দেশ বাঁচবে, যদি বাঁচে নদী

, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স | 2023-08-27 23:10:56

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী হওয়ায় মানচিত্রের উপর দিক থেকে আসা নদীগুলো বাংলাদেশের ভূখণ্ড দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। সে কারণেই নদী বাংলাদেশে জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ফলে সক্রিয় জোয়ার-ভাটা ছিল দেশের নদীগুলোতে। শুষ্ক মৌসুমে বেশিরভাগ নদীতেই আজ আর জোয়ার-ভাটা দেখা যায় না। কেবল সাগরের নিকটবর্তী নদীগুলোতেই জোয়ার-ভাটা দৃশ্যমান। যতোই মানচিত্রের ঊর্ধ্বমুখী হওয়া যায় ততোই নদীর শুষ্কতা বাড়ে।

দেশের বড় বড় নদীগুলোও আজ শুষ্ক বা মৃতপ্রায়। ফলে বাংলাদেশের নদীমাতৃক যে চিরন্তন জীবনযাত্রা ছিল তা আজ আর নেই। পরিবর্তন এসেছে এ দেশের নদীমাতৃক মানুষের জীবনে। নদীর ওপর জীবিকার নির্ভরতা হয়তো আজ কমেছে। মানুষকে বিকল্প জীবনযাত্রার সন্ধান করতে হয়েছে বাধ্য হয়েই। কিন্তু নদীর ওপর জীবনের যে নির্ভরতা তা কি কমেছে?

আসলে নদীর অভাব-অনুপস্থিতিটা এখনও ততোটা দৃশ্যমান হয়তো নয়। তবে যখন দৃশ্যমান হবে তখন আর আমাদের কিছুই করার থাকবে না। এটি শুধু নদীর ক্ষেত্রেই নয়, পরিবেশ ও প্রকৃতির অপরাপর সব সম্পদের বেলায়ই এ কথা সত্য। আমরা গাছের প্রয়োজনীয়তা বুঝি না, কিন্তু যখন দেশ বৃক্ষশূন্য হবে তখন আমাদের আর কিছু কি করার থাকবে?

প্রকৃতি ও পরিবেশের উপাদান ও সম্পদের ক্ষয় ও বিনাশের একটি সহনীয় মাত্রা আছে। সে মাত্রা অতিক্রম করলে সে সম্পদকে আর বাচাঁনো যায় না। কাজেই পরিচর্যা ও যত্ন নিতে হয় সময় থাকতেই। মরুকরণ একবার শুরু হলে তখন আর তাকে ঠেকানো যায় না। নদী একবার মারা গেলে তাকে আর বাঁচানো যায় না। কাজেই নদীর জীবন থাকতেই তার যত্ন নিতে হয়। হাইকোর্ট বলেছে, নদীর জীবনসত্তা আছে। প্রাকৃতিকভাবেও কথাটি সত্য। সে কারণেই নদী অতিমাত্রায় অত্যাচার সহ্য করতে পারে না। তাকে ভিন্ন পথে চলতে বাধ্য করা যায় না। তাকে শাসন করা যায়, কিন্তু কারো শোষণ সে মানে না। পানির অপর নাম জীবন—কথাটি শুধু মানুষের জন্যই সত্য নয়, নদীর জন্যও। কিন্তু আমরা পানির এ মহা উৎসের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে জীবনের জয়গান গাইতে চাই—নদী তা কেন মেনে নেবে? নদীর এক কথা, আমি মরলে হে মানুষ তোমাকেও বাঁচতে দেব না। পানির জন্য আজ যে বৈশ্বিক হাহাকার, তা প্রকৃতিরই প্রতিশোধ মাত্র।

বাংলাদেশ নদীর দান। এই দেশের প্রতিটি প্রাচীন শহর, বন্দর, বাজার, জনবসতি গড়ে উঠেছে নদীর পাশে। ধীরে ধীরে তা বিস্তৃত হয়েই আজকের বাংলাদেশ। কিন্তু আজ আমরা সে অতীত ভুলে গেছি। নদীর প্রতি আমাদের ন্যূনতম কৃতজ্ঞতাবোধও আজ আর নেই। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে যারা নদীর ওপর বেশি নির্ভরশীল, মনে হচ্ছে তারাই নদীর প্রতি বেশি নির্যাতনকারী। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, তুরাগ, বালু নদীর তীরে গেলে এ নির্মমতা চোখে পড়ার মতো। শুধু ঢাকা নয়, দেশের সব নদীই আজ ময়লা ফেলার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। যানবাহন, কলকারখানা, ড্রেন, স্যুয়ারেজ—সব ময়লার শেষ গন্তব্য নদী। সেই সঙ্গে আছে দেশের বিশেষ কিছু নদীখেকো মানুষ। এরা আবার সমাজের দাপুটে রুই-কাতলা, রাঘববোয়াল। ক্ষমতার বিভিন্ন স্তরে রয়েছে তাদের যোগাযোগ ও অংশীদারিত্ব।

রাষ্ট্র ও সরকার যে একেবারে বসে আছে তা নয়। নদীর দখল-দূষণ রোধে সরকার ও নদী সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ নিতে দেখা যায়। মাঝে মাঝে কিছু উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। কিন্তু ক’দিন পরেই আবার আগের অবস্থা। দেশে বিআইডব্লিউটিএ আছে, আছে নদী কমিশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ইত্যাদি। কিন্তু নদীর যে দুরাবস্থা তাতে ওই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সীমিত ক্ষমতা ও সক্ষমতা দিয়ে পেরে উঠছে বলে মনে হয় না। সেই সঙ্গে সীমিত শক্তি ও জনবল দিয়ে যতটুকু করার তাও করার মতো দৃঢ় মনোবল তাদের আছে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। অন্তত কাজে কর্মে সেটা দৃশ্যমান নয়।

