আইসিজের অন্তর্বর্তীকালীন রায় ও রোহিঙ্গা ইস্যুর ভবিষ্যত

, যুক্তিতর্ক

ড. মো. কামাল উদ্দিন | 2023-09-01 14:49:45

২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর পূর্ব পরিকল্পিত ও একটি সমন্বিত সহিংসতা জোরদার করেছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনী। মিয়ানমার মিলিটারি জান্তা গণহত্যা চালিয়েছিল নির্বিচারে। গণহত্যার পাশাপাশি সংঘর্ষ, ধর্ষণ, ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জীবন বাঁচাতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর এক বৃহৎ অংশ বাংলাদেশে পালিয়ে যায়। এ সংখ্যা প্রায় ৭ লাখ ৪০ হাজারের উপরে।

রোহিঙ্গাদের ওপর পরিকল্পিতভাবে মিয়ানমারের সামরিক গোষ্ঠীর এই ধরনের নির্যাতন ও হত্যাকে একটি নৃশংস গণহত্যা হিসেবে আখ্যা দিয়ে ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর বিশ্বের সর্বোচ্চ আদালত নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসে (আইসিজে) পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া একটি গণহত্যা মামলা করে। পশ্চিম আফ্রিকার একটি ক্ষুদ্র দেশ পুরো মুসলিম বিশ্ব ও বিশ্বমানবতার পক্ষে এবং আন্তর্জাতিক শান্তির পক্ষে এই ধরনের মামলা করায় গাম্বিয়া নতুনভাবে সপ্রশংস আলোচনায় আসে।

আন্তর্জাতিক আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে ২০১৯ সালের ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর শুনানি শুরু করেন। এ শুনানির মূল বিষয় ছিল রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা প্রদান ও ২০১৭ সালের আগস্টের রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত পূর্ব পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞকে একটি গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা। গাম্বিয়া  মামলাটি করে আন্তর্জাতিক ইসলামিক সহযোগী সংস্থা ওআইসির পক্ষে। গাম্বিয়া আন্তর্জাতিক আদালতের প্রতি আহ্বান জানায় যে, অনতিবিলম্বে একটি নির্দেশনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা প্রদান করা এবং মিয়ানমারকে ২০১৭ সালের আগস্টে পূর্বপরিকল্পিত যে হত্যাযজ্ঞ নির্যাতন চালিয়েছিল সেটিকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে মিয়ানমারের বিচার করা এবং মিয়ানমারের গণহত্যা আচরণ অবিলম্বে বন্ধ করার ব্যবস্থার বিষয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের একটি আদেশের জন্য প্রার্থনা জানায়।

গাম্বিয়ার পক্ষে ওই মামলায় অংশগ্রহণ করেন গাম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল ও বিচারমন্ত্রী আবুবাকার মারি তামবাদো। অন্যদিকে  মায়ানমারের তথাকথিত গণতান্ত্রিক নেত্রী ও নোবেলজয়ী অং সান সু চি মিয়ানমারের পক্ষে আদালতে উপস্থিত হয়ে তার বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি সরাসরি গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং উক্ত মামলাটি খারিজ করার জন্য তিনি বলেন যে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালানোরও যে অভিযোগ আন্তর্জাতিক আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ অসত্য, অসম্পূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর।

তিনি আরও অভিযোগ করেন যে, এই সংক্রান্ত মামলা করার এক্তিয়ার গাম্বিয়ার নেই এবং মামলা পরিচালনার এক্তিয়ার জাতিসংঘের বা আন্তর্জাতিক আদালতের নেই বলে দাবি করেন। তাই  তিনি সরাসরি মামলাটি আমলে না নিয়ে গণহত্যার অভিযোগ সরাসরি খারিজ করতে আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারকদের তিনি আহ্বান জানান।

আন্তর্জাতিক আদালত ওই শুনানির পর ২৩ জানুয়ারি ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারক প্যানেলের মাধ্যমে একটি অন্তর্বর্তীকালীন রায় ঘোষণা করেন। বিচারক প্যানেলের সভাপতিত্ব করেন বিচারক আব্দুলকোয়াই আহমেদ ইউসুফ। এ রায় ছিল একটি সমন্বিত রায়। বিচারক প্যানেলের সভাপতি রায়ের একটি অংশে তুলে ধরেন যে, রোহিঙ্গারা যারা এখনো মিয়ানমারে অবস্থান করছেন তারা মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছেন এবং তারা পুনরায় গণহত্যার শিকার হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক বিচার আদালত ১৯৪৮ সালের গণহত্যা সনদের আলোকে যেই সকল কর্মকাণ্ড বা আচরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা প্রতিরোধে মিয়ানমারকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ সময়ে ১৪ জন স্থায়ী বিচারক ও দুজন এডহক বিচারপতি আদালতে সরাসরি উপস্থিত ছিলেন।

জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক গণহত্যা কনভেনশন অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দেয়ার কথা বলা হয় এই রায়ে। এ অন্তর্বর্তীকালীন রায় যে  বিষয়গুলোর ওপর সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় সেগুলো হলো— রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা প্রদান, ২০১৭ সালের আগস্ট এবং এর পরবর্তী সময়ে রোহিঙ্গাদের ওপর যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল তার যে সকল প্রমাণ আছে সেগুলো ধ্বংস না করা, মিয়ানমারের সশস্ত্রবাহিনী পুনরায় কোনও ধরনের গণহত্যা না ঘটানো এবং চার মাস পরপর মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতে এই বিষয়ে রিপোর্ট প্রদান করা। যতদিন পর্যন্ত একটি চূড়ান্ত রায় প্রকাশিত না হয় ততদিন পর্যন্ত ওই রিপোর্ট অব্যাহত রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়।

আন্তর্জাতিক গণহত্যা সনদের ধারা ২-এর আওতায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সব ধরনের সুরক্ষা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা মিয়ানমারের ওপরে প্রদান করা হয়েছে। এই রায়ের এবং মামলার বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে কতগুলো বিষয় সামনে আসে তা বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন রয়েছে।

এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ রায় একটি যুগান্তকারী রায়। এ রায়ের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে একটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। এটি বিশ্বমানবতার বিজয়, বিশ্ব শান্তির বিজয় এবং একটি নিভৃত মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠানের বিজয়। গাম্বিয়াকে অভিনন্দন জানাচ্ছি এই ধরনের ইতিহাস সৃষ্টি করার ভূমিকা রাখার জন্য। রায়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের গণতন্ত্রী নেত্রী গাম্বিয়া মামলা করার এক্তিয়ারের বিষয়ে যে অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন এবং এই মামলার বিচার করার এক্তিয়ার নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের সীমাবদ্ধতাকে রয়েছে এ বিষয়ে যে অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন সে অভিযোগ নাকচ করা হলো এ রায়ের মাধ্যমে।

আন্তর্জাতিক আদালত সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, আন্তর্জাতিক গণহত্যা কনভেনশনের  ৪১ ধারা মোতাবেক আন্তর্জাতিক আদালত এই ধরনের গনহত্যার মামলা পরিচালনা করার এক্তিয়ার রয়েছে।

এ মামলার মাধ্যমে মিয়ানমার যে অভিযোগ অস্বীকার করেছিল যে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের উপর কোনো গণহত্যা চালানো হয়নি সে অভিযোগ ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এরাই বা পরবর্তীতে চূড়ান্ত রায়ের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কতটুকু সফল হবে তা নিয়ে হয়তোবা কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে।

আপাত দৃষ্টিতে এ রায়ের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারের ও মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনীর নৈতিক পরাজয় হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন জেগেছে ধূর্ত মিয়ানমার সরকার এবং সামরিক বাহিনী এ রায় কতটুকু কার্যকর করবে বা মেনে চলবে সে নিয়ে। এ সংশয় শুধু বাংলাদেশি নাগরিক বা নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের নয়, এ সংশয় খোদ জাতিসংঘের বিশেষ দূতেরও। জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াং হি লি সংশয় প্রকাশ করে বলেন যে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত যে রায় দিয়েছেন তা যেন মিয়ানমার এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ না পায় সেজন্য তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।

তার এ বক্তব্য আমাদের মনে নতুন সংশয় তৈরি করেছে। সত্যিকার অর্থে জাতিসংঘ রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা দিতে পারেনি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এই ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। চীন ও রাশিয়ার লজ্জাজনক ও অনিরপেক্ষ ভূমিকা কারও দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। চীন আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার যে স্বপ্ন দেখছে সেটি কতটুকু সফল হবে তা একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ মানবাধিকারকে সম্মান করা ছাড়া বা নির্যাতিত জাতিগোষ্ঠীর অধিকার ভূলুণ্ঠিত করে চীনের বিশ্ব দরবারে উপস্থিতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কিভাবে মেনে নিবে তা আমাদের বোধগম্য নয়।

ক্ষুদ্র পশ্চিম আফ্রিকার রাষ্ট্র গাম্বিয়া আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে রোহিঙ্গা ইস্যুকে উপস্থাপন করলেও এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে বলা যায় যে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে উপস্থাপন করতে পরিপূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে নিরাপত্তা পরিষদের এই ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকায় এই মামলার চূড়ান্ত রায়, রায়ের প্রতিফলন ও বাস্তবায়ন বা রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কতটুকু সফল হবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়েছে।

তবে এটি ঠিক যে মিয়ানমার  সরকার যে গণহত্যা  চালিয়েছে তা এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং শতভাগ স্পষ্ট। এই গণহত্যার সুষ্ঠু বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের রায় শুধু যথেষ্ট নয় তাই একটি পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা এখন সময়ের দাবি। উদাহরণস্বরূপ সিয়েরালিওন, রুয়ান্ডা ও বসনিয়ায় গণহত্যার বিচারের জন্য যে ধরনের ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল ঠিক সেরকম একটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি এখন যৌক্তিক। উক্ত ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দোষীদের একটি যুগান্তকারী শাস্তি প্রদান করে ইতিহাস সৃষ্টি করতে হবে।

ড. মো. কামাল উদ্দিন: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর