আম আদমির দিল্লী জয় রাজনীতির ‘নয়াবার্তা’

, যুক্তিতর্ক

শুভ কিবরিয়া | 2023-09-01 23:37:43

ভারতীয় রাজনীতির উত্তাপ ছড়ানো দিল্লী বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল এখন প্রকাশ্য। ভোট শেষে বুথ ফেরত সমীক্ষাকে সত্য প্রমাণ করে ভারতীয় রাজনীতির বিষ্ময় অরবিন্দ কেজরিওয়ালের উন্নয়নের ওপর ভরসা রাখলো দিল্লীবাসি। তৃতীয়বারের মত দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন কেজরিওয়াল।দিল্লীর বিধানসভা নির্বাচনকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিল কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি এবং মোদি গং। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহসহ ভারতীয় সংসদ লোকসভার ২৭০ জন এমপি এই নির্বাচনে দিল্লীর অলিগলি চষে বেড়িয়েছেন, আম আদমি পার্টিকে পরাজিত করতে। বিজেপির যে নির্বাচনি স্ট্রাটেজি বিশেষ করে হিন্দুত্ববাদকে উসকে দেওয়া, হিন্দু মুসলমান বিভেদ টেনে আনাসহ সকল সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল ক্যাম্পেইন এবারেও সচল ছিল।কিন্তু শেষাবধি সেসব দিল্লীবাসির মন জয় করতে পারে নাই। দিল্লীবাসি জাতীয় রাজনীতির নানান বিভেদাত্মক ও হিংস্র ইস্যুকে গুরুত্ব দেয় নাই। তারা গুরুত্ব দিয়েছে তাদের দৈনন্দিন জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পানি, বিদ্যুত, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষার মত ইস্যুগুলোকে।

দিল্লী ভারতের রাজধানী। সেখানে লোকসভার ০৭ টি আসন বিজেপির দখলে। পৌরসভাসহ অন্যান্য নির্বাচনেও জিতেছে বিজেপি। কেন্দ্রিয় সরকারের ক্ষমতা বিজেপির হাতে। পুলিশ, প্রশাসন, মিডিয়ার বড় অংশ বিজেপির দিকেই হেলানো।তার মধ্যেই একক লড়াই চালিয়েছেন কেজরিওয়াল এবং তার সহযোগিরা গত পাঁচ বছর ধরে দিল্লী শাসনে। এবারের নির্বাচনে বিজেপি ছিল জিততে মরিয়া। দিল্লীর বিধানসভায় ৭০ টি আসনে গতবার বিজেপি পেয়েছিল ০৩ টি আসন। এবার তারা পেয়েছ ০৭ টি আসন। তাদের আসন ও ভোট দুটোই কিছুটা বেড়েছে।

অন্যদিকে ২০১৫ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টি পেয়েছিল ৬৭ টি আসন। এবার তারা পেয়েছে ৬৩ টি আসন। তাদের আসন কমেছে ০৪ টি। এবারের নির্বাচনে আমআদমি পার্টি ৫৪%, বিজেপি ৪০% এবং কংগ্রেস ৪% ভোট পেয়েছে।

এই নির্বাচনে দুটি দিক খুব লক্ষ্যণীয়।

প্রথমত, ভারতীয় ক্ষমতাকেন্দ্রের মধ্যে বসে, ভারতের সবচাইতে ক্ষমতাধর বিজেপিকে ধরাশায়ি করা আম আদমি পার্টির জন্য এক বড় অর্জন। দ্বিতীয়ত সকল চাপের মধ্যেও জাতীয় রাজনীতির বাইরে এসে স্থানীয় ইস্যুকে মুখ্য করে জনগণের মনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারার আম আদমি পার্টির নির্বাচনি কৌশল। শুধু তাই নয় দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন উপহার দিয়ে, জবাবদিহি মুলক শাসন উপহার দিয়ে আম আদমি পার্টি যে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে সেই অর্জনগুলো জনগণকে আবারও বোঝাতে সক্ষম হয়েছে তারা।

এখন দেখা যাক কেজরিওয়াল কি উপহার দিয়েছে দিল্লীবাসিকে এবং তার নির্বাচনি প্রতিশ্রুতিই বা কি ছিল?

এক. বিষ্ময়কর হলেও সত্য দিল্লীর আমজনতার একটা বড় অংশের মন জয় করতে পেরেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল তার কাজের মধ্য দিয়ে। নির্বাচনে তিনি সেই কথাগুলোই বলেছেন বারবার।পাঁচ বছরে দিল্লিতে সরকারি স্কুলের চেহারা কিভাবে তিনি বদলে দিয়েছেন, কিভাবে বিনামূল্যে খাবার পানি সরবরাহ করা শুরু করেছেন, দিল্লীর সরকার ২০০ ইউনিট করে বিদ্যুৎ বিনামূল্যে দেওয়া শুরু করার পর থেকে কিভাবে হাজার হাজার পরিবারকে আর বিদ্যুতের বিলই দিতে হচ্ছে না, কী ভাবে মহল্লা ক্লিনিকে বিনাব্যয়ে চিকিৎসা এবং ওষুধ মিলছে, সরকারি বাসে মহিলাদের বিনাভাড়ায় চলাচলের সুবিধা দেওয়ার ফলে কত জন উপকৃত হয়েছেন, বাসে মার্শাল নিয়োগ করে এবং রাজধানীর পাড়ায় পাড়ায় সিসিটিভি লাগিয়ে কিভাবে মহিলাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন— কেজরিওয়াল সেই কাজের কথাই স্মরণ করে দিয়েছেন ভোটারদের।নির্বাচনে জিতলে এসব চলমান সুবিধা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন তিনি।

তার সাথে দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন অব্যাহত রাখার নিশ্চয়তাও ছিল কেজরিওয়ালের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে।

দুই. আম আদমি পার্টির জন্ম হয়েছিল ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণার মধ্যে দিয়ে। তারপর অনেক উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও কথা ও কাজে তারা এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথ থেকে সরেন নাই। জাতীয় রাজনীতির নানান ইস্যুতে কথা বললেও স্থানীয় ইস্যুগুলোকেই তারা মুখ্য হিসাবে রেখে কাজ করে গেছেন। দিল্লীতে তাদের বড় সাফল্য অতীতে বহুবার দিল্লীশাসন করা কংগ্রেস দলকে তারা ভোটের মাঠ থেকে সম্পূর্ণ প্রতিস্থাপিত করতে পেরেছেন। অন্যদিকে , দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে অরবিন্দ কেজরিওয়াল সাধাসিধে, সরল জীবনযাপন করা জনহিতৈষি, দুর্নীতিমুক্ত নিজের যে ইমেজ দাঁড় করিয়েছেন, তার বিপরীতে দিল্লীর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি বা কংগ্রেস তেমন একক কোন মুখ ভোটারদের সামনে হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছে।সেটাই এই নির্বাচনে অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে অনেকটা এগিয়ে রেখেছে।

০২.

বিজেপির এই নির্বাচনি ফলাফলকে কিভাবে দেখা যায়? এক অর্থে বিজেপি এই নির্বাচনে যে আওয়াজ তুলেছিল সেই অর্থে ভালো করতে না পারলেও গত বিধানসভার নির্বাচনের তুলনায় ভালো করেছে। ভোটের সংখ্যায় এবং বিধানসভার সিটের সংখ্যায় ২০১৫ সালের হিসাবে তারা ভালো করেছে। নির্বাচনী মাঠ থেকে আম আদমি পার্টির প্রতিদ্বন্দ্বি হিসাবে কংগ্রেসকে তারা মাঠছাড়া করেছে।কিন্তু এই নির্বাচনে বিজেপি যে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে তার তুলনায় এই ফলাফল খুবই হতাশাজনক। গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র ২৭০ জন এমপি, ৭০ জন ইউনিয়ন মিনিষ্টার, বিজেপির সকল রাজ্যনেতা এই নির্বাচনে মাঠ চষে বেড়িয়েছেন। মোদি-অমিতশাহ জুটিও মাঠে ছিলেন।

বিজেপি অতীতে যেভাবে নির্বাচনে ভালো ফল পেয়েছে সেই হিন্দু ইস্যু, পাকিস্তান বিরোধিতা এবং সন্ত্রাস ইস্যুকে মাঠে নামিয়েছে। তারা কেজরিওয়ালকে পাকিস্তানের চর এবংসন্ত্রাসবাদি আখ্যা দিয়েছে। বিজেপি বলেছে, ‘যদি তুমি হিন্দু হও, তাহলে বিজেপিকে ভোট দাও’। এই নির্বাচনের সময় দিল্লীর শাহিনবাগে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি), জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্টার (এনপিআর)-বিরোধি যে লাগাতার বিক্ষোভ হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে তার পেছনে আম আদমি পার্টির হাত আছে বলে গোটা নির্বাচনে জিগির তুলেছে বিজেপি। ভোটাররা তাতে সাড়া দেয় নাই।

উন্নয়ন বা জনকল্যাণমূলক ইস্যুতে না গিয়ে নরেন্দ্র মোদি গং জাতীয় রাজনীতির বিভাজনের নোংরা ও সাম্প্রদায়িক কার্ড খেলতে চেয়েছে। ভোটাররা তাতে মত দেয় নাই। বিজেপির বিরুদ্ধে সমগ্র মুসলিম ভোট এবার ভর করেছে আম আদমি পার্টির ঝাড়ু প্রতীকে। স্থানীয় ইস্যুর কাজে আম আদমি পার্টির সফলতায় বিজেপি এবং কংগ্রেস দল করা অনেক ভোটারের ভোটও পেয়েছে কেজরিওয়াল গং। নির্বাচনের আগে কেজরিওয়াল এই দুই দলের সমর্থকদের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেছিলেন, দল ছাড়তে হবে না, উন্নয়নের ইস্যুতে আম আদমি পার্টিকে ভোট দিন। তার সেই আহবানেও সাড়া মেলেছে। ভোটে জেতার পর এক টুইটারে অরবিন্দ কেজরিওয়াল দিল্লীবাসীর উদ্দেশ্যে লিখেছেন, ‘ছেলেকে এত ভালবাসা দেওয়ার জন্য মন থেকে দিল্লীবাসীকে ধন্যবাদ জানাই। আজ নতুন ধরনের রাজনীতির জন্ম দিয়েছেন দিল্লীর মানুষ, যা হল কাম কি রাজনীতি। এই জয় ভারত মাতার জয়। জয় হিন্দ।’

০৩.

এটা পরিষ্কার বিজেপির ‘হিন্দুকার্ড’ দিল্লীতে এবার ফেল মারল।এবার তাদের নতুন স্ট্রাটেজি নিতে হবে। শুধু ধর্মের জিগিরে বিজেপির আগামী কতটা নিশ্চিত হবে, তার একটা রেড সিগন্যাল দিল্লীর এই রায়। একসময় উন্নয়নের ‘গুজরাট মডেল’ বিক্রি করে চা ওয়ালা মোদি ভারতের ক্ষমতায় এসেছিলেন। হালে সেই উন্নয়ন আওয়াজ যতটা কমেছে ধর্মীয় জিগির আর হিন্দুস্তানি আওয়াজ ততটা বেড়েছে। এই আওয়াজের ক্ষমতার একটা সীমা আছে। নরেন্দ্র মোদি গং সেই সীমা অতিক্রম করে ফেলেছেন। দিল্লীর বিধানসভা নির্বাচন তার একটা নমুনা মাত্র। অন্যদিকে ভারতীয় রাজনীতির প্রগতিবাদের দিশারি কংগ্রেস যে দিনকে দিন নিজেই দিশা হারিয়ে ফেলছে এই ভোট তারও একটা ইংগিত দেয়। অন্যদিকে মানুষের জন্য কাজ করলে, মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধানে প্রকৃতই মনোযোগি হলে যে ভোটারদের সমর্থন মেলে, অরবিন্দ কেজরিওয়াল গংয়ের এই সাফল্য তার প্রমাণ।সততা, জনমুখিনতা, বাস্তববাদি রাজনীতি যে ব্যর্থ হবার নয় দিল্লীর ভোটের জনরায় সেই কথাও প্রমাণ করে। ফলে দিল্লীর এই এক ভোট অনেক বার্তা দেয়। রাজনীতিবিদরা তা থেকে কতটা শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতমুখিন হতে পারেন সেটাই এখন বিবেচ্য। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আট বছর বয়সী এই নয়ারাজনীতি দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন রাজনীতির সূচনা করলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না।

শুভ কিবরিয়া: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর