ই-হয়রানি!

, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-30 04:06:42

২২ জানুয়ারি, ২০২০ তারিখটি ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রগতির ইতিহাসে আলাদা করে উল্লেখ করার মত একটি দিন। পাসপোর্ট ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে পা রাখলো এই দিনে। আগে ছিল হাতে লেখা অ্যানালগ পাসপোর্ট। যাতে গলা কেটে একজনের ছবি আরেকজনের পাসপোর্টে জুড়ে দেয়া যেতো। এরপর এলো মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট। এখন এলো ই-পাসপোর্ট। তবে ই-পাসপোর্ট বাংলাদেশেই প্রথম নয়। বাংলাদেশ বিশ্বের ১১৯তম ই-পাসপোর্টধারী দেশ। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই প্রথম। ই-পাসপোর্ট বিশ্বজুড়ে মানুষের চলাচলকে আরো নির্বিঘ্ন করবে। গলাকাটা পাসপোর্টের দিন ফুরিয়েছে অনেক আগেই। এবার দ্রুতগতিতে ইমিগ্রেশন পেরোনোর পালা।

বর্তমান আধুনিক বিশ্বে পাসপোর্ট একজন মানুষের পরিচয়। দেশের প্রতিটি মানুষের পাসপোর্ট পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু বাংলাদেশে পাসপোর্ট অফিস হলো হয়রানির উর্বরতম ক্ষেত্রগুলোর একটি। এই হয়রানি পদে পদে। আবেদনপত্র জমা দেয়ার লাইন, ছবি তোলার লাইন, পুলিশ ভেরিফিকেশন এমনকি পাসপোর্ট পেতেও লাইন দিতে হয়। তবে লাইন নিয়ে আমার আপত্তি নেই। লাইন মানেই শৃঙ্খলা। বাংলাদেশে যেহেতু মানুষ বেশি, তাই লাইনও হয় লম্বা। কোনো কারণে পাসপোর্ট অফিসে গেলে যে কারো দিন শেষ হয়ে যায়। লাইন যেহেতু লম্বা হয়, কাউন্টার সংখ্যা বাড়িয়েই কিন্তু এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।

পাসপোর্ট সরকার বিনা পয়সায় দেয় না। নির্ধারিত হারে টাকা জমা দিয়েই আবেদন করতে হয়। আগে টাকা জমা দিতেও লম্বা লাইন হতো। এখন ব্যাংক বাড়িয়ে এ সমস্যার সমাধান করা গেছে। একই উপায়ে জমা দেয়ার লাইনও ছোট করে ফেলা সম্ভব। মানুষ টাকা দিয়ে সার্ভিস কিনবে, তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে কেন?

তবে শুধু লাইন দিলেও না হয় হতো, সাথে দিতে হয় টাকাও। আবেদনের পর পাসপোর্ট তৈরি হলে আবেদনকারীর মোবাইলে একটি বার্তা আসে। সর্বোচ্চ ২১ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট তৈরি হওয়ার কথা। কিন্তু মাসের পর মাস কেটে যায়, সেই বার্তা আর আসে না। কিন্তু দালাল ধরলে আগেই চলে আসে পাসপোর্ট। বৈধ নাগরিকদের পাসপোর্ট পেতে নানান হয়রানি পোহাতে হলেও শুনি রোহিঙ্গারা টাকার বিনিময়ে আরামসে পাসপোর্ট বানিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের অপরাধের দায় নিতে হয় বাংলাদেশকে।

পাসপোর্ট করতে হয়রানী হয় পদে পদে, ধাপে ধাপে। পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে সময় এবং অনিবার্যভাবে অর্থ নষ্ট হয়। ভেরিফিকেশনের নামে এমনকি বিচারপতির বাসা থেকেও টাকা নেয় পুলিশ। পুলিশের টাকা খাওয়ার একটা খাত বাড়ানো ছাড়া পুলিশ ভেরিফিকেশনের আর কোনো কার্যকারিতা নেই। আপনি ভালো হোন আর খারাপ, টাকা দিলে পুলিশ আপনাকে সার্টিফিকেট দিয়ে দেবে। আপনার নামে মামলা-মোকদ্দমা থাকলে রেট একটু বেশি হবে এই যা। বাংলাদেশের নাগরিক সবারই পাসপোর্ট পাওয়ার আছে। তাই যার কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র থাকবে, তাকেই পাসপোর্ট দেয়া উচিত; এখানে আলাদা ভেরিফিকেশন অর্থহীন।

