নির্বাচনে আস্থা ফিরুক, জয় হোক গণতন্ত্রের

, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-24 12:35:30

আহ! টানা ২০ দিনের প্রচারণার সাইক্লোন শেষে নির্বাচন সমুদ্র এখন শান্ত। রাত পোহালেই ভোট, এটা যতটা স্বস্তির; তারচেয়েও বড় স্বস্তি কান ঝালাপালা করা প্রচারণা নেই। বরাবরই নির্বাচন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উৎসব। তবে অনেকদিন ধরে সেই উৎসব রঙ হারিয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের অভাবে। কখনো বয়কটে, কখনো কারচুপিতে, কখনো কৌশলে একতরফা নির্বাচন দেখতে দেখতে মানুষ নির্বাচনের আবহটা ভুলেই গিয়েছিল। অনেকদিন পর জমজমাট নির্বাচনী প্রচারণা দেখে নগরবাসী তাই ভড়কে গিয়েছিল। আমরা ভুলে গেলেও নির্বাচনী প্রচারণা কিন্তু এমনই। বিশেষ করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রচারণাটা একটু বেশিই হয়। কারণ মেয়রের পাশাপাশি কাউন্সিলর এবং মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থীরাও মাঠে থাকেন। তাই প্রচারণায় জট লেগে যায়। এমনও হয়েছে, একই মোড়ে ৪/৫ প্রার্থীর মাইক বাজছে, কিন্তু ভোটাররা কিছুই বুঝতে পারছে না। অনেকদিনের অনভ্যস্ততায় শব্দদূষণে কানের একটু কষ্ট হয়েছে বটে, তবে পুরো বিষয়টা আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে। প্রার্থীরা যদি যুগের সাথে তাল মিলিয়ে প্রচারণায় আরো স্মার্টনেস, সৃজনশীলতা দেখাতে পারতেন; ভালো লাগতো। যারা পাশ করার আগেই পোস্টারে আকাশ ঢেকে দিচ্ছে, লেমিনেটেড পোস্টার পরিবেশ দূষণ করছে; পাশ করলে তারা কী করবে কে জানে।

নির্বাচনী প্রচারণার সময় আচরণবিধি লঙ্ঘনের এন্তার ঘটনা ঘটেছে। নির্বিষ নির্বাচন কমিশন টিনের চশমা চোখে দিয়ে বসেছিল, কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। প্রচারণার শেষ দিনে মহানগর আওয়ামী লীগ মুজিববর্ষের নামে বিশাল র‍্যালি করেছে। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী যেমন ছিলেন, ছিলেন মন্ত্রী-এমপিরাও। এটা স্পষ্টতই নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন। আসলে নির্বাচনী র‍্যালি, নাম দেয়া হয়েছে মুজিববর্ষের। এটা আসলে অপকৌশল। প্রচারণার সময় তাবিথ আউয়াল ও ইশরাক হোসেনের মিছিলে হামলা হয়েছে। তারপরও এ কদিন যা হয়েছে, আমার কাছে তা দারুণ লাগছে। হারিয়ে যাওয়া উত্তাপ আবার ফিরে এসেছে নির্বাচনের মাঠে।

নির্বাচনী প্রচারণা মোটামুটি শান্তিপূর্ণ হওয়ার কৃতিত্ব অনেকটাই প্রার্থীদেরও। দুই সিটির মূল চার প্রার্থীই পরিচ্ছন্ন ইমেজের। অন্তত তিনজন দ্বিতীয় প্রজন্মের। সবাই শিক্ষিত, রুচিবান। তাই তো তাপস ভোট চাইতে যান ইশরাকের বাসায়; ইশরাকও আওয়ামী লীগের কর্মীদের কাছে ভোট চান। আতিকুল ইসলাম হাসিমুখে মির্জা ফখরুলের কাছে আশীর্বাদ চান। এই সৌহার্দ্যের আবহে আড়াল হয়ে যায় টুকটাক সংঘর্ষ, আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকারি দল উভয়সঙ্কটে থাকে। তাদের পক্ষে একটা পয়েন্ট থাকলে, বিপক্ষে দশটা। পক্ষে সবচেয়ে বড় যুক্তি হলো সরকারি দলের মেয়র জিতলে কাজ বেশি হবে। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, তার প্রভাব পড়তে পারে ভোটের বাক্সে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হারলে বিএনপি বলবে, এই যে প্রমাণিত হলো তারা জনবিচ্ছিন্ন। আর জিতলে বলবে কারচুপি হয়েছে। অবস্থাটা এমন আওয়ামী লীগকে হেরে প্রমাণ করতে হবে নির্বাচনে কারচুপি হয়নি।

এদিক দিয়ে বিএনপি অনেক নির্ভার। তাদের কোনো দায় নেই। সবার শঙ্কা বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবে কিনা। বিএনপি প্রার্থীদের তাই বারবার অঙ্গীকার করতে হয়, আমরা শেষ পর্যন্ত থাকবো।

তবে আমার বিবেচনায় এই নির্বাচন থেকে বিএনপি যা চেয়েছিল, তারচেয়ে অনেক বেশি ইতিমধ্যে পেয়ে গেছে। গোটা শহরে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে দারুণ উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে। শেষ কবে তারা এমন নিশ্চিন্তে বুক ফুলিয়ে ঘুরতে পেরেছে, তা গবেষণার বিষয়। ইশরাকের র‍্যালিতে যত লোক হয়েছে; বেগম জিয়ার মুক্তির দাবিতে তার এক হাজার ভাগের একভাগও হয় না। গুমহীন শহরে বিএনপি নেতাকর্মীরা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ঘুমহীন রাত কাটাচ্ছে। আওয়ামী লীগ যেমন নির্বাচনী র‍্যালিকে মুজিববর্ষের র‍্যালি বানিয়ে ফেলেছে। বিএনপিও তেমনি নির্বাচনী মিছিলকে বেগম জিয়ার মুক্তির মিছিল বানিয়ে ফেলেছে। আগেই বলেছি, এই নির্বাচন থেকে বিএনপি যা পেতে চেয়েছে, এরইমধ্যে তারচেয়ে বেশি পেয়ে গেছে। এখন যা পাবে তা বোনাস। সেই বোনাসটাও যেন তৈরি। বিএনপি প্রার্থী জিতলে বলবে, সরকার গণবিচ্ছিন্ন; হারলে বলবে কারচুপি। যাই বলুক, আগে তো শেষ পর্যন্ত থাকুক মাঠে।

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে তাদের প্রার্থীর জয় অবশ্যম্ভাবী। বিএনপিও তাদের প্রার্থীর জয় দেখছে। তবে কে জিতবে? সাধারণ মানুষের কাছে এই প্রশ্ন করলেই তারা শুরু করে, যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়...। নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে এই সংশয় আওয়ামী লীগের মত দলের জন্য গ্লানির। অনেক বছর আওয়ামী লীগ হারতে ভুলে গেছে। আগেই বলেছি, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, এটা প্রমাণ করতে যেন আওয়ামী লীগকে হারতে না হয়। আবার পরাজয়কে গ্রহণ করার, মেনে নেয়ার ঔদার্যটাও আওয়ামী লীগকে অর্জন করতে হবে। আওয়ামী লীগ শিবিরে নির্বাচন সম্পর্কে একটা কথা চালু আছে- মানুষকে ভুল করতে দেওয়া যাবে না। এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে, জনগণের আরো কাছে যেতে হবে। মানুষ যাতে, ঠিকভাবেই কেন্দ্রে গিয়ে আওয়ামী লীগকেই ভোট দেয়; তার জন্য কাজ করতে হবে।

কে জিতবে? এই প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে ১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায়। যেহেতু ইভিএমে ভোট, তাই ফলাফল পেতে বেশি দেরি হবে না। আওয়ামী লীগ জিতুক বা বিএনপি; শেষ পর্যন্ত যেন গণতন্ত্রের জয় হয়। গণতন্ত্র, নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর মানুষের হারিয়ে যাওয়া আস্থা ফিরিয়ে দিতে হবে। মানুষ যেন কেন্দ্রে যায়, মানুষ যেন ভুল না করে।

 

প্রভাষ আমিন: হেড অফ নিউজ, এটিএন নিউজ

এ সম্পর্কিত আরও খবর