জাতীয় নির্বাচনের আগে আখেরি লড়াই

, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | 2023-08-30 11:32:01

সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে অনেকেই জাতীয় নির্বাচনের মহড়া বলে থাকেন। সেটি অনেকাংশেই সত্য। কিন্তু সর্বাংশে সত্য নয়। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের জয়-পরাজয়ের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের জয়-পরাজয়ের অপরিহার্য কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে জনরায়ের একটি বহি:প্রকাশতো বোঝা যায়ই।

জাতীয় নির্বাচনের আরো নানা অনুষঙ্গ রয়েছে যা স্থানীয় নির্বাচনে দৃশ্যমান হয় না। তাই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচনের আগাম ফলাফল হিসেবে ধরে নেওয়া বাস্তবসম্মত নয়।

কিন্তু জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। জাতীয় দলগুলো এরই মধ্যে জোট গঠন, পুণর্গঠন নিয়ে তোড়জোড় শুরু করেছে। দফায় দফায় সৌজন্য সাক্ষাতের মহড়াও হচ্ছে। ফোনকল ও বৈঠক হয়েছে। তবে, এ মুহূর্তে কে হচ্ছেন নগরপতি সেটিই আলোচ্য। দিনশেষে জানা যাবে সে খবর।

আওয়ামী লীগ সমর্থকরা এবার নৌকার বিজয় ছিনিয়ে আনতে মরিয়া। এটিই স্বাভাবিক। তিন কর্পোরেশনেই সিটিং মেয়র বিএনপির। কাজেই পরপর দুইবার মহানগরগুলোর ক্ষমতা বিএনপির সমর্থকদের হাতে দেওয়া সমীচীন না। কিন্তু বিএনপিই বা ছেড়ে দেবে কেন? তারা ধারাবাহিক জয় প্র্রত্যাশা করবেন এটাই স্বাভাবিক। তাই এই নির্বাচন দুই প্রধান দলের কাছে জাতীয় নির্বাচনের আগে আখেরি লড়াই-ই বলা যেতেই পারে। জাতীয় নির্বাচনের আগে আপাতত আর কোনো এ সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচন নেই। কাজেই এ লড়াই শুধু প্রার্থীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, দুই প্রধান দলেরও এ মুহূর্তের এজেন্ডা।

সেই সঙ্গে জনগণও জাতীয় নির্বাচনের একটি ছাঁয়া খুঁজবেন এ নির্বাচনে। নির্বাচন কমিশনের জন্যও এটি একটি শেষ পরীক্ষাই বটে। এর আগের কমিশন সফলতা যেমন দেখিয়েছে, কিছু ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নও আছে। কাজেই জাতীয় নির্বাচনের সব অংশীজনরাই এখানে কুশীলব। আগামীতে এই কুশীলবদের কে কী ভূমিকা পালন করবে এ নির্বাচনে তারই একটা মহড়া হয়ে যাচ্ছে হয়তো।

স্থানীয় নির্বাচনে ভোটাররা এখন অনেক হিসেব-নিকেশ করেই ভোট দেন। এক দশক আগেও স্থানীয় প্রশাসনকে কেন্দ্রীয় প্রশাসন ও রাজনীতি থেকে আলাদা করে রাখা হতো। তবে, স্থানীয় সরকারকে পুরোপুরি স্বাধীনতা কেউ দেননি। তারপরও আমরা চট্রগ্রাম, রাজশাহী ও গাজীপুর সিটিতে দেখেছি ক্ষমতাসীন দলের না হয়েও মেয়ররা স্থানীয় উন্নয়নে কাজ করতে পেরেছেন। কিন্তু গত এক দশক ধরে আমরা দেখছি, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি সরকার দলের সমর্থক না হলে তিনি উন্নয়ন করতে পারেন না। তবে, এটাকে অনকে সময় অজুহাত হিসেবেও দেখাতে চান বিরোধী দলের নির্বাচিত মেয়ররা। কিন্তু তার বাইরেও বর্তমান মেয়ররা কাজতো পরের কথা তাদের মেয়াদের অধিকাংশ সময়েই কাটাতে হযেছে জেলে। তবে, বরিশালের মজিবর রহমান সরওয়ারই শুধু মেয়র ছিলেন না। বাকি দুই সিটিতে বিএনপির প্রার্থীরাই মেয়র ছিলেন। এ সময়ে তাদের জামিনের জন্য স্থানীয় আদালত থেকে উচ্চ আদালতে দৌড়াদৌড়ি করেই মেয়াদ পার করতে হয়েছে। উন্নয়নের কাজ করবেন কখন? গদিতে বসার সময়ইতো পাননি।

সিটি কর্পোরেশনে বিএনপি আর কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ থাকাতে স্থানীয় উন্নয়নে তারা তেমন অবদান রাখতে পারেননি। উন্নয়ন বরাদ্দ কেন্দ্র থেকেই হয়। সেই সাথে জেলার বা সিটি কর্পোরেশনের স্থানীয় এমপি, স্থানীয় প্রশাসন সরকারের সমর্থক হওয়ায় সেখানে বিরাজ করে এক জটিল পরিস্থিতি। এ অবস্থায় উন্নয়ন একটি সুদূর পরাহত বিষয়।

এ বিষয়টি জনগণও মেনে নিয়েছে। কাজেই সরকারকে তার সমর্থনপুষ্ট প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে আজ আর ভোট কারচুপির আশ্রয় নিতে হয় না। জনগণও জানে যে বিএনপি প্রার্থী জয়ী হলে এলাকায় উন্নয়ন হবে না। খামাখা ভোট নষ্ট করার দরকার কি? স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারকে যে আমরা কেন্দ্র থেকে আলাদা করতে পারিনিও স্বাধীনতা দিতে পারিনি জনগণের এ মনস্তত্বের এটাই কারণ। বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয় যখন দেখা যায় বিরোধী দলের কোনো শূণ্য আসনে উপনির্বাচন হলে সেখানে সরকারি দলের প্রার্থীই এমপি নির্বাচিত হন। অনেক ক্ষেত্রে এমন নজির দেখা গেছে। এক্ষেত্রে শুধু প্রার্থীর ক্যারিশমা কাজ করে তা নয়, এর সাথে জনগণের ওই Winners Take All ধারণা কাজ করে।

এবারের তিনি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি জোটের তেমন কোনো তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে না। কোনো এক অজানা কারণে বা সমীকরণে বিএনপি জোটের প্রধান শরিক জামায়াতে ইসলামী বিএনপির পক্ষে নিষ্ক্রিয়। সিলেটেতো তারা নিজেরাই প্রার্থী দিয়েছে। এটি, বিএনপি জোটের জন্য এক দুশ্চিন্তারই কারণ বটে। কারণ, এ বিষয়টি শুধু সিলেটেই সীমাবদ্ধ থাকলে এক কথা। কিন্তু এটি যদি আগামী জাতীয় নির্বাচনের ইঙ্গিতবাহী হয় তবে বিএনপির জন্য আরো বড় সংকট আসন্ন। আপাতত, জামায়াত যদিও শুধু সিলেটেই প্রার্থী দিয়েছে। কিন্তু অন্যান্য সিটিতেও জামায়াতকে বিএনপি প্রার্থীর জন্য সেভাবে কাজ করতে দেখা যায়নি।

হালে জোট গঠন ও পুণর্গঠনের যে আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, এই নির্বাচনে তার একটি মহড়া হয়তো হয়েই যাচ্ছ। বিষয়টি এমন নয় যে, আওয়ামী লীগ জামায়াতের সাথে জোট গঠন করবে। আদর্শিকভাবে তাদের অবস্থান ভিন্ন। বরং বিএনপি-জামায়ত জোট ভাঙতে পারলেই বিএনপি তার মাঠের শক্তির সিংহভাগ হারিয়ে ফেলবে। বর্তমান মাঠে বিএনপির কোনো রাজনীতি নেই। ফলে, স্থানীয় নির্বাচনের এই আপাত: ট্রায়ালটি কতটা সফল তার ওপর হয়তো অনেকটাই নির্ভর নির্ভর করবে আগামী নির্বাচনে জোটের হিসেব-নিকেশ। তিন সিটি নির্বাচনকে তাই আগামী নির্বাচনের একটি প্রাক প্রস্তুতি বলা যেতেই পারে।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বরিশালের প্রার্থীকে আওয়ামী লীগের জন্য কাজ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সে নির্দেশ তিনি পালন করেননি। এরশাদও তাকে যথারীতি বরখাস্ত করেছেন। গত জাতীয় নির্বাচনেও জাতীয় পার্টির এমন ভূমিকাই আমরা দেখেছি। তাদের দলের নেতারা কয়েক টুকরা হয়েছে। ফলে, নেতা একদিকে, কর্মীরা গেছেন আরেক দিকে। আগামী নির্বাচনেও এরশাদ বাতাসের অবস্থা বুঝেই লাঙ্গল চালাবেন সেটা বোঝাই যাচ্ছে।

নির্বাচন ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হচ্ছে নির্বাচন কমিশন। তারাই নির্বাচন পরিচালনা করে। নির্বাচন কমিশন আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করতে সক্ষম কিনা সে পরীক্ষা তারা কয়েকবারই দিয়েছেন। সেখানে পাশ-ফেল দু’টিই আছে। ফলে, এ নির্বাচনে কমিশন সফল না হলে জাতীয় নির্বাচন তারা নিরপক্ষভাবে করতে পারবেন না সেটি বলা যাবে না। এ বিষয়টি র্নিভর করে নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো কী হয় তার ওপর। সেখানে ক্ষমতার ভারসাম্য একটি বড় প্রশ্ন। তবে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য শুধু কমিশনের সদিচ্ছাই যথেষ্ট না সেটি পরিষ্কার। তবে কমিশন চাইলে অনেক কিছুই সম্ভব। এই কমিশনই কুমিল্লা ও রংপুরে ভালো নির্বাচন উপহার দিয়েছে। কিন্তু খুলনা ও গাজিপুরে তারা সফল হতে পারেনি। সিলেট, রাজশাহী ও বরিশাল তাই তাদের জন্য এক চ্যালেঞ্জই বটে। জাতীয় নির্বাচনের আগে এ নির্বাচন সবার জন্য এক আখেরি লড়াই-ই বটে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর