাবে। জানি, আইনের কাছে আদালতের হাত পা বাঁধা। আদালত কাজ করে আইন ও প্রমাণ নিয়ে। মিয়ানমার অপরাধ করেছে এটা বিশ্ববাসী জানে। কিন্তু মিয়ানমার অপরাধ করে তাদের সব আলামত গত দুই বছরে ধুয়ে মুছে ফেলেছে। তারপরও যে আলামত রয়েছে তা সঠিকভাবে পেশ করা হলে মিয়ানমারের অপরাধ প্রমাণ নিশ্চিত। কিন্তু সে কাজটি করতে হলে আইন ও ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংয়ের কাজটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নামকাওয়াস্তে মামলা করে লাভ নেই। মামলার ফলাফলে মিয়ানমার নির্দোষ হলে তাদের অপরাধ আর অপরাধ থাকবে না। এছাড়া আন্তর্জাতিক আদালত আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাইরে কিছু নয়। আন্তর্জাতিক আদালতের রায় নিয়ে যারা পড়াশোনা করেন, তারা জানেন এ আদালতের রায় খুব কম ক্ষেত্রেই বিশ্ব মোড়লদের বিপক্ষে গেছে। তবে সেক্ষেত্রেও আদালতের রায় যুক্তিভিত্তিক হতে হয়।

আমরা জানি, বিশ্বের অধিকাংশ মোড়লরাই মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারতও প্রকারান্তরে মিয়ানমারের পক্ষেই। মুসলিম বিশ্ব রোহিঙ্গাদের পক্ষে থাকলেও আসলে কেউ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। শেষমেষ ওআইসি গাম্বিয়াকে মামলা করতে বলে।

এক সময় চীনের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। এমনকি তারা আমাদের উন্নয়নের অন্যতম অংশীদারও ছিল। আজও আছে। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা তাদের পাশে পাইনি। গত দুই দশকের মধ্যে বর্তমানে চীন-মিয়ানমার সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ বলে দৃশ্যমান। আইসিজের মামলা শুরু হওয়ার আগে চীন সরকারের এক মন্ত্রী সু চির সঙ্গে দেখা করে পরামর্শ দিয়েছেন। কদিন আগে আবার মামলার প্রাথমিক শুনানির পর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং মিয়ানমারে দুই দিনের (জানুয়ারি ১৬-১৮, ২০২০) সফরে গেছেন। মিয়ানমারের প্রতি চীনের বর্তমান আগ্রহের অন্যতম প্রধান কারণ মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চল। এ রাখাইন অঞ্চল ঘিরেই তৈরি হচ্ছে চীনের একটি অর্থনৈতিক করিডোর। এভাবে অন্যান্য দেশের স্বার্থ রয়েছে মিয়ানমারে। বাণিজ্যিক, সামরিক, জাতিগত, ভূকৌশলগত—নানাভাবেই বিশ্ব মোড়লদের কাছে মিয়ানমারের গুরুত্ব বেশি। সেখানে রোহিঙ্গা বা বাংলাদেশের গুরুত্ব তাদের কাছে কমই। কিন্তু এখানে সবচেয়ে বড় বিষয়টি হচ্ছে মানবাধিকার। আদালতের কাছে এটিই প্রণিধানযোগ্য। পরবর্তী স্তরে আমরা আদালতের কাছে মানবাধিকারেরই সন্ধান করবো।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার বরাবরই ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়েছে। মামলা চলাকালেই মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সেই কমিটি ইতোমধ্যে একটি প্রতিবেদন পেশ করেছে যেখানে বলা হয়েছে রাখাইন রাজ্যে নির্যাতন হয়েছে বটে, যুদ্ধাপরাধও হয়েছে, কিন্তু গণহত্যা হয়নি! বোঝাই যায়, মামলাকে প্রভাবিত করতেই তাদের এ তদন্ত কমিশন। তারা এই কমিশনের নাম দিয়েছে তথাকথিত ‘ইনডিপেনডেন্ট কমিশন অব ইনকোয়ারি (আইসিওই)'। আন্তর্জাতিক আদালতের কাছে এ কমিশন বা এর প্রতিবেদন কোনোটাই গ্রহণযোগ্য নয়। কমিশন রোহিঙ্গা নির্যাতনকে তাদের অভ্যন্তরীণ সংঘাত বলে দাবি করছে। কিন্তু এই কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ইতোমধ্যে কমিশনের একজন সদস্য পদত্যাগ করেছেন। সেই সঙ্গে হিউমান রাইটস ওয়াচ এই তদন্ত কমিশনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সবাই বুঝতে পারছে যে মিয়ানমার অপরাধ ঢাকার জন্য নানা টালবাহানা করছে। তারা বলছে, অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস মোকাবেলার জন্য কিছু অপরাধ হলেও হতে পারে, কিন্তু তা গণহত্যা নয়। আবার বলছে এই ইস্যুকে আন্তর্জাতিকীকরণ করা ঠিক হবে না। সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমারই অপরাধীদের বিচার করবে। সু চি বা মিয়ানমার দীর্ঘদিন সামরিক শাসনের জাঁতাকলে থেকে থেকে হয়তো ভুলে গেছে যে সার্বভৌমত্বের দোহাই দিয়ে গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করা যায় না।

রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের নৃশংসতা একটি বাস্তবতা। বিশ্ববাসীকে এই বাস্তবতা স্বীকার করতে হবে। আশার কথা, পশ্চিমা বিশ্বের বরফ গলতে শুরু করেছে। কানাডা ও নেদারল্যান্ডসের পর এখন যুক্তরাজ্যও আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থনের কথা জানিয়েছেন। এ সমর্থন আরও বাড়লে রোহিঙ্গাদের বিচার পাওয়া সহজ হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এগিয়ে আসতে হবে। চালাতে হবে কূটনৈতিক প্রয়াস।

এই আদেশ কোনো চূড়ান্ত আদেশ নয়। এ থেকে মিয়ানমার দোষী বা নির্দোষ তা নির্ধারিত হবে না। শুধু কিছু অন্তর্বর্তী আদেশ দেওয়া হলো। মামলা মামলার মতো চলবে। তবে এ আদেশ প্রাথমিকভাবে মিয়ানমারকে দোষী হিসেবে বিবেচনা করারই ইঙ্গিত বহন করে। মামলা চলাকালে আরো অনেক বিষয় রয়েছে যার ওপরই নির্ভর করবে চূড়ান্ত রায় কোন দিকে যাবে। আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতিও এখানে একটি বড় চালিকাশক্তি। আন্তর্জাতিক আদালত ন্যায়বিচারের শেষ আশ্রয়স্থল। রোহিঙ্গারা সেখানে অন্তত সুবিচার পাবে এটাই কাম্য।

এরশাদুল আলম প্রিন্স: আইনজীবী ও লেখক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর