চাই না ফাঁকা গুলি, ফাঁকা বুলি

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স | 2023-08-30 17:41:59

এই দেশে ভোট উৎসব বলে একটা কথা ছিল। ভোট উৎসবের সঙ্গে সঙ্গে ভোট সন্ত্রাসও কম ছিল না। ভোট নিয়ে সন্ত্রাস এদেশে নতুন কিছু নয়। নব্বইয়ে গণতন্ত্র উত্তরণের পর সুষ্ঠু ভোটের একটি সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী আচরণবিধির ওপর জোড় দেয়। বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের অধীনে ও পরবর্তী তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আমরা মোটামুটি চারটি সুষ্ঠু ভোট পেয়েছি। এসব নির্বাচনে দেশের বড় দুইটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই জয়ী হয়েছে। একথা সত্যি যে এসব ভোটেও পেশিশক্তির প্রদর্শনী হয়েছে। কিন্তু তারপরও নির্বাচনগুলো সবার কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে।

ভোট এক লড়াই। কিন্তু এ লড়াইয়ে মারামারি যাতে না হয় সেটিই কাম্য। ভোটে কথার লড়াই, প্রতিশ্রুতির লড়াই, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার লড়াই-এ সবই নির্বাচনের স্বাভাবিক অনুষঙ্গ। কিন্তু লাগামছাড়া মারামারি বা কথার লড়াই ভোটের কাল। একটি দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক চরিত্রই প্রতিফলিত হয় ভোটের মাঠে। জোর করে ভোটের মাঠ শান্তিপূর্ণ করা যায় না। আইন দিয়ে রাজনৈতিক চরিত্র বদল কঠিন বিষয়। নির্বাচন কমিশন লাঠিসোটা নিয়ে মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকবে না। তাদের মনিটরিং থাকবে। কমিশনের লোকবল সীমিত, সক্ষমতাও সীমিত। কিন্তু ইচ্ছাটাই গুরুত্বপূর্ণ। অভিযোগ এলে ঠিক মতো তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণের মাঝেই তাদের সদিচ্ছার যাচাই হবে। এ ক্ষেত্রে যেকোনো রাজনৈতিক অনুরাগ-বিরাগ কমিশনের ব্যর্থতারই নামান্তর।

জাতীয় নির্বাচনের পর বলা যায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হচ্ছে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। এর রাজনৈতিক তাৎপর্য অনেক। এ নির্বাচনের আচরণবিধি নিয়ে আমাদের মেয়র প্রার্থী এমনকি কমিশনারদেরও কোনো মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হয় না। আচরণবিধি লঙ্ঘনের খরব আসছে গণমাধ্যমে। নাগরিক হিসেবে আমাদের আচরণবিধি এই আকালের কালে নির্বাচনী আচরণবিধির বয়ান আদর্শবাদী রাজনৈতিক দর্শনের ইঙ্গিতবটে, কিন্তু এর শতভাগ বাস্তবায়ন আশা করা যায় না। আমরা নির্বাচনী আচরণবিধির বাস্তবায়ন চাই। কিন্তু তারচেয়েও বেশি চাই একটি শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। নির্বাচনী প্রচারের শব্দ সন্ত্রাস সহ্য করা যায়, কিন্তু মাথাফাটাফাটি, ফাঁকা গুলি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের লক্ষণ না। এসব ভোটারদের ভোটকেন্দ্র থেকে আরও দূরে সরিয়ে নেবে। নির্বাচন কমিশন পাজা কোল করে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যাবে না একথা সত্যি, কিন্তু আমভোটাররা যাতে শতভাগ ভোট বিমুখ হয়ে না যান সে বিষয়টি দেখা কমিশনের কাজ। ভোটের দিন মারামারি,কাটাকাটি হলে ভোটাররা ভোট দিতে যাক বা না যাক, তাদের মনেও শান্তি থাকে না। সেদিন পাবলিকরা অন্তত ঘরে বসে যাতে শান্তিতে খিচুরি গরুর মাংস খেতে পারে সেই রকম একটা নির্বাচনী পরিবেশ চায়।

আচরণবিধির সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। সেটি আছে কি নেই তা নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই, কোথায় কোন মাইকের শব্দ একটু বেশি হলো, প্রচারণার নির্ধারিত সময়ের সাড়ে সাত মিনিট পরেও কেন মাইক বাজলো তা নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। এদিকে আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে কে ব্যবস্থা নেবে- ম্যাজিস্ট্রেট না পুলিশ তা নিয়ে চলছে ঠেলাঠেলি।

আইনে আছে কোনো প্রার্থী বা তার পক্ষের কেউ আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ছয় মাস কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। প্রার্থিতা বাতিলও হতে পারে। কমিশন কয়েকজনকে জরিমানা করেছে। ধমকও দিয়েছে কয়েকজনকে। আমাদের মনে রাখতে হবে, নির্বাচন কমিশনেরও সীমাবদ্ধতা আছে। তাদের লোকবলের সংকট আছে। সংকট আছে আরও অনেক কিছুর। কাজেই সাধারণ মানুষ ও প্রার্থীরা যদি সহযোগিতা না করেন তবে তাদের পক্ষে শতভাগ আচরণ বিধির বাস্তবায়ন সম্ভব না।

নির্বাচনে প্রতিদ্বিন্দ্বতাপূর্ণ পরিবেশই বড় কথা। সেয়ানে সেয়ানে লড়াই হলে পাবলিকের পয়সা উসুল হয়। এখানে লড়াইটা সেয়ানে সেয়ানেই হচ্ছে। রেফারিংটা কেমন হচ্ছে এখন সেটাই দেখার বিষয়। যদিও আগের নির্বাচনে দুই করপোরেশনেই হেভিওয়েট প্রার্থীরা নির্বাচন করেছেন। মাহি, সাকি, রনি ও রতনের মতো প্রার্থীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। এবারের প্রার্থীদেরও রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো। দুই দলেই রয়েছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা।

মেয়র প্রার্থীরা তাদের ইশতেহার দিয়েছেন। মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ইশতেহার দিয়েছেন। আরও অনেকেই দিয়েছেন, দেবেন। জনগণ বিশ্বাস করতে চায় সবগুলো না হলেও কিছু অন্তত বাস্তবায়ন হবে। সবকিছু যাতে ফাঁকা বুলি না হয়। ভোটের মাঠে বন্ধ হোক ফাঁকা গুলি, ফাঁকা বুলি।

এরশাদুল আলম প্রিন্স: কলামিস্ট

এ সম্পর্কিত আরও খবর