পাসপোর্টের হয়রানি শুধু দেশে নয়, বিদেশেও পোহাতে হয়। বিভিন্ন দেশে আমাদের হাইকমিশন ও মিশনে পাসপোর্ট করতে এসে, রিনিউ করতে এসে, সংশোধন করতে এসে প্রবাসী বাংলাদেশীদের হয়রানী চোখে দেখিনি, তবে নানা বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যমে শুনেছি। প্রবাসী বিশেষ শ্রমিক, যাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে ফুলে ফেঁপে ওঠে আমাদের অর্থনীতি; তাদের আমাদের হাইকমিশনের কর্মকর্তারা মানুষের মর্যাদাও দেন না।

ই-পাসপোর্ট উদ্বোধন উপলক্ষে আমি হয়রানি নিয়ে পড়লাম কেন? এ প্রশ্ন কেউ কেউ করতে পারেন। এমন শুভদিনে হয়রানীর কথা বলতে আমারও ভালো লাগছে না। কিন্তু না বলেও পারছি না। বেলা ১১টার দিকে এক ব্যস্ত ডাক্তারের ফোন পেলাম। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তিনি বললেন, মাকে নিয়ে পাসপোর্ট অফিসে এসেছি। তিন ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু এখনও পাসপোর্ট অফিস খোলেইনি। কখন খুলবে, সেটা বলার মত কেউও নেই, কোনো নোটিশও নেই। আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, আজ তো ই-পাসপোর্টের উদ্বোধন। তারা নিশ্চয়ই খুব ব্যস্ত। আপনি বরং কাল যাইয়েন। তিনি আরো ক্ষেপে গেলেন, ভাই আমি অনেক কষ্টে আজকে দুপুর একটা পর্যন্ত টাইম ম্যানেজ করেছি। যদি জানতাম যে আজ কোনো কাজ হবে না, তাহলে আমি অন্য একদিন সময় বের করতাম। আমার যে একটা ওয়ার্কিং ডে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেটে যাচ্ছে, তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে? কাজ বন্ধ নিয়ে তার যতটা ক্ষোভ, তারচেয়ে অনেক বেশি ক্ষোভ; এ ব্যাপারে কোনো নোটিশ না থাকায়। সেই ডাক্তার জানালেন, এই ভোগান্তি তার একার নয়। হাজারখানেক লোক জমে আছে পাসপোর্ট অফিসের সামনে। অবশ্য পাসপোর্টে অফিসের সামনে প্রতিদিনই অনেক মানুষের জটলা থাকে। সেটা আস্তে আস্তে ক্লিয়ারও হয়ে যায়। কিন্তু সেদিন হচ্ছিল না, কারণ অফিস বন্ধ বলে, অপেক্ষমান লোকের সংখ্যা কেবল বাড়ছিলই। তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি জানার মত কাউকে পাওয়া যায়নি। কারণ দায়িত্বশীলদের বেশিরভাগই বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে উ-পাসপোর্ট উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছিলেন। পরে ঢাকার অন্য একটি পাসপোর্ট অফিসের এক কর্মকর্তা জানালেন, অফিস থেকে অর্ধেক লোককে ই-পাসপোর্ট উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যেতে বলা হয়েছিল। তবে অফিসের কাজ বন্ধ ছিল না। যেহেতু লোকবল অর্ধেক ছিল, তাই কাজের গতিও নিশ্চয়ই অর্ধেক ছিল। সে কারণেই হয়তো কারো কারো মনে হতে পারে, অফিস বন্ধ ছিল। আসলে অফিস বন্ধ ছিল না। তার দাবি শুনে আমি আবার সেই ডাক্তারকে ফোন করি। নিশ্চিত হতে চাই, তার অভিযোগ সম্পর্কে। তিনি আরো নিশ্চিত করে জানালেন, তিনি সকাল আটটায় লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু দুপুর দেড়টার আগে অফিস খোলাই হয়নি। দেড়টায় অফিস খোলার পর ভেতরে ঢুকে তিনি কাজ শেষ করে বেরুতে পেরেছেন বেলা তিনটায়। তার মানে সকাল ৮টা থেকে বিকাল তিনটা- সাত ঘণ্টা হারিয়ে গেছে তার জীবন থেকে।

আমাদের দেশে আসলে সেবা সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণাই নেই। সেবা দেয়ার সুযোগকেই সবাই ক্ষমতা মনে করেন। যেখানেই সেবা, সেখানেই হয়রানি। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টো। একসময় পয়সা দিয়ে টিঅ্যান্ডটি ফোন কেনার জন্য মন্ত্রীর তদ্বির লাগতো। টিঅ্যান্ডটি ফোনের দাম যত, ঘুষ দিতে হতো, তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি। আর এখন সেই ফোন বিনা পয়সায় দিলেও কেউ নিতে চায় না। বিপদে পড়লে মানুষ থানায় যায়। সেখানেও পদে পদে হয়রানি। জমির কেনাবেচার জন্য তহশিল অফিসে মানুষের হয়রানির অন্ত নেই। গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ- যেখানে যত সেবা, সেখানেই তত হয়রানি। বাংলাদেশে যতই ডিজিটাল হচ্ছে, আশা করছি হয়রানিও তত কমে আসবে। তবে আমাদের সেবাদাতাদের মানসিকতা না বদলালে ডিজিটাল করে খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না। যন্ত্রের পেছনের মানুষটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

যারা জনগণের সেবা দেয়ার দায়িত্ব পেয়েছেন, তাদের বুঝতে হবে, এটা তাদের সৌভাগ্য। মানুষের সেবা করার সুযোগ সবাই পায় না। ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। এই বাংলাদেশেই ৯৯৯ নাসের জরুরি সার্ভিস আছে। আমি এখন পর্যন্ত ৯৯৯ সম্পর্কে কারো কোনো অভিযোগ শুনিনি। সবার শেষে আসা ৯৯৯ যদি সবার মন জয় করতে পারে পুলিশ, পাসপোর্ট, পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ অফিসে গিয়ে মানুষ যথাযথ সেবা পাবে না কেন? মানুষ সরকারকে ট্যাক্স দেয়। তার ওপর প্রতিটি সেবা পয়সা দিয়েই কিনতে হয়। একই দেশে বেসরকারি সেবাদাতারা মানুষের বাসায় সার্ভিস পৌঁছে দেয়। আর সরকারি অফিসে ধর্না দিতে দিতে মানুষের জুতার সোল ক্ষয় হয়ে যায়। এ কেমন বৈপরীত্য।

ই-পাসপোর্ট উদ্বোধনের এমন শুভক্ষণে এই হয়রানির কথা বলতে আমারও ভালো লাগছে না। কিন্তু শুধু উন্নয়নের গল্প শোনালেই হবে না। মানুষের সেবা নিশ্চিত করতে হবে। পদে পদে ঘুষ আর হয়রানি; মানুষের মনে কখনো স্বস্তি আনবে না। আর ই-পাসপোর্ট নিয়ে যে স্বপ্ন আমরা দেখছি; তাও দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারে, যদি রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা না বাড়ে। শুধু ই-পাসপোর্ট হলেই ৩০ সেকেন্ডে ইমিগ্রেশন পেরোনো যাবে না। আসলে। আমরা যদি দুর্নীতি দূর করে সমৃদ্ধ ও আত্মমর্যাদাশীল জাতিতে পরিণত হতে পারি, তখনই কেবল আমরা বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে চলতে পারবো; গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে যাবো যে কোনো বিমানবন্দর। সেই অর্জনের পথে আমাদের যাত্রাটা আরো দ্রুত, নির্বিঘ্ন হোক।

 

প্রভাষ আমিন: হেড অফ নিউজ, এটিএন নিউজ

এ সম্পর্কিত আরও খবর