নদী দখল একটি বড় সমস্যা সন্দেহ নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষ যারা নদী দখল করে না, বা করলেও একটি ধমক দিলে উঠে যায় তারাও কি নদী দূষণের জন্য কম দায়ী? বুড়িগঙ্গা নদীতে গেলে দেখা যায় নদী দূষণের মচ্ছব। দুই পাশের মিল, কলকারখানার সব আবর্জনা ফেলা হয় নদীতে। সদরঘাট, সোয়ারিঘাটের আড়তের সব ময়লা যায় বুড়িগঙ্গায়। অসংখ্য ছোট বড় নৌযানের সব আবর্জনা মিশে যায় নদীতে। সচিবালয় আর কড়াইল বস্তির মলমূত্র-গন্তব্য একই; বুড়িগঙ্গা। প্রয়াত শিল্পী ভুপেন হাজারিকার গান—‘গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা’। নদী মা। তাই সব ময়লা ওই মায়ের কোলে। এভাবেই আমাদের বেড়ে ওঠা!

সকাল অথবা সন্ধ্যায় সদরঘাট-সোয়ারিঘাটে গেলেই দেখা যাবে একেকটি বিশাল বিশাল লঞ্চের যাত্রীদের সৃষ্ট সব আবর্জনা ফেলা হচ্ছে নদীতে। একটিবারও নিজের বিবেক বুদ্ধি খাটায় না মানুষগুলো। যারা নদীর আশপাশে বাস করে, যারা এখনও নদীর ওপর নির্ভর করেই জীবিকা নির্বাহ করে তারাও এই কাতারে শামিল। বুড়িগঙ্গায় আজ পানি নেই। এক বুক বিষ নিয়ে বয়ে চলছে ঐতিহ্যের বুড়িগঙ্গা।

এর একটাই কারণ, মানুষের ন্যূনতম সচেতনতা নেই। নদীকে ঘিরে আমাদের কোনো সচেতনতামূলক কার্যক্রমও চোখে পড়ে না। নদী দূষণের বিরুদ্ধে কোনো এনজিওর কাজ তেমন চোখে পড়ে না। নদীর জন্য কারো বাজেট নেই, সময় নেই। ‌বিআইডব্লিউটিএ, নদী কমিশন তারা ব্যস্ত তাদের রুটিন কাজে।

সাধারণ মানুষের সচেতনতা ছাড়া নদীর উন্নয়ন তো পরের কথা, রক্ষাও সম্ভব নয়। নদীর ব্যবহারকারীরাই নদীকে রক্ষা করতে পারে। সরকার, নদী কমিশন, বিআইডব্লিউটিএ পুরো দেশে বিস্তৃত নদী পাহারা দিয়ে রাখতে পারবে না। কিন্তু তারা মানুষকে সচেতন করতে পারে। দেশের গণমাধ্যমগুলো শুধু অভিযানের খবর প্রচার করেই দায়িত্ব খালাস। একসময় বিটিভিতে সচেতনামূলক নানা ধরনের প্রচারণা দেখা যেতো। আজ কোনো চ্যানেল বা গণমাধ্যমেই সচেতনামূলক কোনো কন্টেন্ট চোখে পড়ে না। সবাই সবার এজেন্ডা নিয়ে ব্যস্ত। বেশি উন্নয়নের এই এক সমস্যা—বাইরে সব ঠিকঠাক, ভেতরে সোয়ারিঘাট! উন্নয়নে রাস্তাঘাট যেমন দরকার, নদীও দরকার। পানি যেমন দরকার, তেমনি দরকার দূষণমুক্ত বায়ু। ফ্লাইওভার-এক্সপ্রেসওয়ে যেমন দরকার, তেমনি দরকার খাল-বিল-জলাশয়।

তাই মানুষকে সচেতন করে উন্নয়নে তাদের কাজে লাগাতে হবে। তবেই বাঁচবে নদী, মানুষ। হবে টেকসই উন্নয়ন। নদী রক্ষায় নদী বন্দর এলাকায় সার্বক্ষণিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাতে হবে, মাইকিং করতে হবে, হাতে পায়ে ধরে নদীতে যাতে ময়লা না ফেলে সে কথা বলতে হবে। এই সব এলাকায় নদীর দুই পাড় দখলমুক্ত রাখতে হবে। প্রশাসনকে শক্ত হতে হবে, একই সঙ্গে সহজ সুন্দরভাবে সচেতনতামূলক কার্যক্রমও চালাতে হবে। আবর্জনার গন্তব্য যাতে নদী না হয় সে ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে হবে। শুধু মিডিয়া ডেকে আধা বেলার সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে নদী বাঁচানো যাবে না। কারণ দখল-দূষণকারীরাও জানে যে অভিযানের পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তারপরও আমাদের নদীগুলোকে বাঁচাতে হবে। আমরাও বেঁচে যাব, যদি বাঁচে আমাদের নদীগুলো।

এরশাদুল আলম প্রিন্স: আইনজীবী ও লেখক

এ সম্পর্কিত আরও খবর