হোক প্রতিবাদ

, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-24 20:39:02

স্কুল ড্রেস পরা শিক্ষার্থীরা উপুড় হয়ে পড়ে আছেন, নিথর দেহ, স্কুল ব্যাগ, রঙ্গীন ছাতা এলোমেলো ছড়ানো-ছিটানো। ছবিটির দিকে আমি যতবার দেখি, সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নেই। আমি আসলে সইতে পারি না, মানতে পারি না। আমার ছেলে প্রসূনও প্রতিদিন একইরকম সাদা ড্রেস পরে স্কুলে যায়। তাকেও ব্যস্ত আসাদ এভিনিউ পেরুতে হয়। ছবিটি আমি দেখতে পারি না ভয়ে। ওল্টালেই যদি দেখি আমার সন্তান।

দেখুন, আমি কি রকম স্বার্থপরের মত ভাবছি। আমার সন্তান না হলেও দিয়া এবং রাজিব কারো না কারো সন্তান তো ওরা। দিয়ার বাসচালক বাবা সকালে মেয়েকে বাসে তুলে দিয়েছিলেন। তার মা নিশ্চয়ই টেবিলে খাবার বেড়ে মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। রাজিবের ভাগ্য অত ভালো না। বাবাহারা রাজিব ঢাকায় খালাতো ভাইয়ের বাসায় থেকে পড়াশোনা করছিল। রাজিবের সংগ্রাম আর দিয়ার স্বপ্ন থেতলে গেছে বাসের চাকায়।

সড়ক দুর্ঘটনার জন্য আমরা অনেকেই চালকদের বাঁচিয়ে পথচারীদের দায়ী করি। পথচারীদের অনেক দায় আছেও। হুট করে দৌড় দেয়া, অননুমোদিত স্থানে রাস্তা পাড় হওয়া, মোবাইলে কথা বলতে বলতে রাস্তা পাড় হওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এই শিক্ষার্থীরা তো কোনো নিয়ম ভাঙ্গেনি। তারা কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনের রাস্তায় বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল। জাবালে নুর পরিবহনের একটি বাস এলে তারা তাতে উঠতে যায়। তখন একই কোম্পানির আরেকটি বাস সেই যাত্রীতে ভাগ বসাতে বাম দিক থেকে ওভারটেক করে এসে শিক্ষার্থীদের ওপর উঠে যায়।

এটি ঢাকা বা দেশের প্রথম দুর্ঘটনা নয়। বাংলাদেশের সড়ক যেন সড়ক নয়, মরণফাঁদ। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ মারা যায়। গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা থেকে জানি বেশিরভাগ দুর্ঘটনা হয় চালকের অদক্ষতায়, অমনোযোগিতায়, খামখেয়ালিতে, প্রতিযোগিতার চেষ্টা থেকে।

দুর্ঘটনা একের পর এক ঘটছেই। কারণ গরু-ছাগল চিনেই তারা লাইসেন্স পেয়ে যায়। সেটা তো গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নয়, হত্যার লাইসেন্স। চালকরা এত বেপরোয়া, এত ড্যামকেয়ার কেন? কারণ তারা জানেন, তারা আইনের উর্ধ্বে। কোনোরকমে পালাতে পারলে তো হলোই। ধরা পড়লেও অসুবিধা নেই। মালিক ছাড়িয়ে নেবেন। আর মামলা হলেও বছরের পর বছর চলবে।

আর যদি সুষ্ঠু বিচার হয়ও সর্বোচ্চ সাজা তিনবছর কারাদণ্ড। হা হা হা। মানুষ মারার শাস্তি তিনবছর কারাদণ্ড! আপনি যদি কাউকে খুন করতে চান, খুনী ভাড়া না করে বাসচালক ভাড়া করুন। গুলি করে মারলে খুনীর ফাঁসি হবে, বাসচাপা দিয়ে মারলে হবে তিনবছরের কারাদণ্ড। তবে সর্বোচ্চ সাজা তিন বছরের কারাদণ্ড হলেও অসুবিধা নেই, শাজাহান খান আছেন না। তিনি পড়ে পদে চালকদের বাঁচিয়ে দেবেন। আর কিছু না পারলে ধর্মঘট ডেকে দেশ অচল করে দাবি আদায় করে নেবেন।

সেদিন কোথায় যেন দেখলাম, ঢাকার অধিকাংশ বাস কোম্পানি সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতাদের মালিকানায়। এই যেমন জাবালে নুরের অন্যতম মালিক নৌপরিবহন মন্ত্রীর শ্যালক নান্নু। আর সবার মাথার ওপর ছাতা হয়ে আছেন শাজাহান খান, সারাদেশের পরিবহন খাত যার একক নিয়ন্ত্রণে।

দুর্ঘটনার ঘন্টাখানেক পর সাংবাদিকরা সচিবালয়ে পেয়ে যান নৌপরিবহন মন্ত্রীকে। সারা জাতি যখন শোকে মুহ্যমান, শাজাহান খান তখন সেই শোকের দগদগে ক্ষতে কাচা লবন ছিটিয়ে দিলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়ে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, 'গতকাল ভারতের মহারাষ্ট্রে এক দুর্ঘটনায় ৩৩ জন মারা গেছে। আমরা এগুলো নিয়ে যেভাবে কথা বলি। ওখানে কি তত কথা বলে?' 

বাংলাদেশের দুর্ঘটনাকে জায়েজ তিনি ভারতের উদাহরণ টেনে বলেন, সেখানে ঘণ্টায় ১৬ জন মারা যায়। যেন ভারতে ঘণ্টায় ১৬ জন মারা যায় বলেই আমাদের দেশে দুর্ঘটনা বিনা বিচারে পার পেয়ে যাবে। ভারতের লোকজন দুর্ঘটনা নিয়ে কথা বলেন কিনা জানি না। তারা না বললেই কি আমাদেরও চুপ থাকতে হবে?

প্রথমে লোকমুখে শুনে আমি মন্ত্রীর কথা বিশ্বাস করিনি। নিজ কানে শুনেও আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে। তবে বিশ্বাস করতেই হলো। দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে তার মুখে কোনো শোকের ছায়া দেখিনি। বরং সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যেতে তিনি দাত কেলিয়ে হাসছিলেন। একজন রাজনীতিবিদ কীভাবে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারেন, ভেবে পাই না।

আমি খুব আইন মানা মানুষ। বিচারবহির্ভূত সব ধরনের কর্মকাণ্ডের বিপক্ষে আমি। কিন্তু দুর্ঘটনার পরপর বিক্ষুব্ধরা রাস্তা অবরোধ করে, গাড়ি ভাংচুর করে, গাড়িতে আগুন দেয়। শিক্ষার্থীদের ধন্যবাদ, তারা অনেক সংযম দেখিয়েছে। তারা বেছে বেছে শুধু বাস ভাংচুর করছিল। আমি জানি না, নিজে সেখানে থাকলে অত সংযম দেখাতে পারতাম কিনা।

দ্বিতীয় দিনেও শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে। তবে তারা অ্যাম্বুলেন্স ও হজযাত্রীদের গাড়ি ছেড়ে দেয়। শিক্ষার্থীরা ঘাতক চালকের ফাঁসি, নৌপরিবহন মন্ত্রীর পদত্যাগ, ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণসহ ৯ দফা দাবি জানিয়েছে। তবে নৌপরিবহন মন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি পদত্যাগ করবেন না। আমি জানি ফাঁসির দাবিও পূরণ হবে না। কারণ সড়ক দুর্ঘটনায় সর্বোচ্চ সাজা তিন বছরের কারাদন্ড। তাই প্রতিবাদ জারি রাখতে হবে। ঘাতক চালকরা যখন বারবার পার পেয়ে যায়, শাস্তি যখন অপ্রতুল; তখন প্রতিবাদের বিকল্প নেই।

হেলাল হাফিজ তার বিখ্যাত কবিতা নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন, 'কোনো কোনো প্রেম আছে, প্রেমিককে খুনী হতে হয়।' তেমনি কখনো কখনো প্রতিবাদই হয় একমাত্র বিকল্প। শিক্ষার্থীদের নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের পাশে আছি। হোক প্রতিবাদ।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর