ছাত্রজীবন পেশাগত জীবনের উপকরণ মাত্র

, যুক্তিতর্ক

মুত্তাকিন হাসান | 2023-08-31 02:16:23

জীবনের সবচেয়ে ভালো সময়টুকু কাটে ছাত্র জীবনে, যেন পড়ালেখা ও আড্ডাবাজি ব্যতিত সবকিছুই মূল্যহীন। তৃপ্তির আবহে আবর্তিত সারাক্ষণ। এ বয়সে নিজের মনের গভীরে ডুব দিয়ে খুঁজি কোথায় আনন্দ পাওয়া যায়। জীবন হয়ে যায় সরল রেখা, বক্রতা আর পাই না। সে সময় ভবিষ্যৎ নিয়ে একটাই আগ্রহ থাকে- কীভাবে ভালো রেজাল্ট করা যায়। বাবা-মায়ের চোখে আনন্দ তুলে দেওয়া যায়।

আমরা অন্ধের মতো পড়ালেখা করে যাই। অন্ধের মতো পড়ালেখা করে কখনোই বেশি দূরে যাওয়া যায় না। কারণ শিক্ষাকে উপকরণ করে পরবর্তীতে যে পেশাগত জীবনেই যাই না কেন দরকার কৌশলী হওয়া। তা না হলে দীর্ঘ এ শিক্ষা জীবনের শিক্ষাটাই বৃথা। তাই ভালো রেজাল্ট করে অনেকেই ভালো চাকরি পায় না বা চাকরি পেলেও কৌশলগত অজ্ঞতার কারণে পেশাজীবনে ভালো করতে পারে না।

এমন একজনকে আমিও সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলাম। তিনি নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি কৃতিত্বের সাথে পাশ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স করেন। ইংরেজীতে কথা বলা থেকে শুরু করে লেখায় খুবই পারদর্শী। মানুষ হিসেবেও ভালো, কিন্তু কৌশলী না হওয়ায় তার কর্মস্থলে সে প্রত্যাশিত পারফরম করতে পারেনি। তাকে কোম্পানি ছাড়তে বাধ্য হতে হয়েছে।

আসলে ভালো ছাত্র হলেই যে পেশাগত জীবনে ভালো করবে এমনটা নাও হতে পারে। তাই শিক্ষাজীবন থেকেই শিক্ষা পরবর্তী জীবনের প্রস্তুতি নিতে হবে। চাকরীদাতারা ভালো রেজাল্টের চেয়ে বেশি পছন্দ করে একজন অভিজ্ঞ ও কুশলী ব্যক্তিকে। পেশাগত জীবন সব সময়েই ছাত্রজীবন থেকে আলাদা। ছাত্রজীবনে অনেক সফল ও মেধাবী ব্যক্তিকেই পেশাগত জীবনে সাফল্য লাভ করতে দেখা যায় না। আবার ছাত্রজীবনে মেধার স্বাক্ষর রাখেনি এমন অনেকেই পরবর্তীতে পেশাগত জীবনে ব্যাপক সাফল্য লাভ করে।

করপোরেট জগত কখনোই সহজ নয়। এখানে বিভিন্ন শ্রেণীর ও বয়সের মানুষ রয়েছে। তাদের কালচার বা চিন্তা ধারাও ভিন্ন। শুধু কাজ করলেই হবে না, আশেপাশের পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে হবে।

বর্তমান যুগ হলো বিশ্বায়নের যুগ। নিজের জন্যই পুরো বিশ্বের সঙ্গে কানেক্টেড থাকা প্রয়োজন। বর্তমান যুগ হচ্ছে নেটওয়ার্কিংয়ের যুগ। আপনি কি জানেন তা নয় বরং আপনি কাকে কতটা জানেন এটাই অনেক ক্ষেত্রে বেশি জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ। জ্ঞান এক কথায় হলো পরিচিতি থাকা, কোনো কিছু সম্পর্কে বা কারো বিষয়ে জেনে থাকা বা বুঝে থাকা, হতে পারে কোনো কিছুর প্রকৃত অবস্থা, তথ্য, বিবরণ, বা গুনাবলী সম্পর্কে জ্ঞান থাকা, যেটি অর্জিত হয়েছে উপলব্ধির মাধ্যমে, অনুসন্ধানের মাধ্যমে বা শিক্ষা গ্রহণের ফলে অভিজ্ঞ হওয়ায় বা পড়াশুনা করে।

পুঁথিগত জ্ঞানের বাইরেও অনেক বিস্তৃত জ্ঞান আছে, তা বিশ্বাস করতে হবে। যুগের সাথে সঙ্গতি রেখে পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি কিছু বিশেষ দক্ষতা অর্জন করতে হবে। দক্ষতা অর্জনের অন্যতম জায়গা হলো বিভিন্ন পেশাজীবীদের সংগঠন। সংগঠনে জড়িত থাকলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বাস্তব ভিত্তিক বিভিন্ন তথ্য ও জ্ঞান বিনিময়ের পাশাপাশি নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ।

উদাহরণ হিসেবে আমি বলতে পারি, বাংলাদেশ সোসাইটি ফর হিউম্যান রিসোর্স (বিএসএইচআরএম) যেহেতু দেশের বৃহৎ মানব সম্পদ পেশাজীবীদের সংগঠন তাই এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আমি আমার চাকরির প্রয়োজনে অনেক কিছু শিখেছি এবং আমার মতো অনেক আনাড়ি আজ দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হিসেবে অধিষ্ঠিত আছে। কারণ আপনি যে ফিল্ডে কাজ করতে চান, সেই ফিল্ডের লোকদের সঙ্গে যদি আপনার চেনাজানা থাকে তাহলে আপনি সিনিয়রদের থেকে যেমন অনেক কিছু শিখতে পারবেন আবার সমসাময়িকদের কাছে থেকেও অনেক কিছু জানতে পারবেন।

পাঠ্য বইয়ের বক্স থেকে আপনাকে বের হয়ে আসতেই হবে। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় আপনাকে প্লাটফর্ম তৈরি করে দেবে, কিন্তু নিজেরটা নিজেকেই গড়ে নিতে হবে। আমাদের দেশে শিক্ষা আর পেশার মধ্যে নেই কোনো সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক। বাংলা সাহিত্য বা ইতিহাস নিয়ে পাশ করে চাকরি করতে হচ্ছে ব্যাংকে। অনেককে দেখেছি এমবিবিএস পাশ করে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পুলিশে কাজ করতে। শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কাজ করার মধ্য দিয়ে যে অধিকতর যোগ্যতা রাখা সম্ভব অন্য বিষয়ের লোকদের দিয়ে তা করা দুরহ। এমনিতেই বিসিএস-এ পরীক্ষার্থীর ভিড়ে অনেকেই হারিয়ে যায়। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার চেয়ে শিক্ষাকে কীভাবে আমাদের পেশাজীবনে কাজে লাগানো যায় সে বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে এই এলোমেলো ব্যবস্থার পরও নিজেদের ক্যারিয়ার তৈরি করার জন্য সবকিছুর সঙ্গে মিলিয়ে চলতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন হয় সব বিষয়েই সম্যক ধারণা রাখা। যেহেতু আমাদের জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটে ছাত্রাবস্থায়। বিষয়গুলো উপলব্ধির মোক্ষম সময় তখনই। ঐ সময়টুকু যদি আমরা যথাযথভার কাজে না লাগাতে পারি, বাকি জীবনটুকু হতাশা আর আক্ষেপে করতেই চলে যাবে। সাফল্যের প্রত্যাশা ঢেকে যাবে সংশয়ের মেঘে।


মুত্তাকিন হাসান: কবি, প্রাবন্ধিক ও মানব সম্পদ পেশাজীবী

এ সম্পর্কিত আরও খবর